সিকিমের রাবডেন্টস রুইন্স কতদূর?
খাদিজা বাপ্পী
আমি বরাবরই একটু ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। কোথাও বেড়াতে গেলে আমার সবটুকু দেখা চাই-ই চাই। যেবার সিকিম গিয়েছিলাম; সেবার প্ল্যান করে গিয়েছিলাম রাবডেন্টস যাবো। রাবডেন্টস সিকিমের প্রাক্তন রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী ছিল। শহরটি আক্রমণকারী গুর্খা সেনাদের দ্বারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এখন এখানে প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এবং চরটেনগুলো দেখা যায়।
যা-ই হোক, ওইদিন পেলিংয়ে আমাদের অন্যান্য জায়গা পরিদর্শন করে রুইন্স আসতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। জায়গাটি তখন বন্ধ হয়ে যায় যায়। দেখতে হলে আমাদের উঠতে হবে একটি ছোট্ট সুন্দর পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে পৌঁছানোর জন্য চেস্টনাট গাছের সাথে সারিবদ্ধ বনের পথ দিয়ে দুই কিলোমিটারের মতো নৈসর্গিক ট্র্যাক ধরে আসতে হবে। আমার সাথের অন্য সঙ্গীদের মধ্যে নাজমা আপা গাড়িতে বসে থাকলেন। আরেকটি পরিবার নিদর্শনটি দেখার জন্য নেমেছিলেন কিন্তু বার্ড পার্ক পর্যন্ত গিয়ে আবহাওয়া খারাপ দেখে ফিরে আসেন।
এদিকে আমি তো নাছোড়বান্দা, এত দূরে এসে ফিরে যাবো সেটা কি হয়! খুব সাহস করে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া চিকন রাস্তা, যার একপাশে আবার গভীর খাদ। সেই ট্র্যাক ধরে পাহাড় চূড়ায় ধ্বংসাবশেষের দিকে এগোতে লাগলাম। তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। বেশিরভাগ মানুষ তাদের দেখা শেষ করে নেমে আসছে। বুঝতে পারছিলাম, আমরাই মনে হয় শেষ ট্যুরিস্ট। আরেকটু অন্ধকার হয়ে গেলে আমাদের সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না। দুরু দুরু বুকে চিন্তা করতে করতে সামনে এগোচ্ছিলাম। পথে কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করলাম, রাবডেন্টস রুইন্স কতদূর? উত্তর এলো, আর মাত্র ৪০০ মিটার বাকি। তবে একটু কষ্ট করে ওখানে পৌঁছাতে পারলে আমাদের যাওয়াটা সার্ধক হবে। আমি সেই লোভে ফিরে না এসে আট বছরের মেয়ে আর তেরো বছরের ছেলেকে নিয়ে আগে বাড়তে থাকলাম। দুরু দুরু বুকে নানা কথা চিন্তা করতে করতে সামনে এগোচ্ছিলাম। যেতে যেতে আবারো একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, রাবডেন্টস কতদূর? আবারো একই উত্তর এলো, আর মাত্র ৪০০ মিটার বাকি।
কিন্তু ৪০০ মিটার আর শেষই হয় না। এদিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আরও বাড়তে শুরু করেছে। বাচ্চাদের জোরে পা চালিয়ে ওপরে উঠতে বললাম। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে ওরাও ক্লান্ত বেশ। তবে সেটা প্রকাশ করছে না। মাঝখানে আমি আর আমার দুইপাশে দুই বাচ্চা। শক্ত করে হাত ধরে উঠতে থাকলাম ওপরে। দুইপাশে বনের ভেতর থেকে অদ্ভুত কিছু পাখির ডাক আর কাদায় আমাদের পায়ের চপ চপ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। এক সময় আমরা চূড়ায় ধ্বংসাবশেষের কাছে পৌঁছে গেলাম। ওখানে একটু আলো দেখতে পেয়ে ভয় কিছুটা দূর হলো বটে। তবে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, আমরা ছাড়া একটিও জনপ্রাণী ছিল না তখন। এখানে পৌঁছাতে পেরেছি সেই আনন্দে আর ফিরবো কীভাবে সেই আতঙ্কে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল আমার।
