পথেই জীবিকা-জীবন, পথেই নিত্য নির্যাতন-যৌন নিপীড়ন

জাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম জাহাঙ্গীর আলম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ২৭ আগস্ট ২০২৩

পথই আবাস। পথই নিবাস। পথেই তাদের বসত। চোখের ঘুম তাদের ঘুম নয়, ঘুম রাতের গভীরতা। পথের সেই ‘ঘুমঘরের’ জন্যও করতে হয় লড়াই। প্রখর রোদের তীব্র ছটা কিংবা প্রহরীর ছুড়ে মারা পানিতে ভাঙে সে ঘুম। চোখ মেললেই পেটের চিন্তা। সেই আবার পথে ছোটা, নয়তো ড্যান্ডিতে বুঁদ হয়ে সামনে ঝোলানো হলুদ কলাকে স্বপ্ন ভেবে সুরিয়ালিস্টিক জগতে বিচরণ। সেটাই ক্ষুধার নিবারণ। শহরের কোটি মানুষের উচ্ছিষ্ট কিংবা কাগজের ঠোঙার মতো ব্যবহার হয়ে মেলে জীবিকার সন্ধান। কেউ অজান্তেই দিচ্ছে আঁধারে ডুব। কখনো সেই পথেই পথের মানুষ করে সম্ভ্রমহানি। তবু সেই পথই তাদের ‘মা-বাবা’। তারা পথশিশু।

কেন শিশুরা পথে আবাস গড়ে? কে তাদের মা, কে বাবা? কোথায় জন্ম, কোথায় তাদের ভিটে? এসব অনেক প্রশ্নের উত্তরই জানে না পথশিশুরা। তবু চলছে তাদের জীবন। কেউ হাঁটছে চুরি-ছিনতাই-মাদক বেচাকেনাসহ নানা অপরাধের পথে, কেউ বা মাদকের নেশায় দিচ্ছে ডুব। চরম দারিদ্র্য, অপুষ্টি, রোগ, নিরক্ষরতা ও সহিংসতাসহ নানা বঞ্চনার শিকার এসব শিশু। সমাজের কোনো দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ আবার এসব শিশুকে ব্যবহার করে মাদক বেচাকেনা কিংবা বোমা-ককটেল ফোটানোর মতো অনৈতিক কাজে। তখন সেটাও অবুঝ এসব শিশুর কাছে হয়ে যায় জীবিকা।

ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ শীর্ষক জরিপ করে পথশিশুদের নিয়ে। ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ও দেশের আটটি বিভাগের হটস্পটে (যেসব স্থানে পথশিশুর আনাগোনা বেশি) পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী সাত হাজার দুইশ শিশুর কাছে সরাসরি গিয়ে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে জরিপ প্রতিবেদনটি তৈরি। জরিপে রাস্তা-ঘাটে বসবাসকারী শিশুদের মোট সংখ্যা না থাকলেও ইউনিসেফ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক হতে পারে।

২০২২ সালে ঢাকা ও বরিশালের ৪শ পথশিশুর ওপর চালানো জরিপের তথ্য প্রকাশ করে গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি। জরিপে উঠে এসেছে, দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে পথশিশুর সংখ্যা। পথশিশুদের ওপর সহিংসতার চিত্র ভয়াবহ। ৭৯ শতাংশ পথশিশু জীবনের কোনো একপর্যায়ে মানসিক, শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। পিতৃপরিচয় না থাকায় ৭৬ শতাংশ পথশিশুকে মানসিক নিপীড়ন, হেনস্তা, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল শোনাসহ বিভিন্ন ধরনের কটূক্তির শিকার হতে হয়। তাছাড়া শুধু শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৬২ শতাংশ পথশিশু।

দৈনিক গড়ে ১০ ঘণ্টা ভিক্ষা করে একটি পথশিশু। ৩৫ শতাংশ শিশু ভিক্ষা করার কথা স্বীকার করেছে। ৪২ শতাংশ শিশু রাস্তায় বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে। ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধরনের পড়াশোনা করছে না।

