ভিডিও EN
  1. Home/
  2. স্বাস্থ্য

যত প্রেসক্রিপশন তত কমিশন : আশীর্বাদ অ্যান্টিবায়োটিক এখন অভিশাপ

প্রকাশিত: ০৩:০৭ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

সরকারি হাসপাতালসহ সারাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের অপব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। উন্নত বিশ্বে রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া যেকোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ হলেও এদেশে গ্রাম-গঞ্জের হাটবাজার, ছোটবড় ফার্মেসি এমনকি মুদি দোকানেও মুড়ি-মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ অবাধে বিক্রি হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ও লাইসেন্সবিহীন লক্ষাধিক ওষুধের দোকান রয়েছে। বেশির ভাগ ওষুধের দোকানে নিবন্ধিত ফার্মাসিস্ট না থাকায় ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়ে অরাজকতা বিরাজ করছে। দেশে `ওভার দ্য কাউন্টার` আর `প্রেসক্রিপশন ড্রাগ` নিয়ে কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই, পার্থক্যও নেই। নিরাপদ, অনিরাপদ সব ওষুধই বাংলাদেশে ওভার দ্য কাউন্টার ড্রাগ।

সরেজমিনে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন, অ্যান্টাসিড, ভিটামিন, ওরাল স্যালাইন, অ্যান্টিহিস্টামিন বা কফ সিরাপের মতোই মানসিক রোগ, ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসের ওষুধসহ স্টেরয়েড, হরমোন অ্যান্টিবায়োটিক, যত ইচ্ছা ঘুমের বড়ি প্রেসক্রিপশন ছাড়াই কেনা যায়।

জনস্বাস্থ্য ও ওষুধ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, যেকোনো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন রয়েছে। রোগীর ওজন ও উচ্চতা অনুসারে সুনির্দিষ্ট রোগ নির্ণয় করে সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়ম মেনে ও নির্দিষ্ট মেয়াদে সেবন করতে হয়। কিন্তু কেউ অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের সঠিক নিয়মনীতি অনুসরণ করছেন না।

সাধারণ ঠান্ডা, হাঁচিকাশি ও ভাইরাল জ্বর থেকে শুরু করে মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে যথেচ্ছভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত বহু অ্যান্টিবায়োটিকে সংশ্লিষ্ট ব্যাকটেরিয়া বা রোগ-জীবাণুগুলোর মধ্যে ওই জীবাণুগুলোর বেলায় সহনশীলতা সৃষ্টি হয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এককালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আশীর্বাদ অ্যান্টিবায়োটিক এখন মানবকূলের জন্য অভিশাপে পরিণত হচ্ছে বলে তারা মন্তব্য করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওষুধ কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করলেও এর কার্যকর ও সঠিক ব্যবহারে কোনো নীতিমালা বা গাইডলাইন নেই। বেশিরভাগ সময়ে ওষুধের সেনসিটিভিটি পরীক্ষা না করে আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো খেয়াল খুশি মতো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ লিখে দেন চিকিৎসকরা।

২০০৯ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৎকালীন পরিচালক (সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ড. বে-নজীর আহমেদের নেতৃত্বে একটি নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও আজও তা আলোর মুখ দেখেনি।

চলতি বছরের ১০মে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সভাপতিত্বে দেশের ওষুধের বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত এক বৈঠকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মো. নুরুল হক বলেন, রোগীরা ফার্মেসিতে গেলে ব্যবস্থাপনা ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে দেয়, ফলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্রার্ড হয়ে যাচ্ছে যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরুপ। তিনি বলেন, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রি বন্ধ করা উচিত। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধকে ব্যবস্থাপত্রের আওতায় নিয়ে আসতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

report নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে ‘যত বেশি প্রেসক্রিপশন তত বেশি কমিশন- বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির এমন অনৈতিক লোভনীয় প্রস্তাবের কারণেই অ্যান্টিবায়েটিক ওষুধ বিক্রয় ও অবাধ ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্রুততম সময়ে মোটা অঙ্কের নগদ টাকা উপার্জনের লোভে গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তার থেকে শুরু করে উচ্চ ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের মধ্যে গণহারে অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন ও ওষুধ লেখার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক জাগো নিউজকে জানান, কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের নীতিনৈতিকতাকে ধুলিস্মাৎ করে দিচ্ছে। কোম্পানিভেদে নিয়মিত ওষুধ লেখার গোপন শর্তে নগদ টাকা, ফ্ল্যাট, গাড়ি, ফ্রিজ, টেলিভিশন, ঘড়ি, অলংকার, বিদেশ ভ্রমণের টিকিট, বিদেশে হোটেল ভাড়া, চেম্বার সাজিয়ে দেয়া, চেয়ার-টেবিল, কাগজ-কলম, ওষুধ ইত্যাদি উৎকোচ ও উপঢৌকন হিসেবে চিকিৎসকদের প্রদান করা হচ্ছে।

অভিযোগ সরাসরি স্বীকার না করলেও জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে অধিকাংশ ডাক্তার বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে সুবিধা নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, যেকোনো কোম্পানির ওষুধতো তাকে লিখতেই হবে, তাই সুসম্পর্কের কারণে হয়তো নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ লিখে থাকেন। তবে রোগীর প্রয়োজন ছাড়া কেউ ওষুধ লেখার কথা কেউ স্বীকার করেননি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ (ঢামেক) বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা অসুস্থ রোগীর কাছ থেকে সঠিকভাবে রোগের ইতিহাস না জেনেই গণহারে একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ লিখে দিচ্ছেন। ল্যাবরেটরি ও প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য ন্যুনতম সময়টুকুও অপেক্ষা করছেন না!

