বিপদে কুয়াকাটা, ১০ বছরে বিলীন ৮ স্পট
সাগরকন্যা কুয়াকাটা। একসময়ের অবহেলিত এই সৈকতে পর্যটকের আগমন বেড়েছে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নয়নের কারণে। অন্যদিকে প্রকৃতির বৈরী অবস্থায় ধীরে ধীরে ক্ষয়ে আসছে এ সৈকত। একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার এই অপরূপ বেলাভূমির একের পর এক স্পট বিলীন হয়ে যাচ্ছে সাগরে। বড় বড় ঘূর্ণিঝড়গুলো তাতে দিয়েছে বাড়তি মাত্রা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এবং সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে এই সৈকতের অন্তত আটটি স্পট পুরোপুরি বা আংশিক বিলীন হয়ে গেছে।
স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ী, প্রশাসন, ট্যুর অপারেটর, ট্যুর গাইডসহ সবারই দাবি, প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই সৈকতের বিভিন্ন স্পটকে যদি রক্ষা করা না যায় তাহলে একসময় সৈকতের সৌন্দর্য থাকবে শুধু ইতিহাসের পাতায়।
বর্তমানে কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্ট হিসেবে যে স্থানকে নির্ধারণ করা হয় সেখান থেকে হিসাব করলে দেখা যায়, ১০ বছরে সৈকতের আধা কিলোমিটারের কাছাকাছি স্থান হারিয়ে গেছে সমুদ্রে। একই সময়ে সমুদ্রে বিলীন হয়েছে কয়েক হাজার গাছ, হোটেল, রেস্ট হাউস, পার্কসহ নানান স্থাপনা।
জিরো পয়েন্ট এলাকার সৈকত
অফিসিয়ালি এখনো কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের প্রস্থ তিন কিলোমিটার ও দৈর্ঘ্য ১৮ কিলোমিটার। তবে বাস্তবে জিরো পয়েন্ট এলাকায় সে প্রস্থ এখন মাত্র কয়েকশ মিটার। অন্যদিকে বেড়েছে দৈর্ঘ্য। ১৮ কিলোমিটার থেকে বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ কিলোমিটারে।
জিরো পয়েন্ট এলাকায় বিলীন হওয়া সৈকতকে রক্ষায় সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা জানালেও বাস্তবে কার্যকর কিছু হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াক) প্রেসিডেন্ট রুমান ইমতিয়াজ তুষার এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, সিডরের পরবর্তী সময় থেকে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট এলাকায় বালুক্ষয় শুরু হয়। গত ১৭ বছরে সবচেয়ে বেশি প্রস্থ কমে এখন সর্বশেষ অবস্থায় চলে এলেও বালুক্ষয় রোধে টেকসই কোনো পরিকল্পনা বা তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। কিছু সময়ে অস্থায়ী কিছু জিও ব্যাগ আর টিউব দিয়ে বালুক্ষয় রোধ করার চেষ্টা হয়েছে। তবে তাতে কিছুই রক্ষা হচ্ছে না। উল্টো এর ফলে সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে। অপরিচ্ছন্ন সৈকতে পরিণত হয়েছে জিরো পয়েন্ট।
ফয়েজ মিয়ার নারিকেল বাগান
ষাটের দশকে ফয়েজ মিয়া নামের এক ব্যক্তি সমুদ্র সৈকতের একেবারে কোল ঘেঁষে প্রায় ২০০ একর জমির ওপর পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলেছিলেন নারিকেল বাগান। সমুদ্রের অব্যাহত ও অপ্রতিরোধ্য ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে সেই বাগান। এর পূর্বদিকে বনবিভাগ ১৫ হেক্টর বালুভূমিতে তৈরি করেছে ঝাউবন। আশির দশকে যারা কুয়াকাটা ভ্রমণ করেছিলেন তারা এখন গেলে খোঁজেন সেই ফয়েজ মিয়ার নারিকেল বাগান। যদিও সেই বাগান এখন প্রায় অতীত।
- আরও পড়ুন
- বদলেছে কুয়াকাটার চিত্র, পর্যটক দ্বিগুণ
- কুয়াকাটায় পাবলিক টয়লেট থেকে পর্যটকের মরদেহ উদ্ধার
- পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কাউয়ার চরের ইলিশ-খিচুড়ি
কুয়াকাটা বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কুয়াকাটা মানবিক সহায়তা কেন্দ্রের সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, ফয়েজ মিয়ার বাগান মানে কুয়াকাটার ঐতিহ্যবাহী স্পট। শুধু নারিকেল নয়, এখানে কাজু বাদাম, পেয়ারাসহ নানান ফল এবং ঔষধি গাছ ছিল। ফয়েজ মিয়ার বাগান বিলীন হওয়া মানে কুয়াকাটার অর্ধেক সৌন্দর্য বিলীন। তাই এ ধরনের বাগান আবারও করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