পথশিশুরা অকালেই ঝরে যাচ্ছে। মাদকে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে, মাদক ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। তারা ছিনতাই করছে। তাদের জন্য সাসটেইনেবল পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা চাইলে তাদের সম্পদে পরিণত করতে পারি। কিন্তু আমরা সেটা যদি না করতে পারি তারা আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত পথশিশু জরিপ ২০২২-এর ফলাফল অনুযায়ী, পথশিশুদের সর্ব্বোচ্চ ২০ দশমিক ৪ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগ এবং সর্বনিম্ন ৪ দশমিক ৯ শতাংশ সিলেট বিভাগের জেলাগুলো থেকে এসেছে। এক্ষেত্রে পথশিশুর নিজ জেলা ময়মনসিংহ সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৯ শতাংশ এবং বরিশাল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, ভোলা ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, কুমিল্লা ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, কিশোরগঞ্জ ৪ দশমিক ১ শতাংশ এবং কক্সবাজার ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।

প্রধানত ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ পথশিশু দারিদ্র্য, ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ বাবা-মা শহরে আসার কারণে এবং ১২ দশমিক ১ শতাংশ কাজের সন্ধানে বাড়ি ছেড়ে শহরে এসেছে। প্রতি পথশিশুর পাঁচজনের দুজনই একা একা শহরে এসেছে। ১০ জন পথশিশুর তিনজন কখনই স্কুলে ভর্তি হয়নি। সব পথশিশুর কেবল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছে। খুব নগণ্য সংখ্যক পথশিশু নিম্ন ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করেছে। প্রায় চার ভাগের একভাগ পথশিশু ধূমপান করে এবং ১২ শতাংশ মাদকের নেশায় আসক্ত। আর ৬৪ শতাংশ পথশিশু তাদের পরিবারে ফিরে যেতে চায় না।

জরিপ আরও বলছে, ঢাকা বিভাগে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু অবস্থান করছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশের বসবাস। এসব পথশিশুর মধ্যে ৮২ শতাংশ ছেলে এবং ১৮ শতাংশ মেয়ে। ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী পথশিশু ৫৪ শতাংশ। এছাড়া পথশিশুদের ১২ শতাংশই মাদকাসক্ত।

রাজপথই ওদের ঠিকানা
আষাঢ়ের বৃষ্টি, মাঘের শীত, চৈত্রের ভ্যাপসা গরম সবকিছু সঙ্গী করে পথেই ঘুমায় পথশিশুরা। রাস্তার কুকুর-বিড়াল এসব শিশুর ঘুমের সঙ্গী। রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন, বিমানবন্দর রেলস্টেশন, টঙ্গী রেলস্টেশন, হাইকোর্ট মাজার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, পলাশী মোড়, দোয়েল চত্বর, চানখাঁরপুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শহীদ মিনার, ঢাকা মেডিকেল, গাবতলী, সদরঘাট ও বিভিন্ন ফুট ওভারব্রিজ এলাকা তাদের ঘুমের জায়গা। বাস, ট্রেনসহ আশপাশের অসহনীয় কোনো শব্দও তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় না। ব্যাঘাত ঘটান কিছু মানুষ।

আরও পড়ুন>> ৭৯ শতাংশ পথশিশু যৌন নিপীড়নের শিকার

সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঘুমাচ্ছিল পথশিশু রাফিয়া (ছদ্মনাম)। তার সঙ্গে ঘুমাচ্ছিল আরও সাত-আটজন। তারা কেউ মাথায় দিয়েছে ছেঁড়া পোস্টার আবার কেউ দিয়েছে বস্তা। সকালে রোদ এসে পড়ছে শরীরে। ভ্যাপসা গরমে ঘামছে শরীর। মাছি ভন ভন করছে। পাশে দুটি কুকুর ছানাও ঘুমাচ্ছিল। এর মধ্যে চৌকিদার এসে তাদের ওঠার জন্য বলেন। বারবার বলার পরও তারা ঘুম থেকে না উঠলে এক বালতি পানি ঢেলে দেন শরীরে। চোখ ঘষতে ঘষতে তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে পড়ে তারা।

