পর্ব ০২
বিদেশ-বিভুঁইয়ের পথে-প্রান্তরে
বাঙালি পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে ভাগ্যান্বেষণে। অবশ্য এ ছড়িয়ে পড়াটা অনেক আগের। উনিশ শতকের দিকে মুর্শিদাবাদের মোকসেদ আলী কিংবা বিশ শতকের গোড়ার দিকের আমাদের হাবিব উল্লাহ, যে ছিল জাহাজের খালাসি। নিউইয়র্কে গিয়ে থেকে যান আমেরিকায়। বিয়ে করেন এক ল্যাটিন আামেরিকান নারীকে। আমাদের এক নানির বাবাও শিপে ক্রু ছিলেন বৃটিশ আমলে। নানি বলেছিলেন, তার বাবা অবুঝ অবস্থায় তাদের রেখে সেই যে গেছেন আর ফেরেননি। হয়তো জাহাজ ডুবিতে মৃত্যুবরণ করেছেন কিংবা বিদেশে সমৃদ্ধি ও সুন্দরী নারীর কারণে ভুলে গেছেন পরিবারকে। তিনি যে খালাসি ছিলেন না, সেটি আমি নিশ্চিত। তার স্যুট পরিহিত পোশাকই সে কথা বলে দেয়।
মূলত হুগলি, নোয়াখালী কিংবা সিলেটের বাঙালিরা শত শত বছর আগে থেকে বিদেশে-বিভুঁইয়ে পাড়ি জমিয়েছেন সমৃদ্ধির খোঁজে। এমনই একদল সিলেটির সাথে ২০১৩ সালে দেখা হয়েছিল ব্রাজিলের সাও পাওলোর Guarulhos International Airport-এ। অবশ্য আমার কানেকটিং ফ্লাইট থাকায় ‘হ্যালো’ করা ছাড়া কথা বলার উপায় ছিল না। ব্রাজিলের কথা বলবো আরেক দিন, ফিরে আসি নাপোলির বাঙালি পাড়ায়। ক্ষুধা পেয়েছে ফলে আগে থেকে তথ্য থাকায় ১০-১৫ মিনিটেই চলে আসি এক বাঙালি হোটেলে। খেতে খেতে কথা হয় স্থানীয় বাঙালিদের সাথে।
হোটেলে কাজ করা মাদারীপুরের এক তরুণের সাথে আলাপ জমিয়ে ফেলি। ছেলেটির বয়স ২১-২২ বছরের বেশি নয়। জানাল কত কষ্ট আর ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র পেড়িয়ে নাপোলিতে এসেছে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসরকে কাছে পেয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে দেখাতে চাইল ছেলেটি। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের মানুষ পেয়ে সে ভীষণ আহ্লাদিত। আমার প্রেজেন্টেশন থাকায় দু’একদিন পর যাবো বলে ঠিক করলাম। পরদিন আমার প্রেজেন্টেশন। সকালে কনফারেন্স ভেন্যু University of Naples L’Orientale-এ চলে গেলাম।
শুরুতেই দেখা হয়ে গেল কনফারেন্স কনভেনার আনা ফিলিগেঞ্জির সাথে। এক এক করে দেখা হলো পুরোনো বন্ধু-বান্ধব যেমন নেদারল্যান্ডেসের অ্যালান র্যাভেন, জার্মানির গার্ড মেভিসন, ফ্রান্সের ভিনসেন্ট লিফেব্রে, আমেরিকার মার্ক কে নয়ের, আমেরিকান-ভারতীয় চান্দ্রেয়া বসু, বৃটিশ অ্যাডাম হার্ডি শ্রীলংকান-ফ্রেঞ্চ ওসমন্ড বাপুয়ারেচ্চিসহ আরও কতজনের সাথে। তারা প্রত্যেকেই পৃথিবীর বিখ্যাত আর্ট হিস্টোরিয়ান ও প্রত্নতাত্ত্বিক। শুভেচ্ছা বিনিময়সহ অসাধারণ ভালো লাগায় মনটা পূর্ণ হলো। বেশকিছু নতুন বন্ধু-বান্ধবও তৈরি হলো প্রতিবারের মতো। উদ্বোধনের পর কফি ব্রেকে ইতালিয়ান স্টাইলে ছোট কাপে ক্যাপাচিনোর স্বাদ। অবশ্য আমার কাছে ইউরোপীয় স্টাইলের চেয়ে আমাদের মগ ভরে কফি পানই উপভোগ্য। কারণ এভাবেই আমরা অভ্যস্ত। বিদেশে কনফারেন্স সেমিনারে খাবারের বাহুল্য কম। এবারের সেমিনারেও লাঞ্চ হিসেবে ছিল মেডিটেরিনিয়ান ডিশ। সালাদ, টমেটো আর বিভিন্ন বিনসের কারি। আপনার ভুড়ি যে বাড়বে, সে সুযোগ ওরা দেবে না আপনাকে। কম ও পরিমিত খায় বলেই ফিগার ধরে রাখতে পারে ও সুস্থ থাকতে পারে ইউরোপীয়রা।
পুরোনো বন্ধু গার্ড আজ বিকেলে আমাকে অরিজিনাল পিৎজা খাওয়াবে বলে ঘোষণা দিল। গার্ড অবশ্য খুবই হিসেবি মানুষ। অযথা অর্থের অপচয়ে বিশ্বাসী নয়। তাই আমি এ যাত্রায় কিছুটা অবাক হয়েছি। আমি বার্লিনে গার্ডের বাড়িতে ছিলাম। ফলে ওর হিসেবী জীবন-যাপন সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। যাক বিকেলে আমার হোটেল থেকে হাঁটা দূরত্বে নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁয় মিলিত হলাম। অসাধারণ পিৎজা উপভোগ করলাম। বলে রাখা ভালো, এত বড় পিৎজা আমার পক্ষে সাবার করা সম্ভব হলো না বলে অর্ধেকটা বিশালাকৃতির গার্ডকেই শেষ করতে হয়েছে।
আরও পড়ুন
- কাজাখস্তান ভ্রমণে আকর্ষণীয় যা যা দেখবেন
- মালয়েশিয়া ভ্রমণে যে ৫ স্থান ঘুরে আসতে ভুলবেন না
- বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রেস্টুরেন্টে বসে খেতে কোথায় যাবেন?
