স্বপ্নচূড়ায় রোনালদো
বিষয়টা একটু অভিনব। ইউরোয় ইতালি যখন ফ্রান্সের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলতে নেমেছিল, তখন এক মিনিট নীরবতা পালন করেছিল গুলশান হামলায় নিহত ইতালীয়দের উদ্দেশ্যে। ১০ জুলাই ইউরোর ফাইনালের রাতে তাই প্যারিসের বিখ্যাত আইফেল টাওয়ার যখন লাল-সবুজ আলোয় রঙিন হচ্ছিল তখন বাংলাদেশের অনেকেই ভেবেছিল, গুলশান হামলায় নিহতদের স্মরণে ফ্রান্সও ওই আলোর প্রক্ষেপণ করছিল আইফেল টাওয়ারের ওপর। ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় হুজুগে অনেকেই সেই ছবি পোস্ট করে সে কথা জানান দিয়েছিল।
ভুলটা ভাঙে পরক্ষণেই। যখন নীল-সাদা-লাল রঙেরও প্রক্ষেপণ হলো। ওটা ফরাসিদের পতাকার রঙ। মূলত ফাইনালে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পর্তুগাল আর ফ্রান্সের জাতীয় পতাকার রঙকেই উপস্থাপন করা হচ্ছিল আইফেল টাওয়ারে। পর্তুগালেরও যে জাতীয় রঙ লাল (হালকা গাড়) সবুজ! স্টেডে ডি ফ্রান্সে মহাফাইনালের ১২০ মিনিটের ধুন্দুমার লড়াইয়ের পর আইফেল টাওয়ারের ওপর নিক্ষিপ্ত আলোর রঙ স্থায়ী হয়ে গেলো লাল-সবুজে। বিজয়ী পর্তুগালের জয়োগান তখন আইফেল টাওয়ার ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে যে সারা বিশ্বে!
অথচ এই স্থায়িত্বটা পেতে কত লড়াই করতে হয়েছে পর্তুগিজদের। স্টেডে ডি ফ্রান্সে কত নাটকের পর! বিশ্বের দুই সেরা ফুটবলারের একজন নেমেছিলেন শিরোপা জয়ের লক্ষ্যে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। প্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে। ক্লাবের চেয়ে দেশ বড়- এই সত্যটা প্রমাণ করতে পারেননি মেসি। চার-চারটি বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেও।
রোনালদো তো উঠলেন মাত্র দ্বিতীয় ফাইনালে। তাও গোনায় ধরা হয় না যাদেরকে, সেই পর্তুগালকে নিয়ে। ফাইনালে যখন উঠেই গেলেন, রোনালদোর সামনে তখন ইতিহাসের হাতছানি। নিজের সামর্থ্যরে ৬০ ভাগ দিলেও বুঝি ইতিহাসটা গড়ে ফেলবেন। ক্লাব আগে না দেশ আগে- এই চিরন্তন লড়াইয়ের সমাধানটাও করে ফেলবেন তিনি; কিন্তু নিয়তি বুঝি হেঁয়ালি করতেই ভালোবাসে।
না হয়, শিরোপা দিবি, তো এতো নাটক কেন? খেলার সাত মিনিটেই দিমিত্রি পায়েতের ধাক্কায় বাম হাঁটুতে আঘাত। ২৩ মিনিটে শিশুরমত কেঁদে, চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে রোনালদো উঠে গেলেন মাঠের বাইরে। ইউরো ফাইনালের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চিরতরে বেরিয়ে যেতে হল তাকে।
দিমিত্রি পায়েতের ট্যাকলের পরও প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু পারেননি। রোনালদো যখন স্ট্রেচারে শুয়ে টানেলের অভ্যন্তরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন, তখন একটা দেশের, একটা সমগ্র জাতির যাবতীয় আশাবাদও যেন ধীরে-ধীরে মাটিতে মিশে যাচ্ছিল।