jagonews24

পথশিশু রাফিয়া জাগো নিউজকে বলে, ‘সাত বছর ধরে ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায় থাকি। মা অন্য লোকের সঙ্গে চলে যাওয়ার পর বাবা আরেকটা বিয়ে করেন। সৎমা খেতে দিতো না। সব সময় মারতো। বাঁচার জন্য গ্রামের বাড়ি বগুড়া থেকে ঢাকায় চলে আসি। আসার বছরখানেক পর একবার বাড়িতে গেছিলাম। তখন বাবা ও সৎমা মিলে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। নিজের মায়ের কাছে গেলে সৎবাবাও মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আবার ঢাকায় চলে আসি। এখানেই এখন বাড়ি-ঘর। রাত হলেই আতঙ্ক লাগে। অনেকে খারাপ প্রস্তাব দেয়। আবার অনেকে জোর করে খারাপ কাজ করে। কোথাও কোনো ঠিকানা না থাকায় এভাবেই দিন-রাত পার করছি। আমারও ভালোভাবে বাঁচতে মন চায়।’

‘সারাদিন বোতল কুড়িয়েছি। রাতে এসে না খেয়ে এখানে ঘুমিয়েছি। আজ উঠতে দেরি হওয়ায় দারোয়ান পানি মেরে আমাদের উঠিয়ে দিয়েছে। এটা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।’

ঘুম চোখে রাফিয়া পোস্টারের নিচ থেকে ড্যান্ডির পলিথিন বের করে টানতে টানতে বলে, আরও একটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো। খালি পেটে কেন ড্যান্ডি খাচ্ছ জানতে চাইলে বলে, পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। পকেটে টাকা নেই। চোখে এখনো প্রচণ্ড ঘুম। ড্যান্ডি খেলে ঘুম কেটে যাবে আর ক্ষুধাও থাকবে না।

ভোরের আলোয় ঘুম ভাঙলেও জীবন থেকে দূর হয় না আঁধার
পথেই কাজ, পথেই খাওয়া, পথেই ঘুম। সকালে ঘুম ভাঙে ঠিকই, তবে জীবন থেকে আঁধার দূর হয় না। সকালের সূর্য হাসি ছড়ায় না তাদের জীবনে। পথশিশুদের সকাল মানেই ক্ষুধার বাস্তবতা। এ কারণে প্রতিদিন সকালে কাজের সন্ধানে বের হতে হয়। কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। দিনভর কাজ শেষে ক্লান্ত শরীর বিশ্রাম চায়। ঘুমে জড়িয়ে আসে চোখ। কিন্তু ঘর না থাকায় অনিরাপদ রাস্তা, ফুটপাত, পরিত্যক্ত নোংরা কোনো ঘর হয়ে ওঠে ওদের বিশ্রামের জায়গা। এমন অস্বাভাবিক পরিবেশ ওদের ঘুমাতে দেয় না। তবুও এভাবেই কাটে তাদের প্রতি রাত। প্রতিনিয়ত এমন অপর্যাপ্ত ঘুম পথশিশুদের ঠেলে দিচ্ছে নানারকম শারীরিক-মানসিক ঝুঁকিতে।

আরও পড়ুন>> পথশিশুদের প্রতি বৈষম্য নয়

ফার্মগেট ওভারব্রিজে সদ্য ঘুমভাঙা এক পথশিশু তুফান (ছদ্মনাম)। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে রাতে ওভারব্রিজে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম ভাঙলেও যেন ঘুম জড়িয়ে ছিল দুই চোখে। পেটে ক্ষুধা। তার হাতে দেওয়া হয় একটি খিচুড়ির প্যাকেট। খেতে খেতে অনেক কথা জানায় তুফান।

পথশিশুদের প্রতি বৈষম্য নয়

ঘুম প্রসঙ্গে জিজ্ঞাস করলে তুফান বলে, স্টেশনের মধ্যে ঘুমালে এক-দুই ঘণ্টার বেশি ঘুমানো যায় না। স্টেশনের বাইরে ওভারব্রিজের ওপর ঘুমালে একটু বেশি ঘুমানো যায়। তবে ওভারব্রিজে অনেকেই ঘুমায়, এখানে জায়গা পাওয়া কঠিন। রাতে ঘুমানোর জন্য কোনো ঘর থাকলে এখানে থাকতাম না। শান্তিমতো একটু ঘুমাতাম। ক্ষুধা ও ঘুমচোখে আমাদের কাজে বের হতে হয়। ক্ষুধা ও ঘুমের জ্বালা মেটাতেই আমরা মাদক সেবন করি।

