মিরসরাই-সীতাকুণ্ডে পাহাড় ঝরনা সমুদ্র সৈকতের অপূর্ব মেলবন্ধন
চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলার বুক চিরে বয়ে গেছে দেশের লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। রয়েছে পূর্বাঞ্চল রেললাইন। পূর্ব পাশজুড়ে আছে সুউচ্চ পাহাড়। সে পাহাড়ে ঝরছে ঝরনাধারা। পাহাড়ের পাদদেশেই চোখজুড়ানো হ্রদ। পশ্চিমে সমুদ্র। সমুদ্র ঘিরে গড়ে উঠেছে সমুদ্র সৈকত।
দুই উপজেলার উত্তর পাশটা যেমন ঘিরে রেখেছে টলটলে পানিভরা নদী, তেমনি পশ্চিম পাশে প্রায় ৪০ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে সমুদ্র। সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৃষ্টি বন, পাহাড়, ঝরনা, নদী, সমুদ্র ও হ্রদের এমন সম্মিলন দেশে আর কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে? এই কারণে মিরসরাই-সীতাকুণ্ডকে বলা হচ্ছে দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় পর্যটন স্থান।
এই দুই উপজেলার প্রায় ৩০টি পর্যটন স্পটে প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু মানুষ। বিশেষ করে ছুটির দিনে মানুষের উপচে পড়া ভিড় চোখে পড়ার মতো। তবে এসব পর্যটন স্পটে এখনো তেমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়নি। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থারও ঘাটতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে সরকার এসব পর্যটন স্পট থেকে বছরে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় করতে পারবে।
‘এখানে দীর্ঘ সময় মন্ত্রী, এমপি থাকা ব্যক্তিরা এখানকার পর্যটন নিয়ে তেমন কোনো উন্নয়ন করেননি। এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলে অনেক তরুণের কর্মসংস্থান হবে এবং সরকারও রাজস্ব আদায় করতে পারবে।’- বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উপব্যবস্থাপক (বিপণন) মোহাম্মদ শেখ মেহদি হাসান
মিরসরাইয়ের পাহাড়ের বুক চিরে কলকলিয়ে ঝরছে চোখ ধাঁধানো বেশ কিছু প্রাকৃতিক ঝরনা। ঝরনাগুলোর মধ্যে খৈয়াছড়া, নাপিত্তাছড়া, রূপসী, সোনাইছড়ি, বোয়ালিয়া, বাওয়াছড়া, হরিণাকুণ্ড, মেলখুম ও মহামায়া বেশ নজরকাড়া। রয়েছে করেরহাট ফরেস্ট ডাকবাংলো, হিলসডেল মাল্টি ফার্ম ও মধুরিমা রিসোর্ট, আরশিনগর ফিউচার পার্ক। এখানে দেখা মিলবে মহামায়া, সোনাইছড়া ও বাওয়াছড়ার মতো স্বচ্ছ জলের মনভোলানো হ্রদের। এ হ্রদগুলোর মধ্যে মহামায়া আবার দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ।
- আরও পড়ুন
- শীতে ঘুরতে পারেন মিরসরাইয়ের যেসব দর্শনীয় স্থানে
- বছর শেষে ঘুরে আসুন ডোমখালী সমুদ্র সৈকতে
- সূর্যাস্ত উপভোগে ঘুরে আসুন আকিলপুর সমুদ্রসৈকতে
- পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে বাওয়াছড়া লেক
ফেনী নদীর মুহুরি সেচ প্রকল্প এলাকায় একবার ঢুঁ মারতেই হবে। এ নদীতে নৌকায় ঘোরাঘুরি করতে করতে দেখা যাবে বক, পানকৌড়ি ও মাছরাঙাদের ওড়াউড়ি।
দুই উপজেলার পুরো পশ্চিম দিকটাই সমুদ্রঘেরা। চোখের সীমানায় উত্তাল ঢেউয়ের তালে জেলে নৌকার নাচন দেবে চোখের প্রশান্তি। রয়েছে ডোমখালী ও শিল্পনগর সমুদ্র সৈকত।
সীতাকুণ্ড উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নে উপকূলীয় এলাকায় জীববৈচিত্র্যে ভরপুর বগাচতর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। রয়েছে সুন্দর হরিণ ও অন্যান্য পশুপাখি। সবুজে ঘেরা বেড়িবাঁধ বাগানের পশ্চিমে রয়েছে সমুদ্র সৈকত। বারৈয়াঢালা ইউনিয়নে রয়েছে নয়নাভিরাম লেক, সহস্রধারা ঝরনা।
ছোট দারোগাহাট দিয়ে পূর্বে দুই কিলোমিটার সবুজ পাহাড়ঘেরার মধ্যে আছে শীতল লেক। এখানে রয়েছে গফুর মসজিদ (গায়েবি মসজিদ)।
- আরও পড়ুন
- সৌন্দর্যের আড়ালে মৃত্যুফাঁদ, নির্দেশনা মানেন না পর্যটকরা
- মিরসরাইয়ের পর্যটন থেকে কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা
- একদিনেই ঘুরে আসুন সহস্রধারা ঝরনায়
- সবুজ গালিচার গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকত ডাকছে পর্যটকদের
সীতাকুণ্ড পৌরসভায় রয়েছে বিশ্বের অন্যতম ঐতিহাসিক তীর্থস্থান হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের চন্দ্র নাথ মন্দির ও উঁচু পাহাড়। রয়েছে শিব মন্দির, সীতার মন্দির, শম্ভুনাথ মন্দির, শংকর মঠ, শ্রীকৃষ্ণ মন্দির, কালী মন্দির ও সীতার ঝরনা। এখানে রয়েছে বোটানিক্যাল গাডেন ও ইকোপার্ক; বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য ও নয়নাভিরাম সুপ্তধরা ঝরনা।
মুরাদপুর ইউনিয়নে রয়েছে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃত গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত ও ভাটেরখিল জোড়া দিঘি। বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নে সবুজঘেরা পাহাড়, অগ্নিকুণ্ড। রয়েছে বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত ও আকিলপুর সমুদ্র সৈকত। পূর্বে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ পাহাড়।
ভাটিয়ারী ইউনিয়নে দেখার মতো রয়েছে গলফ ক্লাব মাঠ। বিএমএ মিলিটারি একাডেমি পাহাড়ের মাঝে আঁকাবাঁকা সড়কপথ, যা হাটহাজারী উপজেলা সংযুক্ত হয়েছে এবং নতুন পাড়া ক্যান্টনমেন্ট যোগ হয়েছে। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর লেক।
- আরও পড়ুন
- সূর্যাস্ত উপভোগে মুহুরী প্রজেক্টে কীভাবে পৌঁছাবেন?
