পাহাড়, ঝর্ণা আর মেঘেদের রাজ্য খাগড়াছড়ি
নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা আর সমস্ত ক্লান্তি ঝেরে ফেলতে ভ্রমণের জুড়ি নেই। তাই কোনো এক শুভ সকালে চার বন্ধু মিলে বেড়িয়ে পড়েছিলাম খাগড়াছড়ির পার্বত্য সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে। পাহাড়ি ঝর্ণা, সুউচ্চ পাহাড় আর সাদা মেঘের এক অপরূপ সমন্বয় খাগড়াছড়ি। সবুজের এই বিস্ময়কর রূপ আপনাকে মোহাচ্ছন্ন করে তুলবে নিমিষেই!
ঢাকা থেকে রাতের ট্রেনে চট্রগ্রাম পৌঁছলাম ভোরেই। সেখানে থেকে বাসে আড়াই ঘন্টার যাত্রা শেষে পৌঁছে গেলাম খাগড়াছড়ি শহরে। অবশ্য ঢাকা থেকে সরাসরি বাসেও যাওয়া যায় খাগড়াছড়িতে। সেখানে সবাই মিলে উঠলাম ‘খাগড়াছড়ি রিসোর্ট’ নামের একটি হোটেলে। খাগড়াছড়ি শহরের এক প্রান্তে বেশ নিরিবিলি একটা হোটেল, সুযোগ-সুবিধাও বেশ উন্নত মানের। বিকেলে বের হলাম খাগড়াছড়ি শহর দেখতে। ছোট হলেও বেশ ছিমছাম শহরটি। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, পাহাড়ের দেয়ালে আবৃত একখন্ড জনপদ। রাতের খাবার খেলাম এক আদিবাসী হোটেলে। সেখানে মিলল এক নতুন খাবারের পদ, বাঁচফুড়ি। কচি বাঁশ দিয়ে রান্না করা এক ধরনের তরকারি, খেতেও বেশ ভিন্ন স্বাদের।
পরদিন খুব সকালে অটোরিক্সা ভাড়া করে বের হলাম নতুন গন্তব্যে। এখানে সিএনজি অটোরিক্সা চলে না, কারণ এত উঁচু-নিচু রাস্তায় চলার মত যথেষ্ট কর্মদক্ষতা নেই। পরবর্তীতে অটো ড্রাইভার জসিম ভাইয়ের সঙ্গে সখ্যতার কারণে তিনি হয়ে গেলেন আমাদের লোকাল গাইড। প্রথমেই গেলাম খাগড়াছড়ি থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে, ‘মাতাই পুখিরি’ বা দেবতার পুকুরে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ১০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের ভেতর এই ছড়াটি অলৌকিকভাবে তৈরি বলেই বিশ্বাস স্থানীয় আদিবাসীদের। তাই তারা একে দেবতার আশীর্বাদ স্বরূপ পূজো করে নানা রঙের ফুল দিয়ে। পুকুরের পানি খুবই স্বচ্ছ এবং মিষ্টি। যা আপনার এতটা পথ পাহাড় বেয়ে ওঠার ক্লান্তিকে ভুলিয়ে দেবে। এই পুকুরের পাশেই ঝিরিপথ ধরে হেঁটে গেলে পাওয়া যাবে একটা ছোট্র সুন্দর পাহাড়ী ঝর্ণা।
পরের গন্তব্য ছিল দেবতার পুকুর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে আলুটিলা গুহায়। গুহার উপরের একটি পাহাড় থেকে খাগড়াছড়ি শহরের প্রায় পুরোটাই এক পলক দেখে নেওয়া যায়। আলুটিলা গুহার মধ্যে ঢুকতে হয় মশাল নিয়ে, মশাল অবশ্য ওখানেই অল্প দামে কিনতে পাওয়া যায়। গুহার নিচ দিয়ে ঝর্ণার পানি বয়ে যাচ্ছে, উপরে ঝুলতে থাকে বেশ কয়েকটি বাদুড়। গুহার কয়েকটি জায়গা এতটাই সরু যে কিছুটা নুয়ে পথ চলতে হয়। গুহার এক পাশ থেকে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হতে প্রায় ১৫ মিনিট সময় লাগে।
