যতো নষ্টের মূল ‘হাওয়া ভবন’
হাওয়া ভবন। দেশের মানুষের কাছে খুব পরিচিত এই নামটি। তৎকালীন বিএনপি সরকারের আড্ডাস্থলের নাম হাওয়া ভবন। সাধারণ মানুষ যেমন ভোলেনি আলোচিত সেই হাওয়া ভবনের কথা। তেমনি ভোলেননি খোদ বিএনপির নেতাকর্মীরাও। দলটির একটি অংশ মনে করে হাওয়া ভবনই সব নষ্টের মূল! সব অর্জন ম্লান করে দিয়েছে এই হাওয়া ভবন। তাই হাওয়া ভবন সৃষ্টির বিষয়টি এখনাে ক্ষত সৃষ্টি করে বিএনপির নেতাকর্মীদের অন্তরে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর বিএনপির কয়েকজন নেতা বলেন, হাওয়া ভবনটি বিএনপির অনেক অর্জনকেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। বিএনপি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে তারুণ্যের অহংকার বলা হলেও তিনিই দলটির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন। আর সেই খেসারত এখনো দিতে হচ্ছে দলটিকে।
এদিকে বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মীও হাওয়া ভবনের বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, হাওয়া ভবন ছিল বিএনপির জন্য আত্মঘাতী। দেশের প্রতিটি স্তরে একটি মাত্র ভবনের নিয়ন্ত্রণ অনেক কিছুই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষে চাকরিরত একজন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তিনি তিন বার বিসিএস পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়েছেন। কিন্তু তারেক রহমানের হাওয়া ভবন থেকে সবুজ সংকেত না পাওয়ার কারণে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাননি।
তার দাবি এতোটা ন্যাক্কারজনকভাবে হাওয়া ভবন থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা হতো। যা কল্পনাতীত। এজন্য তারেক রহমানের শাস্তিও দাবি করেন তিনি।
এদিকে বর্তমান অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, হাওয়া ভবন নিয়ে ছাত্রদল ও যুবদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাইলে বিষয়টি অতীত, এটা নিয়ে আলোচনা না করাটাই উত্তম বলে এড়িয়ে যান তারা।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে দলীয় কার্যালয় থাকা সত্ত্বেও চেয়ারপারসনের কার্যালয় হিসেবে বনানীতে ‘হাওয়া ভবন’ ভাড়া নিয়ে দলের ভেতরে ও বাইরে কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি করেন তারেক রহমান। নির্বাচনের পরও ওই কার্যালয় খোলা রাখা হলে ‘হাওয়া ভবন’ ঘিরে বিতর্ক আরো বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে নানা দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে।
এক-এগারোর পর সমঝোতার মাধ্যমে তারেক রহমান বিদেশে চলে যাওয়ায় ওই কার্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। বিএনপির বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দলের অনেকে আড়ালে হাওয়া ভবনের ভূমিকাকে দায়ী করেন।
এক-এগারোর আগে এবং গত বছরের ৫ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত লন্ডনপ্রবাসী দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বের প্রভাব দলে অনেকটা বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে তা কিছুটা কমে গেছে। বাংলাদেশে তারেকের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
১৯৯৭ সালে বগুড়া জেলা বিএনপির সদস্য পদ নিয়ে রাজনীতিতে নাম লেখান জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। এরপর প্রথমে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এবং সর্বশেষ কাউন্সিলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের পদ লাভ করেন তিনি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তারেক রহমান হাওয়া ভবন থেকে নির্বাচনী জরিপ ও দলীয় মনোনয়ন প্রদানসহ নানামুখি সাংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনা করায় সারাদেশে তা পরিচিতি লাভ করে। নির্বাচনে জয়লাভের পর ওই চক্রটি তারেক রহমানকে সামনে রেখে হাওয়া ভবনকে প্যারালাল সরকার পরিচালনার উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিকল্প একটি কার্যালয়ে পরিণত হয় হাওয়া ভবন। তারেক রহমান বিগত সরকার ও বিএনপির ভেতর একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। হাওয়া ভবনকে প্রতিষ্ঠিত করা হয় বিকল্প ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলের কিছু তরুণ মন্ত্রী-এমপির সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় পৃথক একটি ‘মন্ত্রিসভা’।
এই ‘মন্ত্রিসভা’র সদস্যরা তারেক রহমানকে আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রচার করতে থাকেন। এভাবেই তারেক রহমানকে প্রদীপের আলোয় নিয়ে আসা হয়। মুগ্ধ তারেক রহমানও এদের পুরস্কৃত করেন একেকজনকে একেক ‘সেক্টরের’ দায়িত্ব দিয়ে।
এরমধ্যে তার মূল ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে, অর্থাৎ তিনি ‘অর্থমন্ত্রী’। দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম ও প্রশাসনে দলীয় লোক নিয়োগের দায়িত্ব দেয়া হয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি রকিবুল ইসলাম বকুলকে। সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব পায় আশিক ইসলাম।
হাওয়া ভবনের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদ দেয়া হয় জয়কে এবং বগুড়ার সন্তান নাইটকে প্রথমে তার ব্যক্তিগত সহকারী ও পরে আরেক ছাত্রদল নেতা মিয়া নুরুদ্দিন অপুকে দেয়া হয় এই পদ। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সার্বিক খোঁজ খবর তারেককে পৌঁছে দেয়ার জন্য সাবেক ছাত্রদল নেতা ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবালকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
এসব কর্মকর্তা তৎকালীন পাঁচ বছর তারেক রহমানের পাশাপাশি হাওয়া ভবনের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়। একেবারে শূন্য থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যায় অনেকে। এদের মেধা, দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে নানারকম অভিযোগ পেলেও মোটেও সেগুলো আমলে নিতেন না তারেক রহমান।
উল্টো তার প্রশ্রয়ে এরা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে। নিজেরা পরিণত হয়েছে টাকার কুমিরে। পরবর্তীতে এই হাওয়া ভবনই বিএনপির জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায়। যার খেসারত আজও দিতে হচ্ছে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল হিসেবে পরিচিত জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে।
এমএম/এমএএস/বিএ