বান্দরবান ভ্রমণে ঘুরে দেখবেন যেসব স্পট

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:২৯ পিএম, ১৯ অক্টোবর ২০২৩

সাইফুর রহমান তুহিন

চোখজুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর রোমাঞ্চকর অনেক জায়গার কারণে বান্দরবান বাংলাদেশের পর্যটন মানচিত্রে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশের তিনটি উচ্চতম স্থান বান্দরবানে অবস্থিত। এগুলো হচ্ছে- তাজিনডং (বিজয়), মৌদক মৌল (সাকা হাফং) ও কেওক্রাডং। এই তিন পর্বতশৃঙ্গ জয় করার জন্য যে কেউ খুশিমনে জঙ্গল ও পাহাড়ি নদী বেয়ে উঠতে পারে।

একবার পর্বতারোহণ শুরু করলে আকর্ষণীয় ঝরণার দেখাও মিলবে। আদিবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া ব্যতিক্রমী উপহার, খাদ্যসামগ্রী, হস্তশিল্প প্রভৃতি মনকে প্রফুল্ল করবে। এসবের মধ্য দিয়ে আদিবাসী সংস্কৃতির সান্নিধ্যও পাবেন। জেনে নিন বান্দরবান ভ্রমণে কোন কোন স্পট ঘুরে দেখবেন-

আরও পড়ুন: যে দেশের রাস্তায় নেই ট্রাফিক সিগনাল, তবুও হয় না যানজট 

শৈলপ্রপাত

শৈলপ্রপাত মিলনছড়ি এলাকায় অবস্থিত ও বান্দরবান থেকে থানচিগামী সড়কের চার কিলোমিটারের মধ্যেই। বান্দরবানের উল্লেখযোগ্য জলপ্রপাতগুলোর মধ্যে এটি একটি। বর্ষাকালে এখানে পানির প্রবাহ খুব বেশি থাকে।

jagonews24

এখানে ভ্রমণকালে ছোট ছোট বাজারগুলোতে আদিবাসীদের তৈরি হস্তশিল্প, তাঁতের তৈরি দ্রব্যাদি ও খাদ্যসামগ্রীর সংস্পর্শও পাবেন। বান্দরবান জেলা শহর থেকে পাহাড়ি জিপ রিজার্ভ করে থানচি উপজেলার শৈলপ্রপাতে যেতে পারেন।

নাফাখুম

বাংলদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জলপ্রপাতগুলোর মধ্যে নাফাখুম অন্যতম। থানচি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা রেমাক্রিতে পাহাড় ও বনের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত খরস্রোতা সাঙ্গু নদীতে অবস্থান নাফাখুমের।

নাফাখুম আবার রেমাক্রি জলপ্রপাত নামেও পরিচিত। একবার এখানে গেলে বারবার যেতে মন চাইবে। এখানে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বাহনও বান্দরবান জেলা শহরেই পাওয়া যাবে।

আরও পড়ুন: চীনের নিষিদ্ধ শহরে যা দেখে চোখ হবে ছানাবড়া 

জাদিপাই জলপ্রপাত

বাংলাদেশের প্রশস্ততম জলপ্রপাতগুলোর একটি হলো জাদিপাই। এটি রুমা উপজেলায় অবস্থিত। কেওক্রাডং চূড়া থেকে হেঁটে জাদিপাই জলপ্রপাতে পৌঁছতে হলে ঘণ্টাখানেকের পথ অতিক্রম করতে হবে।

jagonews24

কীভাবে যাবেন?

বান্দরবান জেলা শহর থেকে জিপ কিংবা চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করে প্রথমে রুমা বাজারে পৌঁছতে হবে। রুমা বাজার থেকে বগা লেকে যাওয়ার জন্য আবারও একটি জিপ কিংবা চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করতে হবে।

বগা লেকে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে বিধায় সেখানে আপনাকে রাত যাপন করতে হবে। বগা লেক এলাকায় অনেক আদিবাসী গ্রাম আছে। গাইডের সহায়তায় এখানে থাকা ও খাওয়ার একটি ভালো জায়গা পেয়ে যাবেন।

সকালে খুব তাড়াতাড়ি কেওক্রাডংয়ের পথে যাত্রা শুরু করতে হবে। কেওক্রাডং থেকেও জাদিপাই ঝরনা খুব কাছে নয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার পথ হেঁটে পৌঁছবেন সেখানে।

আরও পড়ুন: কম খরচে ভারত ভ্রমণে ঘুরে আসুন ত্রিপুরা রাজ্যে 

বগা লেক

বগা লেক বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক হ্রদ। রুমা উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে বগা লেকের অবস্থান। প্রায় ১৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই লেক। লেকের স্বচ্ছ নীল পানি আপনার নজর কাড়বেই।

