ভিডিও EN
  1. Home/
  2. খেলাধুলা

ইউরোয় পর্তুগিজ বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৩:২৪ পিএম, ১৮ জুলাই ২০১৬

বিপ্লবটা বহু আগেই ঘটিয়েছিল ইউসেবিও-ফার্নান্দো পেরেসরা। ১৯৬৬ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ ফুটবলের মত বৈশ্বিক কোন টুর্নামেন্টে খেলতে এসেই তৃতীয় হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল পর্তুগাল। ১০দিন আগেও সেটি ছিল পর্তুগালের সেরা সাফল্য; কিন্তু সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে পর্তুগিজদের দাপট। ফিগো-রুই কস্তা-ডেকোরা যেটি পারেননি সেটিই করিয়ে দেখালেন রোনালদোর নেতৃত্বে টগবগে এক পর্তুগিজ দল।

প্রথমবারের মত ইউরো জিতে নিজেদেরকে নিয়ে গেলেন বিশ্বসেরাদের কাতারে। পর্তুগিজ এই বিপ্লবের নেতা স্বয়ং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়ে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার অসাধারণ এক মানসিকতা মুগ্ধ করেছে সমালোচকদেরও। অথচ ইউরো সেরা হওয়ার দিনে তিনি মাঠে ছিলেন মোটে ২৩ মিনিট। স্বাগতিক ফ্রান্সকেই তাদের মাটিতে অখ্যাত লিলের ফুটবলার এডেরের গোলে রচিত হয় পর্তুগিজদের ইতিহাস।

পর্তুগালের ইউরোর ইতিহাসটা বেশ সমৃদ্ধ। অন্যসবার মত একাধিকবার টুর্নামেন্ট সেরা না হতে পারলেও ধারাবাহিকতা প্রমাণ করবে ইউরো জেতার যোগ্য দাবিদার ছিলেন তারাই। ১৯৮৪ সালের ইউরোয় প্রথমবার খেলতে এসেই তৃতীয় হয় পর্তুগিজরা। সেবারের সেমিফাইনালেও প্রতিপক্ষ ছিল ফ্রান্স; কিন্তু মিশেল প্লাতিনির সেই ফ্রান্স এখনকার ফ্রান্সের চেয়ে সবদিক দিয়েই এগিয়ে। ফ্রান্সের ঘরের মাঠে ৩-২ গোলের হারের কষ্ট ভালোমতই পুষে রেখেছিল পর্তুগিজরা।

মাঝের দুই ইউরো টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগই হয়নি পর্তুগালের; কিন্তু যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই নিজেদের প্রমাণ করেছে তারা। ১৯৯৬ সালের ইউরো কাপে এসেই আবার কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে তারা। পোবোর্স্কির একমাত্র গোলে চেকদের বিপক্ষে কপাল পোড়ে রুই কস্তা-ফিগোদের। শিরোপার কাছাকাছি এসেও ফিরে যাওয়ার কষ্টের জ্বালা বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছিল তারা। তাই ২০০০ সালের পর থেকেই শুরু হল পর্তুগিজদের বিশ্ব ফুটবলে বিশ্বসেরাদের কাতারে জায়গা করে নেওয়ার মিশন।

২০০০ সালের ইউরোয় তৃতীয় হয়ে সবাইকে চমকে দেয় ফিগোরা। নুনো গোমেজের একমাত্র গোলে এগিয়ে থাকলেও শেষপর্যন্ত অঁরি এবং জিদান ম্যাজিকে ২-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ফ্রান্স। সেবারও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল জিদানরা। আর পর্তুগাল পেয়েছিল শিরোপার দু’হাত দূরে থেকে বিদায়ের তীক্ত অভিজ্ঞতা। শিরোপার এত কাছে এসেও শিরোপা না পাওয়ার আক্ষেপ ঘোচাতে ২০০৩ সালে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ২০০২ বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিলের জাদুকরি কোচ লুই ফিলিপে স্কলারিকে।
 
হাতেনাতেই ধরা দেয় সাফল্য। ২০০৪ সালের ইউরো কাপে ঘরের মাঠে জার্মানি, ইতালিরমত শক্তিকে টপকে ফাইনালে ওঠে ডেকো-ফিগোরা। অখ্যাত গ্রিসের বিপক্ষে ফাইনালের মোকাবেলায় সকলের বাজি ছিল পর্তুগালের পক্ষেই; কিন্তু কারিস্তিয়াসের করা ৫৭ মিনিটের গোলে আবারো স্বপ্ন ভঙ্গ পর্তুগালের। মাত্র একধাপ দূরে থেকে পর্তুগালের এমন বিদায় আজও মেনে নিতে পারেন না ফিগো-ডেকোরা। সেই টুর্নামেন্ট দিয়েই ইউরোয় অভিষেক হয় রোনালদোর। ফিগোদের অবসরের পর মৃতপ্রায় পর্তুগিজ ফুটবলকে টেনে নেওয়ার দায়িত্ব একাই বহন করে চলছেন রোনালদো।

championsইউরোর মত সাফল্য বিশ্বকাপেও বজায় রেখেছিল পর্তুগাল। ২০০৬ সালে নিজেদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মত সেমিফাইনালে উঠে সবাইকে চমকে দিয়েছিল স্কলারির পর্তুগাল। আবারো সেই ফ্রান্স গেরোয় আটকে যেতে হয়েছিল পর্তুগিজদের। ২০০০ সালের ইউরোর মত এবারও সেই জিদানের করা পেনাল্টি গোলে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ফ্রান্স। বিশ্বকাপের মত আসরে শিরোপার এতো কাছে এসেও ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে না পারার কষ্ট আজও পর্তুগিজদের কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। জার্মানির সঙ্গে তৃতীয়স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ৩-২ গোলে হেরে চতুর্থ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় নুনো গোমেজদের।
 
