অশোধনীয় আশাবাদের বাজেট
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবারের বাজেটে ‘কালো মেঘের আড়ালে সোনালী রেখা’ দেখেননি। তবে তিনি অশোধনীয় আশাবাদী বলে জানিয়েছেন। বলেছেন, আশার কথা, এগিয়ে যাবার স্বপ্নের কথা। গতানুগতিকতা মেনে নিয়ে প্রস্তাবিত এ বাজেটের আকার যেমন বেড়েছে, বেড়েছে বাজেট বক্তৃতার পৃষ্ঠা সংখ্যা, তেমনি বেড়েছে অর্থমন্ত্রীর উচ্চাভিলাষও।
তবে এটা ঠিক অর্থনীতির অনেক সূচকেই ভালো অবস্থানে মুহিত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। প্রবাসীয় আয়ও সন্তোষজনক। আমদানি বেড়েছে। বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ দাঁড়িয়েছে।
তবে কর্মব্যস্ততায় আশি বছর অতিক্রম করা অর্থমন্ত্রী যতই সোনালী রেখা দেখতে পান, স্বপ্ন দেখানোর ভিত্তিটা যথেষ্ট মজবুত নয়। ছয় বছর ধরে তিনি বিনিয়োগ বাড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন, বিনিয়োগ বাড়েনি। তিন অর্থবছর ধরে তিনি ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের গল্প বলছেন। কিন্তু প্রবৃদ্ধি সেই ৬ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে। বরং এবার নতুন করে এক দুশ্চিন্তা যোগ হয়েছে অর্থমন্ত্রীর প্রবৃদ্ধির পরিকল্পনায়। কমেছে রপ্তানি আয়।
খানিকটা নড়বড়ে ভিতের আরও কিছু তথ্য অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাতেই আছে। যেমন, বিদায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা মেনে তিনি আয় করতে পারেননি, ব্যয়ও করতে পারছেন না। সীমার মধ্যে থাকলেও বাজেট ঘাটতি বেড়েছে। এমনকি বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি কত হলো এর হিসাবও মেলেনি।
তারপরও উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে সাহস দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। দুর্বলতাগুলোর কথাও বলেছেন। অর্জন যাই থাকুক, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, দারিদ্র্য আরও কমানোর আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এম এ মুহিতের সবচেয়ে সাহসী পরিকল্পনা রাজস্ব আদায়ের নতুন হিসাব।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের যে বাজেটটি পেশ করেছেন, সেটি বড় ব্যয় ও বড় আয়ের বাজেট। এই বড় আয় নির্ভর করছে মূলত আয়কর আদায়ের ওপর, আর বড় ব্যয় নির্ভর করছে পদ্মা সেতুসহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর। এই আয়-ব্যয় পরিকল্পনার মধ্যে কতখানি ভারসাম্য রাখতে পারবেন, তার ওপরই নির্ভর করছে অর্থমন্ত্রীর বাজেটের উচ্চাভিলাষ।
বলা যায়, নতুন বাজেট হচ্ছে দুর্বল একটি রাজস্ব কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো অতি উচ্চাভিলাষী প্রয়াস। কেননা রাজস্ব বোর্ড জানিয়েছে যে, তাদের পক্ষে বড় রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে না।
নতুন বাজেটটি আরও কিছু দিক থেকে ব্যতিক্রম। এটি নতুন করে ক্ষমতাসীন সরকারের দ্বিতীয় বাজেট। বিরোধী দলের উপস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী টানা দ্বিতীয় বার বাজেট দিলেন। যদিও এবারের বিরোধী দল সরকারেরই ‘অংশ’। তাই অর্থমন্ত্রী হাততালি ও টেবিল চাপড়ানো পেয়েছেনও বেশি। বাজেট বক্তৃতা শুরু হয় বেলা তিনটা ৪০-এর দিকে। অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় আবারও নাম দিয়েছন চমৎকার করে। নামটি হচ্ছে, ‘সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ, উচ্চ প্রবৃদ্ধির পথ রচনা।’
এর আগে অর্থবিল অনুমোদনের জন্য সংসদের ক্যাবিনেট কক্ষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ অন্য মন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। বিকেল ৩টার দিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অর্থবিল অনুমোদন করে। এরপর বিলটি অনুমোদন করে তাতে সই করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং বিল আকারে সংসদে উত্থাপনের জন্য তা সংসদ সচিবালয়ে পাঠান।
বুধবার বিল উত্থাপনের সময় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ জাতীয় পার্টির অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বাজেট পরিসংখ্যান: নতুন অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন, যা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ৯৭ হাজার। এর বাইরে আছে সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থায়ন ৩ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। যা জিডিপির ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। নিজস্ব অর্থায়ন ধরলে বাজেটের আকার ৩ লাখ কোটি টাকা দাঁড়াবে।
