৪০ বছরেও স্বাদ বদলায়নি গনি চাচার নেহারির
শুক্রবার, জুমার নামাজের আগমুহূর্ত। বনানীর হাট তখনও জমে ওঠেনি। সবজি বিক্রেতারা কেবল বস্তা থেকে সবজি নামিয়ে দোকান সাজাচ্ছেন। ময়রার দোকানিরা মিষ্টির পসরা সাজিয়েছেন।
আর আব্দুল গনি (৬০) খুব তড়িঘড়ি করে রুটি বানাচ্ছেন। তার এই ব্যস্ততার কারণ টের পেলাম জুমার নামাজ শেষে। মসজিদ থেকে বের হয়েই একে একে হাজির আব্দুল গনির দোকানে। মনে হচ্ছে মিছিল শেষে দলেবলে আসছে সবাই।
- আরও পড়ুন: ভারত গিয়ে ঘুরে আসুন বাংলার স্কটল্যান্ডে
রুটির পাশাপাশি কী আছে গনির দোকানে, যার জন্য এত ভিড়? দেখতে আমিও গেলাম। গিয়েই দেখি বড় এক সসপেনে গরুর নলা বা নেহারি। রংই বলে দিচ্ছে এর লোভনীয় স্বাদ কতটা।
রুটি বানানোর ফাঁকে ফাঁকে আব্দুল গনি ও তার কর্মচারী মিলে নেহারি নাড়ছেন। আর তাতেই যেন স্বাদ-গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
এর মধ্যেই দোকানে বসার জায়গা পূর্ণ হয়ে গেছে। কেউ কেউ আছেন দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে আমি ও আমার শিক্ষক আছেন। বসার জায়গা ফাঁকা হতেই সেখানে গিয়ে বসলাম।
অর্ডার দিলাম নেহারি ও রুটির। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সামনে হাজির হলো বিশাল সাইজের নেহারি ও গরম গরম রুটি।
নেহারির সঙ্গে যে পরিমাণ ঝোল দিয়েছে, তা দিয়ে অনায়াসে তিন থেকে চারটি রুটি খাওয়া যাবে। পাঁচটি রুটি খাওয়ার পর দেখলাম, অনেকেই আবার গরুর বট (ভুঁড়ি) দিয়ে ভাত খাচ্ছেন।
দেখে স্যার বলে উঠলেন, ‘শান্ত সাহেব, পেট তো ফাঁকাই আছে। ভাত আর বট খাই’। ভাত-বট দেখে আমারও পেট ফাঁকা মনে হচ্ছে।
তাই বললাম, ‘আচ্ছা স্যার।’ বলেই আবার বট ও ভাতের অর্ডার দিলাম। ভাত ও বট দেওয়ার পর তার ওপর দেয় নেহারির ঝোল। ভাত-বট আয়েশ করে খেলাম।
খাওয়া শেষে জানতে পারলাম নেহারির ইতিহাস। প্রায় ৪০ বছর ধরে আব্দুল গনি এই হাটে নেহারি বিক্রি করছেন।
শুনে কিছুটা অবাক হলাম। এরপর কথা হয় আব্দুল গনির সঙ্গে। দোকানে প্রচুর ভিড় থাকায় প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে তার সঙ্গে কথা বলতে হলো।
শুরুর গল্প
আব্দুল গনি জানান, প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি বগুড়ার বনানীর সুলতানগঞ্জ হাটে নেহারি বিক্রি করে আসছেন।
আব্দুল গনির বাপ-চাচারা এ হাটেই ভাতের ব্যবসা করেছেন। বাবা একদিন তাকে বলেন, ‘তুমি আমার পাশেই রুটি ও আলু ঘাটির ব্যবসা করতে পারো।’
বাবার পরামর্শে কিশোর বয়সেই রুটি ও আলু ঘাটির ব্যবসা করেন তিনি। সে সময় ৫০ পয়সায় রুটি ও আলু ঘাটি বিক্রি করেছেন।
পরে আলু ঘাটির সাথে যোগ হয় নেহারি। সেসময় তিনি এক পিস নেহারি বিক্রি করেছেন দুই টাকায়। এখন এক পিস বিক্রি হয় ১৮০ টাকায়।
বর্তমানে আব্দুল গনির দোকানে দিনে ১৫০ কেজি নেহারি, ৪০ কেজি বট, ২৫ কেজি চাল ও ১৮ কেজি আটার রুটি বিক্রি হয়। টাকার অঙ্কে তার দিনে বিক্রি দাঁড়ায় ৮০-৯০ হাজার টাকা।
মাঝে মাঝে বিক্রি লাখ পার হয়ে যায়। বিশেষ দিনগুলোতে তিনি দিনেই দেড় লাখ টাকার মতো নেহারি বিক্রি করেন। তার এ নেহারি পাওয়া যায় বনানীর হাটের দিন শুক্র ও সোমবার।
- আরও পড়ুন: রাজস্থান ভ্রমণে কী কী দেখবেন?
তিনি জানান, আগে একসাথে এত গরুর পা জোগাড় করতে বেশ বেগ পেতে হতো। তবে এখন ক্যান্টনমেন্টসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়মিত তার কাছে গরুর পা আসে।
জাফর (৫৫) নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘গনি মিয়ার নেহারি আমি শুরুতেও খেয়েছিলাম, এখনও খাই। আমার কাছে স্বাদের কোনো পরিবর্তন লাগে না। মনে হয় তার রান্নার স্বাদ একই আছে। আগে যেমন সুস্বাদু ছিল, এখনও তাই আছে।’
৪০ বছর ধরে রান্নার স্বাদ অপরিবর্তিত, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তার ছেলে জিয়াউল ইসলাম বলেন, ‘পুরো বনানীজুড়ে বাবুর্চি হিসেবে আব্বার খ্যাতি আছে। তিনি সপ্তাহে দু’দিন হাট করেন।’
‘আর বাকি দিনগুলোতে রান্নার কাজ করেন। এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন দূর-দূরান্ত থেকে তাকে রান্নার জন্য নিয়ে যায়। আর এ কারণেই তার হাতের নেহারি এত সুস্বাদু ও স্বাদ অপরিবর্তিত আছে।’
- আরও পড়ুন: শীতে কোথায় ঘুরতে যাবেন?
আব্দুল গনির এ নেহারি খেতে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, শেরপুর, জয়পুরহাট, নওগাঁ, গাইবান্ধা, দিনাজপুর থেকে লোক আসে।
জয়পুরহাট থেকে নেহারি খেতে আসা আরিফ হোসেন জানান, ‘আমি ইউটিউবে চাচার এ নেহারির ভিডিও দেখে খেতে এসেছি।’
‘আমি অনেক জায়গায় নেহারি খেয়েছি। তবে এ জায়গার নেহারি আমার কাছে বেস্ট। আর এত বড় সাইজের নেহারি সচারচর পাওয়া যায় না।’
গনি চাচার এ নেহারি খেতে চাইলে আপনাকে প্রথমেই আসতে হবে বগুড়ায়। এরপর বগুড়ার সাতমাথা থেকে অটোরিকশা নিয়ে আসতে হবে বনানীর হাটে।
ভাড়া পড়বে ২০-৩০ টাকা জনপ্রতি। বনানীর গনি চাচার নেহারি খেয়ে ঘুরে দেখতে পারেন বগুড়ার দর্শনীয় স্থানগুলো।
জেএমএস/এসইউ/জিকেএস