নিজেকে একজন পারফর্মার হিসেবে শো করতে হবে, নারী হিসেবে না

আলেয়া আক্তার বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে (আরএমজি) মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় (এইচআর) কাজ করা একজন সফল নারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে পুষ্টিবিদ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও প্রায় দুই যুগ ধরে কাজ করেছেন আরএমজি সেক্টরের মানবসম্পদ বিভাগে। কোরীয় ও জাপানি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পাশাপাশি অ্যাপেক্স, হা-মীম গ্রুপেও মানবসম্পদ বিভাগে উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে দ্য সাসটেইনেবিলিটি নেক্সাস লিমিটেডে পরিচালকের (ইথিক্যাল সোর্সিং অ্যান্ড সিএসআর) দায়িত্ব পালন করছেন আলেয়া।
নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কর্মজীবনে সফলতা পাওয়া এই নারী ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উপলক্ষ্যে সম্প্রতি কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। নিজের কর্মজীবনের নানা চ্যালেঞ্জ তুলে ধরার পাশাপাশি নারীরা কিভাবে কর্মজীবনে সফলতা পেতে পারেন, দিয়েছেন সেই পরামর্শ।
আলেয়া আক্তারের মতে, কর্মজীবনে নারীদের নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। উপরে উঠতে হলে পুরুষের তুলনায় নারীদের অনেক বেশি পারফর্ম করতে হয়। যারা কর্মজীবনে নারী হিসেবে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেন, তারা কর্মক্ষেত্রে বেশি কটু কথা শোনেন। কর্মজীবনে সফলতা পেতে হলে এবং উপরে উঠতে হলে নিজেকে একজন পারফর্মার হিসেবে শো করতে হবে, নারী হিসেবে না। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাঈদ শিপন।
জাগো নিউজ: কীভাবে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন?
আলেয়া আক্তার: ২০০২ সালে পেশাজীবনে পদার্পণ করি। পড়াশোনা শেষ করার পর প্রথম পেশাজীবন কোথা থেকে শুরু হবে, এরকম বিশেষ কোনো দিক ছিল না। এমএসসি শেষ করার পর সিভি ড্রপ করলে চট্টগ্রামের ইপিজেডের কোরীয় প্রতিষ্ঠান ইয়াং ওয়ান থেকে আমার ইন্টারভিউয়ের ডাক পড়ে। তখনই আমার চ্যালেঞ্জ শুরু হয়। আমি ঢাকায় ছিলাম, আমার এক বছর বয়সের ছোট বেবি। অনেকেই বলেছিল ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু আমি তখন ওটাকে একটা উদ্যম হিসেবে নেই এবং চট্টগ্রামে গিয়ে ইন্টারভিউ দেই। প্রতিষ্ঠানটি আমার ভালো লেগে যায়। আমার ইন্টারভিউ ভালো হয় এবং তারা আমাকে চাকরির অফার করে। আমার স্বামী, শাশুড়ির উৎসাহ ছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতেই আমি চাকরিতে প্রবেশ করি।
আরও পড়ুন
জাগো নিউজ: শুরুতেই কি এইচআর বিভাগে কাজ শুরু করেন?
আলেয়া আক্তার: আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশনে লেখাপড়া করেছি। শুরুতে ইয়াং ওয়ানে নিউট্রিশনিস্ট (পুষ্টিবিদ) হিসেবে যোগ দেই। ইয়াং ওয়ানে যোগ দেওয়ার পর দেখলাম হাজার হাজার মানুষ। বিশেষ করে অনেক মেয়ে। যারা শ্রমিক লেভেলে ছিলো তাদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই ছিল মেয়ে। ওখানে কাজ করতে করতে আমার মধ্যে একটা আগ্রহ জন্মে, আমি হয়তো মানুষ ব্যবস্থাপনায় ভালো করতে পারবো। মানুষদের নিয়ে কাজ করতে আমার ভালো লাগে। যদিও ওই সময় এইচআরকে (হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট) ওইভাবে মূল্যায়ন করা হতো না। দুই বছর কাজ করার পর আমি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিজের আগ্রহ থেকেই নিই। তারপর আমি এইচআর নিয়ে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করি। কিন্তু তখন আমার এইচআর নিয়ে পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো না।
২০০৪ সালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ট্রান্সফার হয়ে আসি। ঢাকায় আসার পর ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে এইচআরে এমবিএ করি, বিএমআই থেকে এইচআরে পিজিডি সম্পন্ন করি। লেখাপড়া চলাকালেই আমি আবেদন করি, আমি এইচআর বিভাগে যেতে চাই। ম্যানেজমেন্ট আমার আগ্রহ বিবেচনায় নিয়ে এইচআর বিভাগে শিফট করে। সেই তখন থেকেই এইচআর নিয়ে কাজ শুরু হয়।
প্রায় নয় বছরের মতো ইয়াং ওয়ানে ছিলাম। ইয়াং ওয়ান থেকে আমি জাপানি প্রতিষ্ঠান ইয়াগি বাংলাদেশে জয়েন করি এইচআর হেড হিসেবে। তারপর বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেছি। আমি ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের একটি ইউনিটের এইচআর হেড ছিলাম। এরপর অ্যাপেক্স হোল্ডিংসের অ্যাপেক্স ফ্যাশন ওয়্যারে ফুল ইউনিটের জিএম এইচআর অ্যাডমিন ছিলাম প্রায় আড়াই বছরের মতো। তারপর আমি আসি হা-মীম গ্রুপে। হা-মীম গ্রুপের কর্পোরেট অফিসের কর্পোরেট এইচআর জিএম হিসেবে ছিলাম প্রায় দুই বছর। হা-মীম গ্রুপের পর দেশ গ্রুপ অব কোম্পানিজের সিএইচআরও (চিফ হিউম্যান রিসোর্সেস অফিসার) হিসেবে কাজ করেছি।
জাগো নিউজ: কর্মক্ষেত্রে নারীরা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন?
