ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণ ও দেশান্তরকরণের মোট ৫টি অপরাধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়।
অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ৮ জনকে হত্যা ও গণহত্যা, ৪ জনকে ধর্ষণ, ৩ জনকে ধর্মান্তরকরণ, ১৩টি পরিবারকে দেশান্তরকরণ, ৬৪টি বসতঘর ও দোকানপাটে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ।
গত বছরের ২৭ অক্টোবর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তদন্ত সংস্থা। ২৮ অক্টোবর এ প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ২৬ জুন শুরু করে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত মামলাটির তদন্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের দায়ে ২০০৯ সালের ২১ জুলাই ফোরকানের বিরুদ্ধে মির্জাগঞ্জ থানায় আবদুল হামিদ নামে এক ব্যক্তি মামলা দায়ের করেন।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে পটুয়াখালীর আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় তিনি উচ্চ আদালত থেকে ছয় মাসের জামিন নেন। গত বছরের ৩০ মার্চ বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালে তার বিরুদ্ধে হত্যা, লুণ্ঠন, খুন, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পান পটুয়াখালীর আদালত। তখন মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।
ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার একেএম নাসির উদ্দিন মাহমুদ মামলাটি গত বছরের ২৫ জুন তদন্ত সংস্থার কাছে পাঠান।
তদন্ত সংস্থা মামলাটি গ্রহণ করে ২৬ জুন থেকে তদন্ত শুরু করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়।
গত বছরের ৩০ জুন ফোরকান মল্লিককে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় গ্রেফতার দেখানো (শ্যোন অ্যারেস্ট) ও তদন্তের স্বার্থে ট্রাইব্যুনালে হাজির করানোর আবেদন করা হয়।
শুনানি শেষে ফোরকান মল্লিককে ৩ জুলাই ট্রাইব্যুনালে হাজির করানোর জন্য কারা মহাপরিদর্শককে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২।
৩ জুলাই ফোরকান মল্লিককে হাজির করা হয়ে গ্রেফতার দেখিয়ে (শ্যোন অ্যারেস্ট) কারাগারে পাঠান ট্রাইব্যুনাল।
২০১৪ সালের ২৫ জুন সকালে পটুয়াখালীর গোয়েন্দা পুলিশ বরিশালের রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ফোরকান মল্লিককে গ্রেফতার করে।
ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ:
ফোরকানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭০-৭১ সালে ফোরকান মল্লিক মুসলিম লীগের সমর্থক ও কর্মী হিসেবে একই গ্রামের শান্তি কমিটির সভাপতি আজহার উদ্দিন খান, খবির বিশ্বাস, সুবিদখালীর শাহজাহান সিকদার, আ. ওয়াজেদ সিকদার, কাকড়াবুনিয়া গ্রামের আলী আকবর গাজী, ইউসুফ আলীসহ অন্যান্যদের সঙ্গে মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচারণা চালান। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা রাজাকার বাহিনী গঠন করেন।
পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানার সুবিদখালী পুরাতন হাসপাতাল ভবনটিতে ছিল রাজাকারদের প্রধান ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সুবিদখালী বাজারের ডা. দেবেন্দ্রনাথ সরকার ও তার স্ত্রীকে হত্যার পর ওই বাসাটি থানা শান্তি কমিটির প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করেন তারা।
এসব ক্যাম্প থেকে মির্জাগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন ফোরকান মল্লিক ও তার বাহিনী।
প্রথম অভিযোগ : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আষাঢ় মাসে (ইংরেজি ২৭ জুন থেকে ৩ জুলাই) সকাল ছয়টার দিকে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা গানবোটে করে পাকিস্তানি সেনাদের মির্জাগঞ্জ থানার কাকড়াবুনিয়া গ্রামে নিয়ে আসেন। পরে ওই গ্রামের হাওলাদার বাড়ির মো. কাঞ্চন আলী হাওলাদার ও হাজী আবুল হাশেম হাওলাদারসহ মোট সাত জনকে আটকের পর আটককৃতদের ওপর নির্যাতন চালান, বাড়ি-ঘর লুটপাট এবং জোর করে অর্থ আদায় করেন। আটককৃতদের এক মাস আটক রাখার পর ছেড়ে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগ : ১৯৭১ সালে আষাঢ় মাসের শেষের দিকে (ইংরেজি ২ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই) সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের মির্জাগঞ্জ থানার দেউলি গ্রামে নিয়ে আসেন। পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসার পর ওই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলতাফ হায়দারসহ মোট ছয়জনের ঘর-বাড়িতে লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ করেন।
তৃতীয় অভিযোগ : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১২ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের মির্জাগঞ্জ থানার সুবিদখালীতে নিয়ে আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদবাহক কাকড়াবুনিয়া গ্রামের হাফিজ উদ্দিন খলিফা, মির্জাগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুল কাদের জমাদ্দার, সুবিদখালী বাজারের ডা. দেবেন্দ্রনাথ ও তার স্ত্রী বিভা রানীকে আটকের পর নির্যাতন চালিয়ে তাদের হত্যা করেন। এ অভিযোগে ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরণ এবং বিতাড়নের অভিযোগ আনা হয়েছে।
চতুর্থ অভিযোগে : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫ থেকে ৮ ভাদ্র (ইংরেজি ২২ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট) সময়ের মধ্যে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের মির্জাগঞ্জ থানার কাকড়াবুনিয়া বাজারে আসেন। এখানে তারা চারজনকে হত্যা করেন। এছাড়াও ফোরকান মল্লিক ও তার সহযোগী রাজাকার এবং পাকিস্তান সেনারা হত্যা, গণহত্যা, জখম, আটক, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধ সংঘটিত করেন।
পঞ্চম অভিযোগ : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫-৮ ভাদ্র (ইংরেজি ২২ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট ১৯৭১) সময়ের মধ্যে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা মির্জাগঞ্জ থানার দক্ষিণ কলাগাছিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল হোসেন মৃধাকে আটকের পর নির্যাতন এবং বাড়ি-ঘর লুটপাট করেন।
# মানবতাবিরোধী অপরাধ : ফোরকান মল্লিকের রায় বৃহস্পতিবার
এফএইচ/এসকেডি/পিআর