স্বপ্ন থেকেই সফল উদ্যোক্তা হাসিনা মুক্তা
হাসিনা মুক্তা। একজন সফল নারী উদ্যোক্তার নাম। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল নতুন কিছু করার। সেই স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাস থেকেই পথ চলা। মাঝপথে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সফল উদ্যোক্তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে হাসিনা মুক্তার।
স্কুলজীবন থেকেই শৈল্পিক সব সৃষ্টি আর নিজের পোশাক নিজে তৈরি করে সবার নজর কাড়েন হাসিনা। একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন তখন থেকেই। সেই স্বপ্ন ও আত্মবিশ্বাস পুঁজি করেই ২০১৪ সালের দেশের সবচেয়ে সফল যুব আত্মকর্মীর পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এছাড়াও নারী উন্নয়নে কাজ করাসহ দক্ষতা ও সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছেন নানা সম্মাননা।
জীবন-সংসারে যুদ্ধ করে ভাগ্যের চাকা ঘোরানো অদম্য এই নারীর প্রাথমিকভাবে শিক্ষাটা মায়ের কাছ থেকেই। এইচএসসি পাস করার পর ১৯৯৮ সালে যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে পোশাক তৈরি ও ব্লক-বাটিকের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে ১৯৯৯ সালে বিয়ে হয়। পরে শ্বশুর ও স্বামীর উৎসাহে তার স্বপ্নগুলো আরও গভীর ও পূর্ণতা পেতে থাকে। তখন স্বামীর সহযোগিতায় নিজের চারটি সেলাই মেশিন নিয়ে শুরু হয় যাত্রা। তখন বিভিন্ন ট্রেডে যুব উন্নয়ন অধিদফতরসহ আরও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
কাজের পাশাপাশি একাডেমিক শিক্ষায় থেমে থাকেননি মুক্তা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করেন। তখন ভালোই চলছিল স্বামীর সংসার আর ছোট ব্যবসা। কিন্তু জীবনের বড় ধাক্কাটা আছে ২০০৯ সালে স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে। দুই মেয়ে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন হাসিনা। চাকরির জন্য পরিবার থেকে চাপ। এসএসসি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস হওয়া সত্ত্বেও চাকরি খুঁজে অন্যের দ্বারে দ্বারে না ঘুরে নিজেই কিছু করার চিন্তা করেন। সমাজের বিরূপ মন্তব্য আর নানা প্রতিবন্ধকতার পরও অনেকটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু করেন হ্যান্ডি ক্রাফটের (হস্তশিল্প) কাজ।
এর পর শুরু হয় নতুন পথ চলা। নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেন হাসিনা। শ্বশুরের দেয়া একটি ফ্ল্যাটে প্রতিষ্ঠা করেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। `নতুনত্ব বুটিকস ও হস্তশিল্প` নামে পণ্য উৎপাদন, বিক্রয় এবং বুটিকস, হস্তশিল্প ট্রেনিং সেন্টার চালু করেন।
চট, বাঁশ ও কনফ্লায়ারসহ বিভিন্ন কাঁচামাল দিয়ে তৈরি হস্তশিল্পর গৃহসজ্জার ননা সামগ্রী তৈরি করেন। বিভিন্ন সেলাই ও নকশা করে নানা ধরনের সৌখিন পণ্য যেমন- ব্যাগ, ম্যাট, কলমদানি, পাপোশ ইত্যাদি এছাড়াও ব্লক-বাটিকসহ নকশীকাঁথা, অ্যাববোটারের ননা ডিজাইন, শাড়ি, বিছানার চাদর, কুশনকভার ইত্যাদি তৈরি করেন মুক্তা।
৫০ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করা হাসিনা মুক্তার বর্তমানে মূলধন দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ টাকায়। আর মাসিক আয় এক লাখ টাকা। স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে ৬০ জনেরও বেশি কর্মী কর্মরত রয়েছেন তার প্রতিষ্ঠানে। এছাড়াও ঢাকার বাইরে রাজশাহী, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রামীণ নারীদের দিয়ে নকশীকাঁথাসহ বিভিন্ন হস্তশিল্পের কাজ করান।
হাসিনা এ পর্যন্ত এক হাজারের অধিক নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন। এছাড়াও সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে পিছিয়ে পড়া বিধবা ও দুস্থ নারীদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছেন তিনি।
হাসিনা মুক্তা বলেন, আমার দুই মেয়ে ভিকারুনি্নসা নূন স্কুলে পড়ে। সেখানে অভিভাবক আছেন, যারা বাচ্চার স্কুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন। আমি সেখানকার অনেক অভিভাবকদের ফ্রি প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের বেকার সময়টা কাজে লাগিয়েছি। তারা যখন সময় পান হ্যান্ডি ক্রাফটের কাজ করেন। এতে একদিকে তাদের সময় অপচয় হচ্ছে না। অন্যদিকে বাড়তি টাকাও আয় হচ্ছে।
নারী হওয়ার কারণে পরিচিতির অভাবে পণ্যের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না অভিযোগ করে হাসিনা মুক্তা বলেন, আমার কাছ থেকে পণ্য নিয়ে বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করছেন অনেক ব্যবসায়ী। আবার অনেকে বিদেশেও রফতানি করছে। কিন্তু অক্লান্ত প্ররিশ্রমের পর আমরা অনেক ক্ষেত্রে কর্মীদের ন্যায্য মজুরিও দিতে পারছি না। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা নানা সহযোগিতা দিচ্ছে উদ্যোক্তাদের। কিন্তু আমরা কিছুই পাচ্ছি না। এজন্য সরকারের উচিত যারা প্রকৃত উদ্যোক্তা তাদের সহযোগিতা করা। পাশাপাশি আমাদের তৈরি হস্তশিল্প দেশ বিদেশের ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের পরিচয় করিয়ে দেয়া।
ছোট বা মাঝারি যেকোনো শিল্পেই নারী উদ্যোক্তাদের মুখোমুখি হতে হয় নানা ধরনের প্রতিকূলতার। মূলধনের সঙ্কট থেকে শুরু করে পারিবারিক বাধাসহ নানা সমস্যা তো রয়েছেই। এজন্য কিন্তু সব কিছু পিছনের ফেলে এগিয়ে আসার আহ্বান মুক্তার।
সফল যুব আত্মকর্মী হাসিনা মুক্তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নারীদের দক্ষ উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা। সেজন্য সরকারসহ সমাজের নেতৃত্বস্থানে থাকা ব্যক্তিদের সহযোগিতা চান তিনি।
এসআই/বিএ