- রূপসী ঝরনা দেখে মুগ্ধ পর্যটকরা, কীভাবে পৌঁছাবেন?
- ঝরনার রানি খৈয়াছড়ায় পর্যটকের ঢল
প্রকৃতির সৌন্দর্য পূজারি নাগরিক জীবনের শত ব্যস্ততার মধ্যে একটু ছুটি মিললে অনেকেই ছুটে যান সাগর, পাহাড়, অরণ্য ও ঐতিহ্যের সান্নিধ্যে। এই দুই উপজেলার ঐতিহাসিক স্থানগুলোও মুখর হয় পর্যটকদের পদভারে।
‘সরকার এখানে পর্যটনের উন্নয়নে কিছু করেছে বলে মনে হয়নি। থাকা, খাওয়া আর যাতায়াতের ভালো ব্যবস্থা থাকলে এখানে বিশ্বমানের পর্যটনকেন্দ্র তৈরির সব উপাদানই রয়েছে।’-পর্যটক নূর হোসেন মানিক
মিরসরাইয়ের মহামায়া ইকোপার্কে কথা হয় চট্টগ্রাম শহর থেকে আসা একটি পর্যটক দলের এক সদস্যের সঙ্গে। ওই গ্রুপের একজন নূর হোসেন মানিক বলেন, ‘বেড়ানোর জন্য মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলা একটি অসাধারণ জায়গা। বন, পাহাড়, ঝরনা, হ্রদ, নদী ও সমুদ্রের এমন মেলবন্ধন দেশের আর কোথাও আছে বলে আমার মনে হয় না। আমরা এরই মধ্যে মহামায়া হ্রদ ও খৈয়াছড়া ঝরনা ঘুরেছি। এরপর যাব সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে। সবগুলোর সৌন্দর্যই মনকাড়া। তবে রাতযাপনের ভালো ব্যবস্থা না থাকায় চাইলেও একবারে এসে এখানকার সব পর্যটন স্পট ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। সরকার এখানে পর্যটনের উন্নয়নে কিছু করেছে বলে মনে হয়নি। থাকা, খাওয়া আর যাতায়াতের ভালো ব্যবস্থা থাকলে এখানে বিশ্বমানের পর্যটনকেন্দ্র তৈরির সব উপাদানই রয়েছে।’
আকিলপুর সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসা দর্শনার্থী জানে আলম মাসুম বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহর থেকে খুবই কাছে এবং সুন্দর আকিলপুর সমুদ্র সৈকত। এখানে এমন একটি সমুদ্র সৈকত রয়েছে তা অনেকের হয়তো জানা নেই। সৈকতে শত শত পর্যটক দেখা গেলেও সে হারে দোকানপাট গড়ে ওঠেনি। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র থেকে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসতে হয়। কারণ সমুদ্র সৈকত সড়কে বাতির ব্যবস্থা না থাকায় অনেক পর্যটককে একাধিকবার বিপদে পড়তে হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সড়কটির কোনো সংস্কার কাজ হয়নি বলে স্থানীয়দের দাবি।’
মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলার পর্যটনশিল্পের সমস্যা এবং সম্ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উপব্যবস্থাপক (বিপণন) মোহাম্মদ শেখ মেহদি হাসান বলেন, ‘বহুমাত্রিক দর্শনীয় স্থানের কারণে পর্যটনশিল্পে মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলার পরিচিতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এসবের সঙ্গে দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পনগর, নানা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ও ধর্মীয় নিদর্শন এই এলাকাকে দিয়েছে অনন্য এক পর্যটন গন্তব্যের মর্যাদা। কিন্তু উপযুক্ত আবাসন, পরিবহন, ভালো গাইড ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের সংস্থান না থাকায় এখানে বড় পরিসরে পর্যটনের সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে।’
- আরও পড়ুন
- নাপিত্তাছড়া ঝরনায় পর্যটকদের ভিড়
- আঁকাবাঁকা পথ আর সবুজ পাহাড় দেখতে যেখানে যাবেন
- মিরসরাই ভ্রমণে ঘুরে আসুন সোনাইছড়া ট্রেইলে
শেখ মেহদি হাসান বলেন, ‘এখানে দীর্ঘ সময় মন্ত্রী, এমপি থাকা ব্যক্তিরা এখানকার পর্যটন নিয়ে তেমন কোনো উন্নয়ন করেননি। এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলে অনেক তরুণের কর্মসংস্থান হবে এবং সরকারও রাজস্ব আদায় করতে পারবে।’
এমএমডি/এমএমএআর/জিকেএস