অন্যদিকে বাজেটের মোট আকারের মধ্যে রাজস্ব প্রাপ্তি ও বৈদেশিক অনুদান মিলিয়ে সরকারের আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব প্রাপ্তি এক লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এই আয় জিডিপির ১০ দশমিক ৩ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে সরকারের মোট আয় ধরা ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। তবে তা সংশোধন করে ঠিক করা হয়েছে এক লাখ ৬৩ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা।
সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এই ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে আসবে ৩০ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ৮ শতাংশ, আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হবে ৫৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রীর ঘাটতি অর্থায়নের পরিকল্পনাটিও যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী। কারণ, ৩০ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার কোনো রেকর্ড বাংলাদেশের নেই। সুতরাং বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থ না পেলে সরকারকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই নিতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা কম ঋণ পাবেন। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিলে নতুন করে অর্থ ছাপাতে হবে। এতে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। যদিও অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছরের জন্য ৬ দশমিক ২ শতাংশেরও কম মূল্যস্ফীতির স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন: প্রতি বাজেটের আগে প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে বিতর্ক একটি রাজনৈতিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। দেখা গেছে, গত চার অর্থবছর ধরেই অর্থমন্ত্রী ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলে আসছেন। কারণ, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে প্রয়োজন ৭ থেকে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন। আর এ কারণে বাস্তবতা যাই থাকুক, লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশের নিচে তিনি নামাতে আগ্রহী হননি।
২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ শতাংশ, অর্জন ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ; ১২-১৩ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্জন ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। ১৩-১৪ অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ, কিন্তু অর্জন ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আর এবার ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ।
তবে এবারের বাজেট বক্তৃতার শেষ অংশে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘অবশ্য বলতে পারেন, আমাদের কার্যক্রম এবং অর্থায়ন পরিকল্পনা উচ্চাভিলাষী। কিন্তু প্রমাণ করেছি যে উচ্চাভিলাষী কার্যক্রম আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি। তাই ৬ শতাংশের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ভাঙতে চাই। মুহিত আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন, সব ঠিক থাকলে, জনগণ সহযোগিতা করলে দেশকে তিনি আরো অনেক দূর নিয়ে যাবেন। এজন্য অবশ্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার হবে তার।
তিনি বলেছেন, তিনি সব সময়ই আশাবাদী এদেশের সম্ভাবনা নিয়ে। তাই তো অশোধনীয় আশাবাদের বাজেট দিতে ভয় করেননি।
## প্রস্তাবিত বাজেট মন্ত্রিসভায় অনুমোদন
## বাজেট অধিবেশন শুরু
## অর্থমন্ত্রীর পূর্ণাঙ্গ বাজেট বক্তৃতা
## অটোরিকশার দাম বাড়ছে
## ফোনে কথা বললেও কর
## করমুক্ত আয়ের সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা
## কর কমলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকসহ সব প্রতিষ্ঠানের
## বাজেট বক্তৃতা করছেন অর্থমন্ত্রী
## করমুক্ত আয়ের সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা
## বাড়ছে সাবান ও ডিটারজেন্টের দাম
## কয়েল ও অ্যারোসলের দাম কমছে
## দাম কমছে মিষ্টি বিস্কুটের
## বাড়ছে সিম ও রিম কার্ডের দাম
## দাম বাড়ছে না সস ও ফলের রসের
## শুল্ক বাড়লো ইমিটেশনের
## চকলেটের দাম কমছে
## অমসৃণ হিরার দামও বাড়ছে
## রিভলবার ও পিস্তলের দাম বাড়ছে
## জননিরাপত্তায় আরো ৫০ হাজার পুলিশ নিয়োগ
## ৬৫ ঊর্ধ্ব মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ১০ হাজার টাকা
## দাম বাড়ছে আসবাবপত্রের
এসএ/একে/পিআর