ঝাউবন
কুয়াকাটায় ভ্রমণ পিপাসুদের প্রায় ৭০ শতাংশই ঝাউবনে ঘুরতে যান। এ কারণে ঝাউবন রক্ষায় বন বিভাগ এবং স্থানীয় সচেতন পর্যটন ব্যবসায়ী সবারই প্রচেষ্টা রয়েছে। তবে ঝাউয়ার নামে যে স্থানকে চিনে থাকেন, সেই ঝাউবন এখন পুরোপুরি বিলীন। কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে দুই কিলোমিটার পূর্ব দিকের ওই ঝাউবনের কিছু অংশ এখনো অবশিষ্ট থাকলেও মূল বন সম্পূর্ণ বিলীন।
মহিপুর থানা সিপিপির চেয়ারম্যান শফিকুল আলম বলেন, ‘আমি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু কুয়াকাটার এই উপকূলীয় স্থানের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুব কম রয়েছে। কুয়াকাটা থেকে বিলীন হয়ে যাওয়া নারিকেল বাগান, ঝাউবন, লেম্বুরবন- এগুলোই পর্যটকদের মূল আকর্ষণ ছিল। সমুদ্র সৈকতকে রক্ষা করতে এখনো জিওটিউব আর জিওব্যাগেই আটকে আছেন আমাদের কর্ণধাররা। কিন্তু কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা করতে গ্রোইন বাঁধ খুবই জরুরি। না হলে যতটুকু সৌন্দর্য রয়েছে তাও খুবই দ্রুত বিলীন হবে।’
- আরও পড়ুন
- রাস উৎসবে কুয়াকাটায় পর্যটকদের ঢল
- পর্যটকে পূর্ণ কুয়াকাটা, লোডশেডিংয়ে নাকাল
- টানা ছুটিতে কুয়াকাটায় ৭০ শতাংশ হোটেল বুকড
কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান (ইকোপার্ক)
কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার পূর্বে ৭০০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছিল পরিকল্পিত কুয়াকাটা ইকোপার্ক। পার্কের ভেতরে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, বনজ ও শোভা বর্ধনকারী প্রায় ৪২ হাজার বৃক্ষ লাগানো হয়েছিল। পার্কের লেকে প্যাডেল বোট নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, বেঞ্চে বসে আড্ডা ও লেকের পাড়ের শেডে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগেরও ছিল আয়োজন। তবে ইকোপার্কের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল ঝাউবাগান। ঝাউবন ও বাগানের ভেতরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে সাগর থেকে ছুটে আসা ফুরফুরে বাতাস শীতল করে দিত ভ্রমণ পিপাসুদের অন্তর। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে দুই কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে পর্যটকদের জন্য মহিপুর রেঞ্জের অধীন এ ইকোপার্কটি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু পার্কের অবস্থান ভাঙন কবলিত এলাকায় হওয়ায় ইকোপার্ক প্রকল্প প্রায় বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অনেক কিছুরই অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। বর্তমানে এটির নামোন্নয়ন হয়ে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান হলেও ভাগ্যোন্নয়ে কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। গত কয়েক বছরে সেই জাতীয় উদ্যানটিও পুরোপুরি বিলীন।
এ নিয়ে টোয়াক প্রেসিডেন্ট রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রে একমাত্র ইকোপার্ক ছিল এটি। কিন্তু শুরুর মাত্র কিছু সময় পরই বিলীন হতে শুরু করে পার্কটি। এটিকে রক্ষা না করে নাম পরিবর্তন করে জাতীয় উদ্যান করা হয়। এটিকে রক্ষা, সংস্কার, সংরক্ষণ, পরিকল্পনার কোনো কিছু না করার কারণেই মূলত শতভাগ বিলীন হয়ে গেছে পার্কটি।
শুঁটকি পল্লি
স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় না হলেও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা এবং পর্যটকদের আকর্ষণ থাকায় শুঁটকির বাজার বিকশিত হয়েছে। ফলে এখানে গড়ে উঠেছে অন্তত তিনটি শুঁটকি পল্লি। আগে সৈকতের পশ্চিম প্রান্তে লেম্বুর চরে অস্থায়ীভাবে বাঁশ দিয়ে শুটকির চাঙ তৈরি করা হতো। এখনো সেই শুঁটকি পল্লি থাকলেও তা স্থানান্তরিত হয়েছে কয়েক জায়গায়। ফলে আগের শুঁটকি পল্লি নামে পর্যটকরা যে স্থান চিনতেন, এখন আর সেটি নেই।