২০০৮ সালের ইউরো কাপে আবারও শেষ আটের মুখ দেখে পর্তুগাল। দু’বছর আগে যেই জার্মানির কাছে হেরেই বিশ্বকাপে চতুর্থ হয়েছিল পর্তুগিজরা, সেই জার্মানির কাছে হেরেই ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয় নুনো গোমেজরা। ইউরো ব্যর্থতার পরই স্কলারিকে বরখাস্ত করে সাফল্যের সন্ধানে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় কার্লোস কুইরোজকে।

তবুও আসেনি সাফল্য। ২০১২ সালের ইউরোয় আবারো সেমিফাইনালের মুখ দেখে পর্তুগাল। বেশ ভালোভাবেই এগোচ্ছিল রোনালদোর অধীনে পর্তুগিজরা। সেমিফাইনালে চ্যাম্পিয়ন স্পেনের মুখোমুখি হওয়াতেই বিপত্তিটা বাধে। ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানেই পর্তুগালকে ৪-২ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে স্পেন। সেবার চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল স্প্যানিশরা।

চার বছর পর আবারো ইউরো কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে পর্তুগাল; কিন্তু অন্যবারের তুলনায় এবারের পর্তুগাল দলটি ছিল তুলনামূলক ভঙ্গুর। এক রোনালদো ছাড়া আর কেউই সেই মাপের ফুটবলার ছিলেন না দলে; কিন্তু দলগত সাফল্য কী জিনিস সেটি আরো একবার দেখলো ফুটবল বিশ্ব।

গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচের তিনটিতেই ড্র। শুরুতেই পর্তুগালের এমন বাজে পারফরম্যান্সের কারণে সবাই বাতিলের খাতাতেই ফেলেছিল রোনালদোদের; কিন্তু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ইউরোর নকআউট রাউন্ড নিশ্চিত করা পর্তুগাল যেন দুর্বার হয়ে খেলতে থাকে পরবর্তী ম্যাচগুলো।

শেষ ষোলোতেই মুখোমুখি হয় শক্তিশালী ক্রোয়েশিয়ার। যাদের কাছে গ্রুপপর্বে হেরেছিল টানা দুইবারের ইউরো চ্যাম্পিয়ন, শক্তিশালী স্পেন। তাদের বিপক্ষে শেষ সময় পর্যন্ত সমানে সমান লড়াই করে ১১৭ মিনিটে কোয়ারেসমার গোলে ম্যাচ জিতে নেয় পর্তুগিজরা। পরবর্তী ধাপে কোয়ার্টার ফাইনালে লেভান্ডোভস্কির পোল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করে টাইব্রেকারে ম্যাচ জিতে নেয় রোনালদোরা।

পর্তুগালের আসল লড়াইটা হয় সেমিফাইনালে। সেখানে প্রথমবারের মত ইউরো খেলতে এসেই চমক দেখানো ওয়েলসের বিপক্ষে দাপটের সঙ্গে ম্যাচ জিতে নেয় পর্তুগাল। রোনালদো-ন্যানির লক্ষ্যভেদে পর্তুগালের ২-০ গোলের জয়ে কপাল পোড়ে বেলের ওয়েলসের।

ফাইনালে স্বাগতিক ফ্রান্সের বিপক্ষে পিছিয়ে থেকেই ম্যাচে নামে পর্তুগাল। ঘরের মাঠের দর্শক এবং আন্তোনিও গ্রিজম্যান-পগবা-পায়েতদের নিয়ে গড়া ফ্রেঞ্চ লাইনআপ শিরোপার স্বপ্ন দেখাচ্ছিল জিদানের উত্তরসূরিদের; কিন্তু একটি দল হিসেবে কীভাবে খেলতে হয় সেটির প্রমাণ দিল ফার্নান্দো সান্তোসের পর্তুগাল দল। ৭৯ মিনিটে মাঠে নামেন অখ্যাত স্ট্রাইকার এডের। সোয়ানসি সিটিতে খেলার সময় প্রিমিয়ার লিগ প্রেমিরা তার নাম হয়ত এক-দু’বার শুনেও থাকবে।

সেই এডেরের পা থেকেই আসলো পর্তুগালের কাঙ্খিত শিরোপা। হাসি ফুটলো রোনালদোর মুখে। চোখের জলে ২৩ মিনিটে মাঠ ছাড়লেও দিন শেষে রাজ্যের সর্বকালের সেরা হাসিটা হেসেছেন রোনালদো। নিজেকে নিয়ে গেলেন মেসির থেকে অনেক এগিয়ে। ঘটালেন পর্তুগিজ বিপ্লব। যে বিপ্লবের নেশায় মত্ত পর্তুগালের আপামর ফুটবল জনতা। এ বিপ্লব পর্তুগালের বিপ্লব। এ বিপ্লব ফুটবলের নবজাগরনের বিপ্লব।

আইএইচএস/পিআর

আরও পড়ুন