আলুটিলা গুহা ঘুরে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ‘রিসাং ঝর্ণা’ দেখতে গেলাম। পাহাড়ের গায়ে তীর্যকভাবে থাকা এই ঝর্ণার শীতল পানিতে গোসল করে নিলাম। ঝর্ণার কাছে যেতে পাহাড়ি পথ বেয়ে নেমে যেতে হয় অনেক দূর, আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে নামার সময় আশেপাশের পাহাড়ি সবুজ মনকে আলোড়িত করে তোলে।
দুপুরের খাবার সেরে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের মধ্যেই ‘পাহাড়ি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট’ দেখতে গেলাম। বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাহাড়ী বৃক্ষের সমারোহ। তাতে ছোট-বড় পাহাড়ের ঢালে রয়েছে আম, কাঠাল, পেয়ারা, কমলালেবুসহ অনেক ধরনের ফলের গাছ। সেখান থেকে ওই দিনের শেষ জায়গাটির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম, হর্টিকালচার পার্ক। পার্কটিতে দুই পাহাড়ের মাঝে যে ছড়া বয়ে গেছে, তার সংযোগ হিসবে রয়েছে একটা সুদৃশ্য ঝুলন্ত সেতু। পার্কের ছাউনীতে বসেই সন্ধ্যার রক্তিম সূর্যটাকে পাহাড়ের ওপাশে ডুবে যেতে দেখলাম। হর্টিকালচার পার্ক ঘুরে সেদিনের মত সেখানেই ক্ষান্ত।
পরদিন খুব ভোরে রওনা দিলাম সাজেক দেখতে। সাজেক রাঙ্গামাটি জেলার মধ্যে পরলেও স্থলপথে যেতে হয় খাগড়াছড়ি দিয়ে। খাগড়াছড়ি শহর থেকে দিঘিনালা, তারপর মাসালং হয়ে প্রায় ৬৮ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সাজেক ভ্যালী। দুর্গম পাহাড় কেটে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ইসিবি-১৯ এর করা পাকা রাস্তাটি শেষে খাড়া উঠে গেছে প্রায় ১১ কিলোমিটার। স্থানীয় ‘চান্দের গাড়ি’র উপর থেকে চারপাশের বিশাল পাহাড়গুলো দেখার মত!
সাজেকে মেঘাচ্ছন্ন সকালের সূর্য, আদিবাসী রুই-লুই পাড়া, প্রায় ৩ হাজার ৩০০ ফুট উচ্চতায় কাংলাক পাড়া কিংবা সিজুক গ্রামের কমলাবাগানের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করার মত না। প্রকৃতি যেন তার রূপ-লাবণ্যের ডালা সাজিয়ে বসেছে সৌন্দর্য পিপাসুদের মন কাড়তে! পর্যটকদের থাকার জন্য কটেজের ব্যবস্থাও রয়েছে। যত দূর চোখ যায়, যেন পাহাড়ের সারি। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের গায়ে ভাসমান মেঘ যেন ছেলেবেলার রূপকথার রাজ্যকে চোখের সামনে বাস্তব করে তোলে!
সাজেক থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। ততক্ষণে গহীন বনের অকৃত্রিম জোছনাও পাহাড়ী ঝর্ণার সঙ্গী হয়েছে। আর সেই আশ্চর্য আলোতে প্রবাহমান ঝর্ণার বয়ে চলার শব্দ এক অদ্ভুত সুরের সৃষ্টি করেছে। রাতটা বিশ্রাম নিয়ে পরদিন যাত্রা করেছিলাম আরেক পার্বত্যের রাণী রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে। পাহাড়ি ছড়া, সুবিশাল পর্বতমালা আর গাড় মেঘরাশির আচ্ছাদনে ঢাকা খাগড়াছড়ি যেন মনের সবটুকু জয় করে নিয়েছিল তার অপরূপ সবুজের জাল বিছিয়ে।
লেখক পরিচিতি : কম্পিউটার প্রকৌশলী
আরএস/এবিএস