কিন্তু কেউ কি তখনও ভেবেছিল, নিয়তির এই খেলা আরও বাকি আছে! ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ওইদিন দু’বার কেঁদেছিলেন। প্রথমবার ম্যাচের ২৩তম মিনিটে। মাঠ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময়।
ভাবা যায়নি, এরপর ক্রিশ্চিয়ানো আরও একবার কাঁদবেন। যন্ত্রণায় নয়, আনন্দাশ্রুতে ভিজবে তার চোখ। ভাবা যায়নি, আটইফেল টাওয়ারের নিচে ফ্যান জোনে বেঞ্জামিন নামক এক পর্তুগিজ সমর্থককেও দু’বার দু’রকম আবেগে চূর্ণ হয়ে যেতে দেখা যাবে। কৃষ্ণকায় এই পর্তুগিজ সমর্থককে দেখা গেল বিয়ারের গ্লাসে সপাটে লাথি মারতে। হাঁটু মুড়ে বসে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়তে। সন্তান অকালে চলে গেলে পিতার যেমন হয়।
এডেরের গোলের পর সেই বেঞ্জামিনই অজানা এক ভারতীয় সাংবাদিকের গলা জড়িয়ে আরও এক মর্মস্পর্শী কান্নায় আছড়ে পড়লেন। সেই ভারতীয় সাংবাদিকের কথায়, ‘কথা শোনা যাচ্ছিল না বেঞ্জামিনের, দোমড়ানো-মোচড়ানো কণ্ঠ থেকে অসংলগ্ন কয়েকটা শব্দ নিঃসৃত হয় শুধু, ওহ গড... রোনালদো... রোনালদো... হি ডিড ইট... প্লিজ ব্লো দ্য হুইসল, প্লিজ...।’
না, রোনালদো তো আর মাঠে নামেননি। স্ট্র্যাপ বাঁধা হাঁটু নিয়ে তা আর সম্ভবও ছিল না; কিন্তু ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো নিজেকে নিঃশেষও হয়ে যেতে দেননি। ততক্ষণে তিনি বের করে এনেছেন আরেক ক্রিশ্চিয়ানোকে, ক্যাপ্টেন ক্রিশ্চিয়ানো! যিনি স্ট্র্যাপ বাঁধা হাঁটু ভুলে উত্তেজনায় ঢুকে পড়তে চাইছেন মাঠে, যিনি কোচ ফার্নান্দো স্যান্তোসকে হটিয়ে নিজেই আবির্ভূত হলেন কোচের ভূমিকায় এবং সেই পাগলা সমর্থক বেঞ্জামিনের মতোই চরম আর্তি নিয়ে রেফারির দিকে বারবার ছুটে যাচ্ছেন ‘ব্লো দ্য হুইসল’-এর দাবিতে!
রোনালদোর রিয়াল সতীর্থ পেপে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, পর্তুগিজ দলটাকে একটা পরিবারেরমত গড়ে তুলেছেন রোনালদো। গোলদাতা এডের বলেছেন, ‘বিরতির সময় ক্রিশ্চিয়ানোই আমাকে বলেছিলেন, স্কোরটা তোমার পা থেকেই আসবে। তার কথা শোনার পর যেন আমি পুরোপুরি বদলে যাই এবং সুযোগ খুঁজতে থাকি সেই স্কোরটা করার জন্য।’
পর্তুগিজ ডিফেন্ডার কেডেরিক সোয়ার্স বললেন, ‘বিরতির সময় রোনালদো আমাদের উদ্দেশ্যে এমন এক বক্তব্য দিয়েছিলেন, যা শুনে আমরা আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটতে শুরু করি। রোনালদো আমাদের বলেছিলেন, কোন কিছুই শেষ হয়ে যায়নি। তোমরাই জিতবে। জেতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ো, লড়াই করো।’
ফুটবলার রোনালদোর চেয়ে নেতা রোনালদোই যেন হঠাৎ কওে বড় হয়ে উঠলেন পর্তুগাল দলে। সেই নেতার এক আহ্বানেই তাকে শিরোপা উপহার দিলেন ন্যানি-পেপে-এডেররা। বিশ্বসেরা হয়েও যে একটা আন্তর্জাতিক ট্রফির আক্ষেপ ছিল, সে স্বপ্ন পূরণ করে ফেললেন রোনালদো। উঠে গেলেন ইতিহাসের স্বপ্নচূড়ায়।
জাগো নিউজের বিশেষ ই-ম্যাগাজিন জাগো স্পোর্টসের ৭ম সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন এই লিংকে…
আইএইচএস/এবিএস