‘আমরা একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই। মাদক থেকে দূরে থাকতে চাই। কিন্তু সমাজের কিছু মানুষ আমাদের হাতে মাদক তুলে দিচ্ছে। যারা আমাদের হাতে মাদক তুলে দিচ্ছেন তাদের কোনো বিচার হচ্ছে না। সব দোষই আমাদের দেওয়া হয়। আমাদের যারা নষ্ট করছেন তাদের কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না।’

তার বাবা-মা কে, কীভাবে এ জীবনে পা বাড়ালো সেটাও জানে সে। তুফান বলে, বুঝ হওয়ার পর থেকে বাবা ও মাকে পাইনি। আমার বাবা-মা কে আমি জানি না।

মৌলিক প্রয়োজন নির্বাহের একমাত্র উৎসও সেই পথ
সংবিধান অনুযায়ী দেশের সব নাগরিক তার মৌলিক অধিকার পেতে বাধ্য। মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র কোনো নাগরিককে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই মৌলিক অধিকার থেকে আজও বঞ্চিত আমাদের পথশিশুরা। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে যেসব শিশু রাস্তায় দিনাতিপাত করে, রাস্তায় কাজ করে, রাস্তায় ঘুমায়, নির্দিষ্ট কোনো আবাসস্থল নেই, উল্লেখ করার মতো নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই, খোলা আকাশের নিচে পার্ক, বাসস্টেশন, ফেরিঘাট, রেলস্টেশন শহরের অলিতে-গলিই তাদের ঠিকানা। এদের না আছে মাথা গোঁজার ঠাঁই, না আছে শিক্ষা গ্রহণের তদারকি, না আছে চিকিৎসা পাওয়ার সুব্যবস্থা। ক্ষুধার যন্ত্রণায় এদের আর্তনাদ আমাদের স্পর্শ করে না।

পথশিশুদের প্রতি বৈষম্য নয়

একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু ছয় মাস অন্তর নির্দিষ্ট স্থান পরিবর্তন করে। এদের মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশু স্থান পরিবর্তন করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কারণে আর ৩৩ শতাংশ পাহারাদারের কারণে নির্দিষ্ট স্থান পরিবর্তন করে।

রাজধানীর ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় থাকে পথশিশু আলামিন (ছদ্মনাম)। আলাপকালে আলামিন জাগো নিউজকে বলে, ‘আমারও অন্যদের মতো বাঁচতে মন চায়। আমি আগে নেশা করতাম। এখন করি না। আমারও স্কুলে যেতে মন চায়। কিন্তু পেটের দায়ে স্কুলে যেতে পারি না। কাজ না করলে খাবো কী। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে চাই কিন্তু সারাদিন বাইরে থাকার কারণে নামাজ পড়তে পারি না। একটা যদি থাকার ঘর থাকতো তাহলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম আর শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম।’

আরও পড়ুন>> করোনাকালে পথশিশুদের হারাতে হয়েছিল থাকার জায়গাও

পথের জীবনে সে কীভাবে এলো জানতে চাইলে বলে, ‘বরিশাল থেকে মা আমাকে শ্যামলীর একটি বাসায় কাজ করার জন্য রেখে যান। বাসাবাড়িতে খাবার দিতো না। একটু ভুল হলে মারতো। একদিন বাসা থেকে বের হয়ে যাই। বরিশালের বাড়ির ঠিকানাও জানতাম না। উপায় না পেয়ে পথেই আশ্রয় নেই। সেই থেকে পথই আমার ঠিকানা হয়ে যায়।’

খেলাধুলার অধিকার থেকেও বঞ্চিত পথশিশুরা
খেলাধুলা শিশুদের অধিকার। অথচ পথশিশুরা এ অধিকার থেকে চরমভাবে বঞ্চিত। খেলাধুলার সুযোগ না পেয়ে পথশিশুরা নেশায় আসক্ত হচ্ছে। খেলাধুলার মাধ্যমে সমতা, বিশ্বাস, নেতৃত্ব গড়ে ওঠা, নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার মতো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পথশিশুরা।