প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক পর্যটক লেকটি ঘুরে দেখেন বিশেষ করে শীতকালে। লেকটির আশপাশে বেশকিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসতি আছে। বর্ষাকালে লেকের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো একটু কঠিন।

jagonews24

তবে লেকটিতে পর্যটকদের জন্য অবসর বিনোদনের কোনো কমতি নেই। লেকের কাছাকাছি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সব শিলাখন্ড দেখে নিশ্চিতভাবেই চমকে উঠবেন। চাইলে লেকের আশপাশে ক্যাম্পফায়ার করতে পারেন।

বুদ্ধ ধাতু জাতি মন্দির

বুদ্ধ ধাতু জাতি মন্দিরের আরেক নাম বান্দরবান স্বর্ণমন্দির। বান্দরবান থেকে দশ কিলোমিটার এবং বালাঘাটা থেকে চার কিলোমিটার দূরে পালপাড়ায় এ মন্দির অবস্থিত। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বুদ্ধ মূর্তি।

আরও পড়ুন: একদিনেই ঘুরে আসুন বাঁশবাড়িয়া বিলাসী ঝরনায় 

মাটি থেকে ২০০ ফুট উঁচু এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ ১৯৯৫ সালে শুরু হয়ে ২০০০ সালে শেষ হয়। শুধু বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীই নয়, দেশ-বিদেশের যে কোনো পর্যটকের জন্যই এটি এক আকর্ষণীয় স্থান। পাহাড় চূড়ায় মন্দিরের পাশেই আছে একটি ছোট পুকুর যা ‘দেবতাদের পুকুর’ নামে পরিচিত।

এই জায়গা থেকে বালাঘাটা ও এর চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। প্রতিবছরই এখানে বিভিন্ন ধরনের মেলার আয়োজন করা হয়। মন্দিরটি বিকেল ৫-৭টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা। হাফপ্যান্ট পরে কিংবা জুতা পায়ে দিয়ে এখানে যাওয়া নিষেধ। বান্দরবান শহর থেকে রিকশা কিংবা অটোরিকশায় চড়ে বুদ্ধ ধাতু জাতি মন্দিরে যাওয়া যায়।

jagonews24

চিম্বুক

চিম্বুক হলো বাংলাদেশের তৃতীয় উচ্চতম পর্বত। বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চিম্বুক পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ২,৫০০ ফুট। এই এলাকার রাস্তাঘাট আঁকাবাঁকা ও সর্পিল। জিপে চড়ে এসব রাস্তা পার হওয়া এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি।

আরও পড়ুন: কাশফুল দেখতে ঘুরে আসুন বৃন্দাবনে 

যাওয়ার পথে বিভিন্ন আদিবাসী পল্লী অতিক্রম করবেন। চিম্বুক এলাকায় সরকারি মালিকানাধীন দুটি রেস্ট হাউজ আছে। থাকতে হলে আগে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে রিজার্ভেশন নিতে হবে। সহজে খাওয়া-দাওয়া ও নাশতা করার জন্য এখানে একটি ভালো মানের ক্যান্টিনও আছে।

যেহেতু বান্দরবান শহর থেকে চিম্বুকের অবস্থান একটু দূরে তাই এখানে যেতে হলে ব্যক্তিগতভাবে গাড়ি রিজার্ভ করতে হবে। এছাড়া থানচিগামী বাস কিংবা জিপেও চড়তে পারেন। চিম্বুক যাওয়ার পথে একটি মিলিটারি চেকপোস্ট পড়বে ও পর্যটকদেরকে সেখানে নাম-ঠিকানা নিবন্ধন করতে হবে।

মেঘলা

আকর্ষণীয় এক অবসর বিনোদন কেন্দ্র হলো মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স। বান্দরবান পার্বত্য জেলা কাউন্সিলের খুব কাছেই এটি অবস্থিত। বান্দরবান শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে কেরাণীহাট সড়কে অবস্থিত মেঘলায় আছে একটি মিনি সাফারি পার্ক, একটি চিড়িয়াখানা, ঝুলন্ত ব্রিজ, পাহাড়ের নিচে একটি কৃত্রিম লেক ও নৌকা ভ্রমণের সুবিধা।

পিকনিক করার জন্য চমৎকার জায়গা এটি। মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রের অভ্যন্তরে ভারী খাবারের ব্যবস্থা নেই, শুধু স্ন্যাকস পাওয়া যাবে। মেঘলা থেকে একটু বাইরে হলিডে ইন রিসোর্ট ও পর্যটন মোটেলে চাইনিজ ও কন্টিনেন্টাল ফুড পাওয়া যাবে।

jagonews24

আরও পড়ুন: কুয়াকাটাকে হার মানাবে ছইলার চর 

দুটিতেই আছে রাত যাপনের ব্যবস্থা। বান্দরবান শহর থেকে মেঘলায় যাওয়ার জন্য প্রাইভেট জিপ কিংবা অটোরিকশা রিজার্ভ করতে পারেন। লোকাল বাসও পাওয়া যাবে।