একটা ছবি তোলার পর আমার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেল। এখন কী হবে! আমি তো ড্রাইভারের সাথে যোগাযোগও করতে পারবো না! তারপরও যখন উঠেছি বাচ্চাদের ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলাম আর জায়গাটির ইতিহাস শোনাতে লাগলাম। বুঝতে পারছিলাম এখানে বেশিক্ষণ থাকা উচিত হবে না। তাই একটু তাড়াহুড়া করছিলাম বটে। এরমধ্যে আবছা আলোয় দেখলাম এক ছিপছিপে কালো পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছরের যুবক উঠে আসছে নিচ থেকে। হাতে ক্যামেরা, পিঠে ব্যাগপ্যাক দেখে মনে হলো ট্যুরিস্ট। যাক, একজন তো পাওয়া গেল! যদিও সে আর আমরা ছাড়া আর কেউ নেই এখানে। তাকে ভয় পাবো, না কি পাবো না এটাই চিন্তার বিষয় হলো আমার। সাহস করে কথা বললাম। না, তিনি ক্ষতিকর কেউ নন, একজন ভদ্র তামিলনাড়ুর ট্যুরিস্ট। পরিচিত হলাম তার সাথে। তিনি তার ক্যামেরায় আমাদের ছবিও তুলে দিলেন।
এদিকে দেখি সন্ধ্যা ঘনিয়ে অন্ধকার নামছে। ভেবেছিলাম তাকে বলবো, আমাদের ভয় করছে। আমরা তার সাথে নামতে পারি কি না। কিন্তু তিনি এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন যে, তাকে আর বিরক্ত করলাম না। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খুব সাহস করে দুই বাচ্চার হাত শক্ত করে ধরে আবারও নামতে শুরু করলাম। বৃষ্টি বাড়াতে পুরো জায়গা হঠাৎ আরও অন্ধকার হয়ে গেল। রাস্তাটি কাদায় পিচ্ছিল হয়ে গেল। শুধু রাস্তার লাইন অনুমান করে ওদের হাত ধরে জগিংয়ের মতো করে কাদার ওপর থেকে দৌড়াতে শুরু করলাম। আমাদের হাতে কোনো আলো ছিল না। দুইপাশে চেজনাট গাছের ভেতর থেকে বিচিত্র শোঁ শোঁ শব্দ আর পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ কানে আসছিল। মনে হচ্ছিল, জঙ্গলের ভেতর থেকে অদ্ভুত কোনো জানোয়ার এখনই সামনে এসে দাঁড়াবে। তখন আমি কী করব!
বাচ্চাদের এভাবে এখানে আনা ঠিক হয়নি আমার। নানা কথা ভাবছি আর দৌড়ে দৌড়ে নিচে নেমে আসছি। আমি জানতাম না, ওখানে কোনো জোঁক ছিল কি না। তবে জোঁকের ভয়ে আমার দৌড়ানোর গতি আরও বেড়ে গিয়েছিল। বাচ্চাদের শুধু বলেছিলাম, দুইপাশে অন্ধকার জঙ্গলের দিকে তাকাবে না, শুধু নিচের দিকে তাকাবে আর দৌড়াবে। মায়ের হাত ছাড়বে না। ওরা তা-ই করেছিল। একটা টু শব্দ না করে আমার হাত শক্ত করে ধরে দৌড়ে আসছিল নিচে।
এভাবে কখন দেড় কিলোমিটার চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। হঠাৎ শুনতে পেলাম আমাদের ড্রাইভারের গলার আওয়াজ। দূর থেকে বলছে, অপলোক কাহা হে? শোনামাত্র আরবিন চেঁচিয়ে বলে উঠল, আঙ্কেল, হামলোক ইহা। ড্রাইভার কিছুটা দূর এগিয়ে এসে আমাদের রিসিভ করলো। সে জানাল, আমাদের দেরি দেখে আর অন্ধকার হয়ে গেছে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছে। তাই হাফ কিলোমিটার চলে এসেছে। আর এখানে অন্ধকারে কিছু জীবজন্তু আক্রমণ করে।
যা-ই হোক, ওই সময়ে আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে আমার সবচেয়ে আপন মনে হচ্ছিল। এদিকে আমাদের দেরি আর অন্ধকার দেখে অন্য ভ্রমণসঙ্গীরাও ভয় পেয়ে গেছে। গাড়িতে বসার পর দেখলাম নাজমা আপা আমার দিকে বড় বড় চোখ করে কটমটে তাকিয়ে আছেন। আমি কোনো কথা না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুঝতে পারছি, নাজমা আপা এখনো তাকিয়ে আছেন। তারপর মাথা উঁচু করে বললাম, বাচ্চাদের নিয়ে একটু রিস্ক নিয়ে ফেলেছি। আসলে ওখানের লোকজন বলল, আর মাত্র ৪০০ মিটার। এত দূর আর এত দেরি হবে বুঝিনি।
তারপর প্রতিজ্ঞা করেছি, বাচ্চাদের নিয়ে এমন ঝুঁকি আর কখনোই নেবো না। কিন্তু আমি জানি, এ ব্যাপারে আমি যথেষ্ট বেহায়া। হয়তো আবার যাবো ওদের নিয়ে অন্য কোথাও।
লেখক: ভ্রামণিক।
এসইউ/জিকেএস