ঘুম এমন একটা জিনিস, সারাদিন ব্রেনে জমা যত চিন্তা-ভাবনা থাকে তা ঘুমে শেষ হয়ে যায়। পরবর্তী কাজের জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীর ভারসাম্য হারায়। পথশিশুদের পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক কাঠামো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

কমলাপুর রেলস্টেশনে কথা হয় পথশিশু বাবুলের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। বাবুল বলে, পথে ঘোরার সময় দেখি আমার বয়সী অনেক শিশু খেলাধুলা করে। আমি পাশ থেকে দাঁড়িয়ে দেখি। তাদের খেলা দেখে আমারও খেলতে মন চায়। কিন্তু তারা আমাকে খেলায় নেয় না। খেলাধুলা করতে পারলে মনটা অনেক ভালো লাগতো।

পথশিশুদের কল্যাণে প্রয়োজন নীতিমালা
পথশিশুরা আর সব সাধারণ শিশুর মতো নয়। এ বয়সে ওদের কেউ মায়ের কোলে, কেউ স্কুলে থাকতে পারতো। থাকতে পারতো পরিবারের অটুট বন্ধনে। কিন্তু নিয়তির ফেরে এসব কিছুই পাওয়া হয় না ওদের। ওরা রাস্তায় ঘুমায়। পথে পথে ঘোরে। ক্ষুধার দায়ে রাস্তায়ই বেছে নেয় জীবিকার পথ। ওদের কল্যাণে নেই কোনো নীতিমালা। সরকারঘোষিত ভিশন ২০৪১ অর্জন করতে হলে এখনই এসব শিশুর কল্যাণে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরি প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডা. কামাল উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, আমি পথশিশুদের ভেতর থেকে ফিল করি। তাদের অধিকার আছে। তাদের অধিকার ফিরে পাওয়া উচিত। রাস্তায় দেখা যায় ছোট ছোট মেয়েগুলো থাকছে, এদের কী ভবিষ্যৎ আছে? এরকম দুঃসহ জীবনতো আমরা চিন্তা করতে পারি না। এদের কোনো আইডি কার্ড নেই। এদের একটা আইডি কার্ড করার জন্য আমরা চিন্তা-ভাবনা করেছিলাম। শিশুরা এ অবস্থায় থাকা জাতির জন্য রীতিমতো ভয়ঙ্কর একটা বিষয়। এটা সমাজের মানুষের দায়িত্বহীনতা, যে তাদের জন্য কিছু করা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন>> পথশিশুর ৪৮.৫ শতাংশই ঢাকা বিভাগে

পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জুম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান মো. শাহীন প্রধান জাগো নিউজকে বলেন, মানুষের যে পাঁচটি মৌলিক চাহিদা রয়েছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা- এ অধিকার থেকে পথশিশুরা বঞ্চিত। দুপুরে খাবার খেলেও রাতের খাবারের নিশ্চয়তা এই শিশুদের নেই। কিংবা ঝড়-বৃষ্টিতে এই শিশুদের নিরাপদ কোনো আশ্রয় নেই। বছরের পর বছর ছেঁড়া, নোংরা জামা পরতে দেখা যায় তাদের। অসুখ হলে নিশ্চিত হয় না সঠিক ও পরিপূর্ণ চিকিৎসা।

‘এছাড়া মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় খেলাধুলা থেকেও বঞ্চিত পথশিশুরা। ফলে চুরি, ছিনতাই, নেশাদ্রব্য গ্রহণের মতো নানারকম অনৈতিক এবং অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে তারা।’

এরকম দুঃসহ জীবন তো আমরা চিন্তা করতে পারি না। এদের কোনো আইডি কার্ড নেই। একটা আইডি কার্ড করার জন্য চিন্তা-ভাবনা করছিলাম। শিশুরা এ অবস্থায় থাকা জাতির জন্য রীতিমতো ভয়ঙ্কর একটা বিষয়। এটা সমাজের মানুষের দায়িত্বহীনতা, যে তাদের জন্য কিছু করা যাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, ‘পথশিশুদের একটি সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন দেওয়ার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও নীতিমালা। পরিপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে পথশিশুদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে একটি সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিশুরা অপরাধ করলে তাদের প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে তার জন্য অপরাধ বিশেষজ্ঞ বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ বলে দেয় না। শিশুদের আদালতে আনতে তাদের প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে তার জন্য পুলিশের যথাযথ প্রশিক্ষণ বা নির্দেশনাও দেওয়া হয় না।’