তারা রোগীর প্রেসক্রিপশনে একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিয়ে হাসপাতালের মেডিসিন স্টোর থেকে বিনামূল্যে ওষুধগুলো সংগ্রহের পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে সকল প্রকারের ওষুধের সরবরাহ না থাকায় রোগীকে  ফিরে আসতে হচ্ছে।

সরবরাহ থাকলেও সরকারি হাসপাতাল থেকে কখনই পূর্ণমেয়াদ (ফুল কোর্স) অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সরবরাহ করা হয় না। রোগীর চাহিদা অনুসারে সরবরাহ কম থাকায় ডাক্তার যে কয়দিনের লিখে দেন কখনো অর্ধেক আবার কখনো ২/১ দিনের লিখে দিয়ে পরে আবার এসে বাকি ওষুধ নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের (আঞ্চলিক পরিচালক) ড. পুণম ক্ষেত্রপাল সিং তিমুর লেস্তের (পূর্ব তিমুর) রাজধানী দিলিতে ৬৮তম বার্ষিক সম্মেলনে বক্তৃতাকালে বলেছেন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ১১ দেশের অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ওষুধ অকার্যকর হয়ে পড়ছে।

এ অবস্থাকে ‘অ্যান্টিবায়োটিক পূর্ব যুগ’-এর সঙ্গে তুলনা করেছে। একই সঙ্গে এ অবস্থাকে জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে ভুক্তভোগী দেশগুলোকে ওষুধের যথেচ্ছা ব্যবহার বন্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।

অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হওয়ার ফলে বর্তমানে আইসিইউতে সংক্রমণজনিত নিউমোনিয়া, মূত্রনালীর সংক্রমণ, ডায়রিয়া, গনোরিয়া, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগের সুচিকিৎসা দুরূহ হয়ে পড়ছে। দিনকে দিন অ্যান্টিবায়োটিক রোগ প্রতিষেধকের বদলে রোগ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব না হলে প্রতি বছর বিশ্বে এক কোটি মানুষের মৃত্যু হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯২৮ সালে স্কটল্যান্ডের জীববিজ্ঞানী স্যার আলেকজেন্ডার ফ্লেমিং প্রথম পেনিসিলিন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেন। এ ওষুধটির মাধ্যমে সিফিলিসসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগের সফল চিকিৎসা করা হতো। পরবর্তীতে বিভিন্ন চিকিৎসা বিজ্ঞানীর গবেষণায় নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের মাধ্যমে জটিল রোগব্যাধি নিরাময়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, একশ’ বছরেরও কম সময়ে এমপিসিলিন, অ্যামোক্সিসিলিন, সিপ্রোফ্লোসাসিন ও এজিথ্রোমাইসিনের গ্রুপের ওষুধগুলো আগের মতো কাজ করছে না।

২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ ও ইংল্যান্ডের নটিংহাম ইউনিভার্সিটির যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস উৎপাদিত জিম্যাক্স (এজিথ্রোমাইসিন) ও এসকেএফের জিথ্রক্স (এজিথ্রোমাইসিন)-এর শতকরা ৪০ ভাগ ওষুধ ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধক হয়ে উঠেছে।

এর আগে ২০০৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের শিক্ষকরা শাহবাগের ওষুধের মার্কেট থেকে ১৭টি ওষুধ কোম্পানির বহুল ব্যবহৃত সেফট্রিঅ্যাকজন সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেন। অত্যাধুনিক এইচপিএলসি (হাই পারফরম্যান্স লিকুইড স্পেকট্রোফটোমিটার) মেশিনে পরীক্ষা করে কমপক্ষে তিনটি কোম্পানির ওষুধ মানহীন অর্থাৎ কাঁচামাল গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ছিল না বলে প্রমাণ পান। ওই সময় এ নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়।

তখন চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন তারা দেখতে পান, বৃটিশ ফার্মাকোপিয়া (বিপি) অনুসারে ওষুধ বা ইনজেকশনে গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৯০ থেকে ১১৫ ধরা হয়। কিন্তু তারা তিনটি কোম্পানির ইনজেকশনে পেয়েছেন যথাক্রমে ৮৯ দশমিক ৮ ও ৮৯ দশমিক ২ যা বিপি আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী ও মানহীন।

অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমানসহ একাধিক ওষুধ বিশেষজ্ঞ ওই সময় গণমাধ্যমকর্মীদের অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ওষুধের অকার্যকর হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, সব ধরনের ওষুধের যথেচ্ছা ও ভুল ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক (সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দুই বছর আগেই জানিয়েছিলেন, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের যথেচ্ছা ব্যবহার বন্ধে গাইড লাইন তৈরি হচ্ছে। কিন্তু অদ্যাবধি তা আলোর মুখ দেখেনি।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি ও সাবেক বিএমএ সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হওয়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। অ্যান্টিবায়োটিকের সুষ্ঠু ব্যবহারে চিকিৎসকদের ওরিয়েন্টেশন, হাসপাতালগুলোতে প্রটোকল চালু, ওটিগুলোতে সংক্রমণমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও যেকোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক রোগীর জন্য লেখার আগে সেনসিটিভিটি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত।

# এবার এসেনশিয়াল ড্রাগসের ঠিকাদারি বাণিজ্য
# সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যের অ্যান্টিবায়োটিক এখন দুষ্প্রাপ্য
# সতর্ক থাকুন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে
# সরকারি হাসপাতালে ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক!


এমইউ/বিএ/এআরএস/এমএস