সীমানাপাড়ার শিশু শিক্ষার্থীদের স্বপ্নপূরণ


প্রকাশিত: ০২:০০ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫

অবশেষে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে দীঘিনালার সীমানাপাড়ার শিশু শিক্ষার্থীদের। প্রায় দুইশ’ বছর পর একটি বিদ্যালয় পেল দুর্গম পাহাড়ি জনপদ সীমানাপাড়ার মানুষ। ত্রিশ লাখ টাকা ব্যয়ে মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন হোসনে আরা মনজুর বিদ্যা নিকেতন নির্মাণ করেছে।

শনিবার বিকেলে খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ফলক উম্মোচনের মাধ্যমে বিদ্যালয়টির উদ্বোধন করেন।  সাবেক মেয়র মনজুর আলম ও তার স্ত্রী হোসনে আরা বেগমের নামানুসারে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয়েছে। একশ ফুট দৈর্ঘ্য ও পঁচিশ ফুট প্রস্থের তিন তলা ফাউন্ডেশনের উপর আপাতত টিনের ছাউনির ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পাশে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টি নন্দন শহীদ মিনার ও খেলার মাঠ।

বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৬ জন শিক্ষক। এছাড়া শিক্ষার্থীদেরকে পোষাকের পাশাপাশি শীতের সুয়েটার এবং  প্রতিজনের জন্য কম্বলও দেয়া হয়েছে। নতুন বিদ্যালয় নুতন পোষাক আর সাথে নতুন শীতের কাপড় পেয়ে আনন্দে অনেকটা আত্মহারা এ দুর্গম অঞ্চলের ক্ষুধে শিক্ষার্থী।

দীঘিনালার নয়মাইল গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র রিটন ত্রিপুরা জানান, তার বাড়ি তৈদুছড়া এলাকায়। বিদ্যালয় থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে। সে প্রতিদিন ভোর ৫ টায় ঘর থেকে বের হতো । আর বিদ্যালয়ে পৌঁছাত সকাল ৮ টায়। আবার বিকাল ৪ টায় বিদ্যালয় ছুটির পর বাড়িতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা ৭ টায় বেজে যেত। প্রতিদিন এভাবেই ঊঁচুনিচু পাহাড়ি পথে পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসত । সকালে ঘর থেকে খাবার খেয়ে আবার রাতে বাড়িতে ফিরে খাবার খেতে হতো তাদের।

DIGHINALA
রিটন ত্রিপুরার মত ২০ জন শিশু শিক্ষার্থী এভাবেই পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসত প্রতিদিন। দীঘিনালার সীমানাপাড়া গ্রামটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা কষ্ট করে পড়াশুনা করত। আবার অনেক শিশু বিদ্যালয় দূরে হওয়ায় পড়াশুনাই করতই না।
 
সীমানাপাড়া গ্রামের  পুরোহিত পরানধন ত্রিপুরা (৫৫), ধনরঞ্জন ত্রিপুরা (৬০), পিলানী ত্রিপুরা, যদু মোহন ত্রিপুরা, নিরণ বালা ত্রিপুরা ও সুমন্তি ত্রিপুরার  সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, সীমানাপাড়ায় ১০০টির ও বেশি পরিবার রয়েছে। ৪০ পরিবার খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার আর ৪০ পরিবার দীঘিনালা উপজেলার। তৈদুছড়া এলাকায় রয়েছে ৭০ পরিবার।

তারা জানান, দুই গ্রামের দেড়শ পরিবারের শিশুদের পড়াশুনার জন্য কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না। গ্রামের কয়েকজন শিশু ব্র্যাক স্কুলে ও কিছু কিছু শিশু নয় মাইল গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অনেক দূরের বিদ্যালয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। বিদ্যালয় অনেক দূরে হওয়ায় ঝড় বৃষ্টি হলে শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে পারতো না।

রহি রঞ্জন ত্রিপুরা জানান, গ্রামে বিদ্যালয় না থাকায় তার দুই মেয়ে একজন দ্বিতীয় শ্রেণি ও আরেকজন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তাদেরকে খাগড়াছড়ি সদরে ভাড়া বাসায় রেখে খাগড়াপুর সরকারি প্রাথিমক বিদ্যালয়ে পড়া লেখা করাচ্ছিলেন। গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুবই প্রয়োজন ছিল। তাদের গ্রামের ৬০ জন শিশু শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। গ্রামে বিদ্যালয় নির্মাণ হওয়ায় তারা খুবই আনন্দিত।

এদিকে শনিবার বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় নতুন এ বিদ্যালয়টি। নতুন বিদ্যালয়ের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঢলনামে মানুষের। সকাল থেকে লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে দুর্গম এ পাহড়ি জনপদটি।

মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের পরিচালক  সীতাকুন্ডের সংসদ সদস্য মো. দিদারুল আলমের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে  প্রধান অতিরি বক্তব্যে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপূরা বলেন, সাবেক মেয়র মনজুর আলম সীমানা পাড়ার জন্য দেবতা হয়ে আবির্ভাব হয়েছেন।  পশ্চাদপদ সীমানা পাড়ার মানুষের জন্য তাদের এ অবদান খাগড়াছড়িবাসী আজীবন মনে রাখবে।

তিনি বলেন,  সমাজ সেবায় কোনো জাতি ধর্ম বর্ণ থাকা উচিত নয়। মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনই তার প্রমাণ। স্কুল হয়েছে বড় কথা নয় এটাকে ধরে রাখতে হবে। স্কুলের আগামী দিনের সফলতা নির্ভর করবে এলাকাবাসীর উপর।
 
সাবেক মেয়র মো. মনজুর আলম তার বক্তব্যে বলেন, আমি মানুষের জন্য কাজ করি। সমাজ সেবা করে তৃপ্তি পাই। মানুষের সেবা  করাই প্রকৃত রাজনীতি। আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নাই। বঞ্চিত মানুষের সেবা করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই।

এসময় বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক মেয়র পত্নী হোসনে আরা বেগম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) মো. আবদুর রহমান, দীঘিনালা জোন অধিনায়ক লে. কর্নেল মহসীন রেজা, দীঘিনালা উপজেলা চেয়ারম্যান নব কমল চাকমা, দীঘিনালা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সামশুল আলম, মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদ সভাপতি নিজামুল আলম, মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মো. সারোয়ার আলম, মো. সাইফুল আলম, মো. কাউসার রাব্বি, কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার নিপুর চৌধুরী।

মোস্তফা হাকিম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রিন্সিপাল মো. আলমগীর, ভাইস প্রিন্সিপাল বাদশা আলম, কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার বিপুল জ্যোতি চাকমা,উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি হাজি মো. কাসেম, দীঘিনালা থানার অফিসার ইনচার্জ মিজানুর রহমান, প্রেসক্লাব সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম রাজু, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ালীগের দফতর সম্পাদক মহিউদ্দিন বাবলু, সদস্য মো. ইদ্রিস,  মাহবুবুল আলম মেম্বার, সত্যজিৎ বড়ূয়া, মো. জসিম উদ্দিন, হতেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, কানকানন্দ ত্রিপুরা, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ধীনা ত্রিপুরা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

আবু মুছা জীবন/এসকেডি/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।