পথশিশুদের আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকার এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে শিশুরা খেলা করবে। যথাযথ পার্ক নেই যেখানে শিশুরা যাবে। যখন এগুলো শিশুরা পায় না তখন তারা নানা অপরাধে জড়িত হয়। পরিবার না থাকায় তারা যথাযথ প্রাথমিক শিক্ষাও পায় না।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. ইফফাত আরা শামসাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বাভাবিক কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। বয়স যত কম হবে তার ঘুমের তত বেশি প্রয়োজন। পাঁচ বছরের পর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতো ঘুম লাগে। এক মাসের শিশুর জন্য ১৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। ঘুম এমন একটা জিনিস, সারাদিন ব্রেনে জমা যত চিন্তা-ভাবনা থাকে তা ঘুমে শেষ হয়ে যায়। পরবর্তী কাজের জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীর ভারসাম্য হারায়। পথশিশুদের পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক কাঠামো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

মাদক বা ড্যান্ডি নামক মাদকে আসক্তির কারণে পথশিশুদের কী ধরনের প্রভাব পড়ে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব মাদকই ক্ষতিকর। মাদকে আসক্ত হলে শারীরিক, ব্রেন ও হার্টের ওপর প্রভাব পড়ে।

ভালো কাজের হোটেলের প্রধান উদ্যোক্তা ও পরিচালক আরিফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা পায় পরিবার থেকে। কিন্তু পথশিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা তো দূরের কথা, নৈতিক শিক্ষাও পায় না। যে কারণে কোনটা ন্যায় বা অন্যায় তা তারা বুঝতে পারে না। তাই পথশিশুদের হাতে ১০ টাকা ২০ টাকা দিয়ে নানান খারাপ কাজ করানো হয়। সামান্য কিছু টাকা দিয়ে ককটেল মারা, বোমা মারার মতো কাজ করিয়ে নেয় কেউ কেউ।’

তিনি আরও বলেন, ‘অন্য শিশুদের মতো তাদের বাসস্থান, শিক্ষা, ভালো খাবার পাওয়া, চিকিৎসার অধিকার আছে। তারা আদর পাবে, নৈতিক শিক্ষা পাবে। কিন্তু এগুলো থেকে তারা বঞ্চিত হয়। এসব শিশু কিন্তু খোলা পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের যখন চার দেওয়ালে বন্দি রাখা হয় তখন স্বাভাবিকভাবে তারা থাকবে না। যে বাচ্চা খোলা জায়গায় বেড়ে উঠেছে তাদের চার দেওয়ালে বন্দি রাখা যায় না। তাই তাদের জন্য খোলা পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।’

‘এসব বিষয় নিয়ে আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, চিন্তা করা উচিত। পথশিশুরা অকালেই ঝরে যাচ্ছে। মাদকে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে, মাদক ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। তারা ছিনতাই করছে। তাদের জন্য সাসটেইনেবল পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা চাইলে তাদের সম্পদে পরিণত করতে পারি। কিন্তু আমরা সেটা যদি না করতে পারি তারা আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ছিন্নমূল এসব শিশু সমাজের মূল ধারা থেকে বঞ্চিত। নানা কারণে এসব শিশু সমাজের মূলধারা ও পারিবারিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে পথশিশুদের পুনর্বাসন ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা জরুরি। পথশিশুরাই একসময় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মাদক বিস্তারের ক্ষেত্রেও তারা মাদক কারবারিদের ভরসাস্থল হয়ে ওঠে। এসব শিশুকে মূলধারায় আনতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের আওতায় এনে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা উচিত। তাহলে একদিকে অপরাধপ্রবণতা কমবে, অপরদিকে এসব পথশিশু ধীরে ধীরে সমাজের মূলধারায় একীভূত হবে। পথশিশুদের জন্য কার্যকর নীতিমালা প্রয়োজন।’

জেএ/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।