নীলাচল

মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্সের কাছেই নীলাচল যা টাইগার হিল নামেও পরিচিত। বান্দরবান শহরের সবচেয়ে নিকটবর্তী পর্যটন স্পট হলো নীলাচল। এর অবস্থান টিগেরপাড়ায় যা বান্দরবান শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নীলাচলের উচ্চতা প্রায় ২ হাজার ফুট।

এখান থেকে পাখির চোখে দেখতে পারবেন পুরো বান্দরবান শহরকে। বর্ষা মৌসুমে এখানে পাবেন মেঘের মধ্যদিয়ে হেঁটে যাওয়ার রোমাঞ্চ। এখান থেকে শুধু সোনালি রংয়ের গোধূলিই নয়, উপভোগ করতে পারবেন জোসনা রাতের অনাবিল সৌন্দর্যও। শীতকালে পাবেন চোখজুড়ানো কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল।

jagonews24

থাকা-খাওয়ার কোনো সুবিধা এখনো নেই সেখানে। কেউ যদি বেশি সময় অবস্থান করতে চান তাহলে বান্দরবান শহর থেকে খাবার ও পানি নিয়ে যেতে হবে। শহরের কাছেই অবস্থান হওয়ায় প্রাইভেট জিপ কিংবা অটোরিকশা নিয়ে সহজেই যেতে পারবেন নীলাচলে।

নীলগিরি

বাংলাদেশের উচ্চতম ও আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলোর একটি নীলগিরি। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ফুট উঁচু জায়গাটির অবস্থান থানচি থানায়। বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি রোডে অবস্থিত নীলগিরি বান্দরবান জেলা শহর থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে। এর কাছাকাছিই আছে আদিবাসীদের গ্রাম।

ক্যাম্পফায়ার করার জন্য জায়গাটি খুবই উপযোগী। জায়গাটির সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। নীলগিরির একেবারে চূড়ায় তাদের নির্মিত একটি আকর্ষণীয় রিসোর্ট আছে। থাকতে চাইলে কোনো সেনা কর্মকর্তার মাধ্যমে আপনাকে রিজার্ভেশন নিতে হবে।

আনুমানিক ৬-৭ হাজার টাকা ভাড়ায় আছে তিনটি চমৎকার কটেজ। চার বেডের তিনটি তাঁবু রয়েছে যার প্রতিটির ভাড়া হাজার তিনেকের মতো। আরও আছে রেস্টুরেন্ট ও হেলিপ্যাডও। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।

এখানকার তাপমাত্রা ১০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরিতে যেতে হলে আপনাকে থানচিগামী বাস কিংবা জিপে চড়তে হবে। নীলগিরি যাওয়ার পথে প্রত্যেক পর্যটককে আর্মি চেকপোস্টে নাম-ঠিকানা নিবন্ধন করতে হবে।

jagonews24

উপরোক্ত স্থানসমূহ ছাড়া বান্দরবানের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় জায়গাগুলো হলো- শুভ্র নীলা, জীবন নগর পাহাড়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট ও জাদুঘর, বাকলাই জলপ্রপাত, রিজুক জলপ্রপাত, চিংড়ি ঝিরি জলপ্রপাত, জিংসিয়াম সাইতার জলপ্রপাত, পাতাং জারি জলপ্রপাত, ফাইপি জলপ্রপাত, প্রান্তিক লেক, মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স, কেওক্রাডাং পাহাড়, তাজিনডং পাহাড় প্রভৃতি।

যাতায়াত

ঢাকা থেকে পরিবহন হিসেবে বাস আছে। আর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে যেতে চাইলে বাসে কিংবা ট্রেনে চট্টগ্রামে পৌঁছে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে এসি/ননএসি বাসে চড়ে সোজা বান্দরবান। প্রতি ৩০ মিনিটে একটি করে বাস ছাড়ে বহদ্দারহাট থেকে।

থাকা-খাওয়া

বান্দরবান জেলা শহরে ভালোমানের অনেক আবাসিক হোটেল (বড় বাজেট ও মাঝারি বাজেট) আছে। খাওয়া-দাওয়ার জন্য সুপরিচিত দুটি জায়গা হলো বান্দরবান শহরের রুমা রোডের একটি রেস্টুরেন্ট ও জাদিপাড়া ডন বসকো হাই স্কুল রোডের আরেকটি রেস্টুরেন্টে।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও ফিচার লেখক

জেএমএস/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।