তিনদিনের কনফারেন্স বেশ জমজমাট ছিল। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশ পুরোনো। ফলে বিল্ডিংগুলো রোমান স্থাপত্যিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তবে পুরোনো স্থাপত্য হলেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধাকে অ্যাকুমোডেট করতে ভুল করেনি। নবীন আর প্রবীণের কোনো সংঘর্ষ হয়নি কোথাও। ইতালির প্রতিটি শহরের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ঐতিহ্যের পরশ। আমাদের দেশ হলে ঐতিহ্যিক স্থাপনাকে ধ্বংস করার নানা কূট-কৌশলের প্রয়োগ দেখতে যেত। ছাত্রজীবনে সাতক্ষীরা অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে গিয়ে সুলতানি আমলের এক গম্বুজ বিশিষ্ট অসাধারণ এক মসজিদ দেখতে পাই। পাঁচ-ছয় বছর পরে গিয়ে অসাধারণ এই ঐতিহ্যিক নিদর্শনের জায়গায় বড় আধুনিক মসজিদ দেখতে পাই। জিজ্ঞেস করলে জানায়, পুরোনোটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। কারণ স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। এ ধরনের কাজ হরহামেশাই হয় আমাদের দেশে।
কনফারেন্সের পরদিন সকালে উঠে ব্রেকফাস্টের টেবিলে পরিচয় হয় জার্মান এক নারীর সাথে। যিনি এসেছেন ব্যবসায়ীক কাজে। সকালের ব্রেকফাস্টে নানা আইটেমের সাথে কমলার ফ্রেশ জুস বানানোর ব্যবস্থা ছিল। মাদারীপুরের আরিফ আমাকে সকালেই হোটেল লবিতে নিতে এলো। আমাকে বাঙালি এলাকা ঘুরিয়ে ইতালির বাজার সি-ফিস মার্কেট ইত্যাদি দেখিয়ে একসাথে লাঞ্চ সেরে বিকেলে নিয়ে গেল সমুদ্রতীরে Spiaggia della Gaiola বিচ এলাকায়। অসাধারণ পার্থিব এক স্থান মুহূর্তেই মন ভালো করে দেয়। শেষ বিকেলের আলোয় আমার একটি ছবি তুলে দিলো।
সন্ধ্যায় আরিফকে নিয়ে ডিনার সারলাম। শুনলাম ওদের কষ্টকর জীবনের কথা। এদেশে আসার পর শুরুতে ও ছিল এক ইতালিয়ান পরিবারের সাথে। স্থানীয় ইতালিয়ান পরিবারগুলোরও আগ্রহ থাকে কাগজপত্র ছাড়া আসা এ ধরনের রিফিউজি; যাদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক বিবেচনা করে পরিবারের সাথে রাখা হয়। যদিও ওর প্রকৃত বয়স বেশি। ইতালিয়ান পরিবারটি নাকি খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। সুবিধা হলো, এই যে ইতালিয়ান পরিবারগুলো অপ্রাপ্ত বয়স্ক রিফিউজির অভিভাবক হলে সরকারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের আর্থিক সাহায্য পেয়ে থাকে। অবশ্য তখনই আরিফ জানিয়েছিল যে, পরিস্থিতি পরিবর্তিত হচ্ছে।
সরকার আর শরণার্থী স্থান দিতে আগ্রহী নয়। এখন তো ইতালিতে ডানপন্থি সরকার দেশ চালাচ্ছে। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় দেশে ফিরতে না পারার একটা কষ্ট ওর মনের মধ্যে গুমড়ে মরে। যদিও কাজের মাধ্যমে প্রচুর টাকা আয় করে বাড়ি পাঠানোর একটা সুখ তো আছেই। দেশের এয়ারপোর্টে রেমিটেন্স যোদ্ধাদের সাথে সম্মানসূচক আচরণ না করায় ওর মনের ক্ষোভটি আমাকে বার বার প্রকাশ করেছে।
আমাকে অনুরোধ করেছিল এ বিষয়ে লিখতে। আমিও কথা দিয়েছিলাম লিখবো বলে। আজ প্রায় ৬ বছর পর ওদের এ ক্ষোভের কথা লিখতে পেরে দায় শোধের অনুভূতি হচ্ছে। আর সত্যিই তো বিদেশে কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলা মানুষের রেমিটেন্সের টাকা আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে সুসংহত করেছে বলেই নানা মন্দায়ও দেশ উৎরে গেছে। ইদানিং এ দৃষ্টিভঙ্গীর কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় এয়ারপোর্টে। তবে অনেক কিছু করা বাকি রয়ে গেছে এখনো।
চলবে...
এসইউ/জিকেএস