কুয়াকাটা শুঁটকি মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সোহেল মাহমুদ বলেন, কুয়াকাটার শুঁটকি পল্লি নামে পর্যটকরা বিগত দিনে যে স্থানকে চিনে এসেছেন সে স্থানে এখন আর শুঁটকি পল্লি নেই। পুরোটাই সমুদ্রের গভীরে। শুঁটকি ব্যবসায়ীরা এখন বিভিন্ন স্থানে মাছ শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করেন। প্রতিবছর সমুদ্রের তীরে এসব পল্লি গড়ে ওঠে, আবার বিলীন হয়ে যায়। ব্যবসায়ীদের জন্য এটি অনেক বড় ক্ষতি।
গঙ্গামতির চর
কুয়াকাটার মূল পর্যটন স্পট থেকে পূর্ব দিকে ছয় কিলোমিটার দূরে গঙ্গামতির অবস্থান। এলাকাটি গঙ্গামতি খালের চরে গড়ে ওঠায় বলা হয় চরগঙ্গামতি। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এ বনে এক সময় সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, ছৈলা ছাড়াও হরেক রকমের বুনো গাছ ছিল। ছিল বানর, শূকর, শেয়াল, অজগরসহ বিভিন্ন ধরনের সাপ, বনমোরগ ও নানা রকমের পাখি। কিন্তু সেই পরিবেশ এখন আর দেখা যায় না। নামে গঙ্গামতির চর থাকলেও ১০ বছর আগের পরিবেশ এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বন আছে, গাছ নেই। সৈকত আছে, সৌন্দর্য কমেছে। নানাবিধ সমস্যার মধ্যেও অবশিষ্ট সৌন্দর্যটুকুকে সংরক্ষণ করা গেলে পর্যটকরা কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যে সময় কাটাতে পারেন গঙ্গামতির চরে।
- আরও পড়ুন
- ৩০ বছরের পরিত্যক্ত খাল সংস্কার করলো এলাকাবাসী
- কুয়াকাটা সৈকতকে নান্দনিক করতে উচ্ছেদ অভিযান
- কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে একদিন একরাত
- পর্যটকে মুখর কুয়াকাটা
কুয়াকাটা ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কেএম বাচ্চু বলেন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের বেশির ভাগ স্থান সমুদ্র গর্ভে বিলীন হচ্ছে। এত সমস্যার মধ্যেও সম্ভাবনার জায়গা কিন্তু এই গঙ্গামতির চর। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের জিরো পয়েন্ট এলাকায় সৈকতের প্রস্থ কমলেও গঙ্গামতির স্থান থেকে যে প্রস্থ রয়েছে তা পর্যটকদের মুগ্ধ করছে। তাই সরকার যদি এই স্থানটিকে নান্দনিক করে, পর্যটক আকর্ষণে তা আরও সহায়তা করবে।
লেম্বুরবন
নাম শুনে অনেকে লেবু গাছের বাগান জাতীয় কিছু একটা মনে করে থাকেন। তবে নামটি এসেছে রাখাইন সম্প্রদায়ের এক মাদবরের নাম থেকে। লেম্বু নামের সেই ব্যক্তির বসতবাড়ি ও বাগান ছিল এখানে। সমুদ্রের করাল গ্রাসে তাদের সে ঘরবাড়ি, জমিজিরাত সবই হারিয়ে গেছে। রয়ে গেছে শুধু বাগান এলাকার কিছু অংশ, আর নামটা। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে আন্ধারমানিক নদী আর সাগরের মোহনার কাছে অবস্থিত স্থানটি। প্রতিবছরই বিলীন হতে হতে এখন শেষ পর্যায়ে লেম্বুরবনটি। একসময়ের গহিন লেম্বুরবন এখন পুরোপুরি ফাঁকা বললেই চলে।
আদর্শ জেলে পল্লি
সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় জিরো পয়েন্টের পশ্চিম পাশে গড়ে উঠেছিল এক জেলে পল্লি, যার নাম আদর্শ জেলে পল্লি। এই পল্লিতে বংশ পরম্পরায় জেলে তৈরি হতো, সমুদ্রের সঙ্গে ছিল তাদের নিবিড় সম্পর্ক। ভাঙনের কবলে বিলীন হতে হতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই সেই পল্লিতে। সমুদ্রের ঢেউ এখন সেই স্থানে আছড়ে পড়ে। এই জেলে পল্লিতে যারা বাস করতেন, বেশিরভাগ মানুষই ছিল ভূমিহীন। এই ভূমিহীন মানুষগুলো সমুদ্র ভাঙনের কারণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন পাশের বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে।
টোয়াকের সেক্রেটারি জেনারেল জহিরুল ইসলাম বলেন, কুয়াকাটার সৌন্দর্যের অন্যতম আরও একটি সৌন্দর্য হলো জেলে পল্লি। বিলীন হওয়া জেলে পল্লির মানুষগুলো কোথায় কীভাবে দিন কাটাচ্ছে সেই খোঁজ হয়ত আমাদের কারো কাছেই নেই। কিন্তু আদর্শ গ্রামের জেলেরাই সমুদ্র থেকে জীবন বাজি রেখে মাছ সংগ্রহ করে। সরকারের উচিত তাদের সংরক্ষণ করা। তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা
এজেডএম/এমএইচআর/এমএমএআর/জিকেএস/এএসএম