১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মধ্যে সময় পার করছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। নানা বাধা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দলটি। টানা আট বছর ক্ষমতায় না থাকার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।এদিকে ২০০৭ সালে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে বিএনপির রাজপথের কোনো আন্দােলনই আলোর মুখ দেখেনি। এ জন্য নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই দায়ি করছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। তবে এ সংকট সমাধানে বারবার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি। সর্বশেষ চূড়ান্ত আন্দােলনের ঘোষণা দিয়ে গত ৫ জানুয়ারি রাজপথে কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কর্মসূচি ঘোষণা করলেও রাজপথে দলটির নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। আন্দােলন চলাকালীন সময়ে দেশের বিভিন্নস্থানে পেট্রলবোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে সরকার ও দলটি পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দিলেও শেষ পর্যন্ত কোনঠাসা হয়ে পরে জাতীয়তাবাদী দলটি।এদিকে এক-এগারোর পর ‘সংস্কার’ প্রশ্নে বিএনপিতে যে বিভেদ তৈরি হয়েছিল তা এখনো দূর হয়নি। এর ওপর মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে দলটির নেতাকর্মীরা বেশ বেকায়দায় রয়েছেন। তবে দলের নেতা ও সমর্থক সুধীজনরা অবশ্য এখনো নিরাশ হতে নারাজ। তাদের দাবি, সরকারের উপর্যুপরি হামলা-মামলা সত্ত্বেও এখনো বিএনপি সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। একদিন না একদিন এই দেশে নির্বাচন হবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। দলীয় নেতাদের দাবি, তরুণ নেতৃত্ব সৃষ্টির পাশাপাশি সক্রিয় নেতাদের কাজে লাগিয়ে এগিয়ে গেলে বিএনপি আবারো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। প্রতিষ্ঠার পর বেশ কয়েকবার সংকটে পড়লেও এক-এগারোর পর উদ্ভূত পরিস্থিতির সূত্র ধরে সংকটের সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে বিএনপিতে। দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, বস্তুত ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীনের সরকারই বিএনপির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। ওই সময়ই বিএনপির বড় একটি অংশকে দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে কারাগারে পাঠানো হয়, সে সব মামলা এখনো চলছে। তবে ওই সময়ের সরকারের সঙ্গে ‘আপসরফা’ হলে বর্তমানের এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত। আপস হলে ২০০৯ সালের নির্বাচনে অন্তত আওয়ামী লীগের তিন-চতুর্থাংশ আসন পাওয়ার ঘটনা ঠেকানো যেত। আর এতে বিএনপিকে ধ্বংস করার এত ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ হয় তো আওয়ামী লীগ সরকার পেত না। সুযোগ হতো না পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করারও।দলীয় সূত্রে জানা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পরও বিএনপির বিশ্বাস ছিল দেশি-বিদেশি শক্তির চাপে শেষ পর্যন্ত সরকার নতি স্বীকার করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সহায়ক শক্তি হিসেবে পরিচিত তৎকালীন ভারত সরকার ওই নির্বাচন সমর্থন করে। অন্যদিকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও শুধু সাংগঠনিক শক্তির অভাবে বিএনপি ওই নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। ফলে নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন জোটের নেতাকর্মীদের ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ শুরু করে ক্ষমতাসীনরা।এভাবে এক বছর পার হওয়ায় নির্বাচনের এক বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করে আবারো সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে বিএনপি। কিন্তু সর্বশেষ এই আন্দোলনের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। উল্টো সহিংসতা সৃষ্টির অভিযোগে দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপরও ঝুলছে মামলার খড়গ। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলাতে চার্জশিট দাখিল হয়েছে। এর আগে ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হলে প্রথম দফা নেতৃত্বের সংকটে পড়ে বিএনপি। ওই পরিস্থিতিতে সাময়িক সময়ের জন্য দল ও সরকারের হাল ধরেন তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার। কিন্তু ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হলে সাত্তার ক্ষমতাচ্যুত হন এবং বিএনপি আরেক দফা সংকটের মুখে পড়ে। এছাড়া বিএনপির তৎকালীন প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা এরশাদের সঙ্গে চলে গেলে এই সংকট আরো বাড়ে। এরপর নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে দলের ওই সংকটকালে ১৯৮৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিএনপির হাল ধরেন বেগম খালেদা জিয়া।বিএনপি নেতাদের মতে, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মতোই খালেদা জিয়াও দলে এবং দলের বাইরে সমান জনপ্রিয়। এ কারণেই জিয়ার মৃত্যুর পরও খালেদার নেতৃত্বে বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয়েছে।বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবী ও শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মতে, রাজনৈতিক দলের উত্থান-পতন আছে। আওয়ামী লীগের মতো পুরনো দলেও এক সময় নেতৃত্বের অভাব দেখা গেছে। ঘটেছে নির্বাচনে ভরাডুবির মতো ঘটনাও। কিন্তু আবার তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার দাবি, বিএনপির এখনকার অবস্থা মূলত এক-এগারোর ঘটনা প্রবাহ থেকে উদ্ভূত। কিন্তু এখান থেকে অবশ্যই উত্তরণ ঘটবে। কারণ বিএনপি এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান জাগো নিউজকে বলেন, ১৯৪৮ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে দলটির ব্যাপক ভরাডুবি হয়। এরপর ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনেও বিএনপির কাছে পরাস্ত হয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু সময়ে আবার তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তেমনি বিএনপি আজ গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করছে। তৃণমূলে বিএনপি এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। জনগণের ব্যাপক সমর্থন নিয়ে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে। বর্তমান অবৈধ সরকারকে বিদায় করবে। এদিকে তরুণ নেতৃত্ব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বিএনপি আবারো ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক দলের সুসময় দুঃসময় থাকবেই। তবে রাজপথেই এই সরকারকে মোকাবেলা করা হবে। গণআন্দােলনের মুখে এই সরকারের পতন হবেই।# বিএনপির ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ# কেন্দ্রের নির্দেশে ক্ষুব্ধ বিএনপির তৃণমূল# যতো নষ্টের মূল ‘হাওয়া ভবন’এমএম/এমএএস/আরএস/এমএস
Advertisement