নির্যাতিত নারী এবং সমাজের দায়


প্রকাশিত: ০৮:০৭ এএম, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেব।’ তারপর বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন-
‘সাম্যের গান গাই,
আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোন ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এল পাপ-তাপ, বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’
নেপোলিয়নের জাতি গড়ার কারিগর সেই নারী আর নজরুলের সাম্যবাদের সেই নারী আজ শুধু ইতিহাসের পাতায়, কবিতার খাতায় সোনালি অক্ষরেই শোভা পাচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতার রূপ দেখে আমাদের তা-ই মনে হয়।

এখন টেলিভিশন কিংবা পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে নারীর প্রতি সহিংসতার বিভৎস রূপ। প্রতিদিন ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, অ্যাসিড নিক্ষেপ, শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং সংবাদের নিয়মিত বিষয় হিসেবে আমরা দেখি। যেন কোনো না কোনোভাবে নারীকে কষ্ট দেয়া, নির্যাতন করা, মানসিকভাবে ভেঙে দেয়া, শারীরিকভাবে নিঃশেষ করাই পুরুষের কাজ।

আজ এই সভ্য জগতে বাস করেও আমরা আদিমতাকে বজায় রেখে নারীর প্রতি হিংস্রতা চালিয়ে যাই। নারীর প্রতি অবিচার, অনধিকার, অস্বীকার, মারপিট, প্রতিটি কাজে দোষ ধরা ইত্যাদিকে আমরা ছোট করেই দেখি কিংবা কেউ কেউ দেখিই না। এছাড়া স্ত্রী নির্যাতনের বিষয়টিকে আমাদের অন্ধ সমাজ স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ধরে নেয়।

এসবের পাশাপাশি আবার যৌতুক প্রথাকে প্রতিষ্ঠিত করছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল। যা নির্যাতনের মাত্রা আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দেয়। যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজে এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে, একটু ব্যতিক্রম হলেই জীবন দিতে হচ্ছে নারীদের। তাদের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়া, না খাইয়ে রাখা, দীর্ঘদিন বাবার বাড়িতে রাখা, মারধর করে পঙ্গু করে দেয়া বা নির্যাতনের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।

নারীর প্রতি নৃশংসতার অন্যতম কারণ হতে পারে ক্ষমতার দাপট, প্রশাসনের উদাসীনতা, স্বাভাবিক বিষয় ভেবে প্রশাসনকে না জানানো, নারীদের চুপ করে থাকা, ভাগ্য বলে মেনে নেয়া প্রভৃতি। এমনকী নির্যাতিত নারীর এক তৃতীয়াংশ স্বামীর ভয়ে বা স্বামী সম্মতি না দেয়ায় চিকিৎসকের কাছেও যেতে পারেন না!

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) নারী নির্যাতন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি জরিপ চালিয়েছে। বিবিএস বলছে, দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই কোনো না কোনো সময়ে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ৬৫ শতাংশ বলেছেন, তারা স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেছেন। ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার, ৮২ শতাংশ মানসিক এবং ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

তবে শহরের তুলনায় গ্রামে নারী নির্যাতনের হার বেশি। আবার বয়স অনুযায়ী নির্যাতনের হার পাল্টাতে থাকে।
যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে অবিবাহিত নারীরা বেশি ঝুঁকির মাঝে থাকলেও মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিবাহিত নারীরা শিকার বেশি হন। বিবিএসের জরিপে ৭ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, নির্যাতনের কারণে তারা আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন। বিবাহিত এসব নারীর ৫৬ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগেই।

সূত্রমতে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নারী নির্যাতনের বা নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩১ হাজার ৬৬৯টি। এরমধ্যে ২০১০ সালে নারীর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৫৫৭০টি, ২০১১ সালে ৬৬১৬টি, ২০১২ সালে ৫৬১৬টি, ২০১৩ সালে ৪৭৭৭টি, ২০১৪ সালে ৪৬৫৪টি এবং ২০১৫ সালে ৪৪৩৬টি।

নারী অপহরণের বিষয়ে বলতে হয়, ২০১০-২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার নারীকে অপহরণ করা হয়। অন্যদিকে নারী ও শিশু পাচার, নারীকে পতিতালয়ে বিক্রি, যৌতুকের কারণে হত্যা, বাল্যবিবাহ ও পুলিশের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে হাজার তিনেকের উপরে। এ সময়ে পতিতালয়ে বিক্রির সংখ্যা প্রায় ৫০০।

নারীর প্রতি সংঘটিত অপরাধকে খাটো করে দেখা, আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া, সাক্ষীকে ভয় দেখানো, প্রভাবশালীদের অর্থের প্রলোভন ও নির্যাতিত পরিবার ঘটনা চেপে যাওয়ার চেষ্টার কারণেই নারী নির্যাতন রোধ সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

পরিশেষে বলতে চাই, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। আমরা সবাই হয়তো নেপোলিয়ন বা নজরুলের মত করে ভাবতে পারি না। তবে আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা, চিন্তাধারা বদলাতে পারি। আর নারীদের শুধু মাদার তেরেসা হলেই হবে না। তাদের প্রতিবাদী হতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। তখন আর কেউ সাহস করবে না তাদের প্রতি সহিংস হতে।

লেখক : শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।