আলেয়া আক্তার: নারীদের জন্য চালেঞ্জ তখনও ছিল, এখনো আছে। আমি শুরুতেই খুব ভালো একটি প্রতিষ্ঠানে যোগদান করি। আমি সবসময় নিজেকে একজন এমপ্লয়ি হিসেবে বিবেচনা করেছি। মেয়ে হিসেবে আমি কখনো অতিরিক্ত সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করিনি। যারা মেয়ে হিসেবে অতিরিক্ত সুবিধা পেতে চায় বা একটু সুযোগ-সুবিধা চায় বা একটু স্পেস চায় নিজের ফ্যামেলিকে সময় দেওয়ার জন্য, দেখা যায় তারা বেশি কটু কথার শিকার হন।
আমিও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই কম-বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি। তবে নিজের মধ্যে মোটিভেশন রেখেছি যে, আমাকে থেমে গেলে চলবে না। তাহলে তো আমি হেরে গেলাম। ওইভাবে যুদ্ধ করে করে এই পর্যন্ত আসা। পথ একেবারে খুব কোমল ছিল, বিষয়টি তা নয়। প্রতিটি জায়গায় স্ট্রাগল করেছি। অনেক পলিটিক্সের সম্মুখীন হয়েছি। চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিয়েই এই পর্যন্ত এসেছি আলহামদুলিল্লাহ। অনেক মেয়েদের শুরুতেই পথটা ভেঙে যায়। আমি যে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছি, হয়তো ওই পরিস্থিতিতে অনেকের মনটা ভেঙে যায়, ওখান থেকে আর আগানোর সাহস করে না, পিছিয়ে যায়। অনেক মেয়ের সঙ্গে এমনটা হতো এবং এখনো হয়।
জাগো নিউজ: কর্মজীবন শুরু করতে যাওয়া নারীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
আলেয়া আক্তার: আমার পরামর্শ থাকবে- নিজেকে একজন পারফর্মার হিসেবে শো করা, নারী হিসেবে না। আমার পারফর্মেন্স- আমি একজন এমপ্লয়ি। নারী হিসেবে আমাকে পরিচিত করা না। এমপ্লয়ি হিসেবে নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে নিজের কাজ করতে হবে। নিজের উন্নতির দিকে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। আর একটা কথা আরও বেশি সত্য, মেয়েরা যখন নিজের কাজ দিয়ে উপরে উঠতে চায় তখন তাদেরকে পুরুষের থেকে অনেক বেশি পারফর্ম করতে হয়। তখনই ম্যানেজমেন্টের আত্মবিশ্বাস জন্মায়, সে পারবে। সুতরাং নারীদের নিজের পারফরম্যান্সের প্রতি অনেক বেশি সচেতন ও আপসহীন হতে হবে। সেই সঙ্গে নিজেকে সব সময় আপডেট রাখতে হবে।
জাগো নিউজ: আপনি যে সময় কর্মজীবন শুরু করেন সে সময় নারীদের জন্য কর্মপরিবেশ কেমন ছিল, এখন পরিবেশ কেমন?
আলেয়া আক্তার: আরএমজি সেক্টরে ওপরের পদগুলোতে ছেলেরাই হিমশিম খায়। তো মেয়েরা আগে চিন্তাই করতো না যে আরএমজি সেক্টরে আমরা উপরে যেতে পারি। ম্যানেজমেন্টের মধ্যেও ধারণা ছিল না যে নারীরা ওপরের পদে থেকে লিড দিতে পারে। এখন এটায় পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেক মেয়ে সাহস করছে। ম্যানেজমেন্টও এখন মনে করছে নারীদের লিডারশিপে আসতে হবে। যে কারণে এখন অপরচুনিটি বেড়ে গেছে। এটা সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। আমার সময়টাতে মেয়েদের উৎসাহ দেওয়া হতো না, ওটা খুবই লিমিটেড ছিল। পুরোপুরি নিজের একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে নামতে হতো। আবার ফ্যামিলি সাপোর্টও ছিলো না। গার্মেন্টস বা আরএমজি নিয়ে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা ছিল। এখন কিন্তু এটা নেই। এখন সবাই বুঝে গেছে জব মার্কেটে আরএমজি একটা গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর।
অবশ্য সবাই উৎসাহ দিলেও এখনো নারীদের জন্য বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজের মনোভাব চলে গেছে, এটা কিন্তু বলা যায় না। এখন কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ হয়তো বেড়েছে, কিন্তু লিডারশিপে নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। নারীবান্ধব কর্মপরিবেশের জন্য প্রতিষ্ঠানের মালিকদের আরও অনেক বেশি আন্তরিক হতে হবে। তাহলে সামনে আরও অনেক বেশি নারী লিডারশিপে যেতে পরবেন।
এমএএস/এএমএ/এমএস