দেশজুড়ে

সর্বনাশা মেঘনায় সর্বশান্ত পারুল

মেঘনা নদী গ্রাস করে নিয়েছে পারুল বেগমের সবকিছু। ঘর শূন্য করে সংসারের সকল আলো নিভিয়ে তার চার সন্তান চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আর সন্তান হারানোর শোক সইতে না পেরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মালয়েশিয়ায় হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন প্রবাসী পিতা ফারুক মিয়া। স্বামী-সন্তানের শোকে পাগলপ্রায় মা পারুল বেগম। এ আর্তনাদ নরসিংদীর মেঘনা নদীতে ঝড়ের কবলে পড়া নৌকাডুবিতে নিহতদের স্বজনদের। বৃহস্পতিবার নরসিংদীর মেঘনা নদীতে নৌকা ডুবির ঘটনায় নিখোঁজ সাতজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। শিশুসহ মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাতজনে। নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করতে পারলেও ডুবে যাওয়া নৌকাটি উদ্ধার করতে পারেনি বিআইডব্লিওটিএ কর্তৃপক্ষ। তবে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়েছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া অনুদান পায়নি বলে জানিয়েছেন একই পরিবারের নিহত চার সন্তানের জননী পারুল বেগম। এদিকে, একই পরিরবারের চার জনসহ সাত জন নিহতের ঘটনায় নদীপাড়ের মানুষ ও নিহতদের গ্রাম জুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। আর পরিবারগুলোতে চলছে কান্নার রোল। নিহতরা হলেন, সদর উপজেলার পাইকারচর ইউনিয়নের পাইকারচর গ্রামের ফারুক মিয়ার চার সন্তান সুমাইয়া (৮), ফয়সাল (৬), উম্মায়েনী (৪) ও বায়োজিদ (২), একই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের বগারগুদ গ্রামের নূরজাহার বেগম (৬০), ফালানি বেগম (৬০), কালিকাপুর গ্রামের ফারজানা (৮)।পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, বগারগোত অঞ্চলটি নরসিংদীর মেঘনা নদী বেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চল। নরসিংদী শহর দূরে হওয়ায় এই গ্রামের মানুষের নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের গোপালদী বাজারে যাতায়াত বেশি। গত বৃহস্পতিবার ছিল গোপালদী বাজারের সাপ্তাহিক হাট। আর হাট শেষে বিকেলে প্রায় শতাধিক লোক ইঞ্জিন চালিত নৌকা দিয়ে বগারগোত গ্রামে ফিরছিল। নৌকাটি দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বগারগোত এলাকার কাছাকাছি পৌঁছার পর উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসা প্রচন্ড ঝড়ের কবলে পড়ে। এতে নৌকাটি নদীতে তলিয়ে যায়। এ সময় অনেক যাত্রী সাতাঁর কেটে নদীর পাড়ে উঠতে স্বক্ষম হলেও নিখোঁজ হয় ৭ যাত্রী। পরে স্থানীয়রা রাতে বায়োজিদ নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে। শুক্রবার সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিআইডব্লিওটিএ’র পাঁচ সদস্যের ডুবুরি দল উদ্ধার অভিযান শুরু করে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দুর্ঘটনা কবলিত নৌকাটিকে সনাক্ত করে। এ সময় নৌকাটির ভেতর থেকে নিখোঁজ চার শিশুসহ একে একে ছয় জনের মরদেহ উদ্ধার করে। তবে ঘটনাস্থলে তাদের সঙ্গে আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় ডুবে যাওয়া নৌকাটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এদিকে, জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়েছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া অনুদান পায়নি বলে জানিয়েছেন একই পরিবারের নিহত চার সন্তানের জননী পারুল বেগম।এ ব্যাপারে স্থানীয় চেয়ারম্যান মো. হারিছ মিয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে নিহত পরিবারের প্রত্যেককে নগদ পাঁচ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দেয়া হয়েছে।দুর্ঘটনাস্থলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডুবুরীরা মেঘনা নদীর তলদেশে নৌকাটির অবস্থান শনাক্ত করার পরই একের পর এক মরদেহ উদ্ধার করছে। এ সময় নদীর পাড়ে অপেক্ষামান স্বজনরা প্রিয়জনের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এতে করে গোটা এলাকায় এক হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরে আর কোনো নিখোঁজের দাবি না থাকায় বেলা ১২টায় উদ্ধার কাজের সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।দুর্ঘটনা কবলিত নৌকার যাত্রী বগারগোত গ্রামের কৃষক আমির মিয়া জানায়, গোপালদী বাজারে হাট শেষে বাড়িতে ফিরছিলাম। ওই সময় আকাশ কাল হলেও গ্রামের কাছাকাছি চলে আসায় মাঝি নৌকা থামায়নি। কিন্তু ঘাটে ভিড়ার আগেই হঠাৎ করে আসা বাতাসে নৌকা হেলে ডুবে যায়। এ সময় পাশেই হযরত আলী মাঝির একটি নৌকা ছিল। বড়দের কেউ কেউ সাঁতার কেটে তীরে আবার কেউ কেউ হযরত আলীর  নৌকায় উঠে। এ সময় শিশু ও বৃদ্ধরা ডুবে যায়।বেঁচে যাওয়া চার সন্তানের জননী পারুল বেগম জানান, প্রচন্ড বেগে যখন ঝড় ধেয়ে আসছিল তখন নৌকার যাত্রীরা নৌকাটিকে তীরে ভিড়ানোর জন্য মাঝিকে অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু মাঝি তা কর্ণপাত করেননি। তখন সবাই আল্লাহর কাছে দোয়া করছিল। এ সময় দমকা হাওয়া নৌকাটি দুলছিল তখন নৌকার ৩ মাঝি নৌকা থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়ে যায়। এ সময় সঙ্গে সঙ্গে নৌকাটি নদীতে তলিয়ে যায়। সবাই সাতঁরিয়ে তীরে উঠতে পারলেও শিশুরা উঠতে পারিনি। আমার বুকের মানিকরা আমার ঘর শূন্য করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া নারায়ণগঞ্জ বিআইডব্লিওটিএ’র উপ-পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন, খবর পেয়ে শুক্রবার সকালে তিন জন ডুবুরিসহ পাঁচ সদস্যের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে। এ সময় প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যের ভিক্তিতে একাধিক স্থানে জাল টেনে দুর্ঘটনা কবলিত নৌকাটিকে সনাক্ত করা হয়। পরে ওই নৌকা থেকে ডুবুরিরা ছয় জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। সদর উপজেলার ভঙ্গারচর নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন বলেন, নিহতের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। দুর্ঘটনা কবলিত নৌকার মাঝি পলাতক রয়েছে। আর এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।# মেঘনায় নৌকাডুবি : উদ্ধার ৭ মরদেহসঞ্জিত সাহা/এআরএ/বিএ/পিআর

Advertisement