উয়ারী-বটেশ্বর ভ্রমণে কী দেখবেন ও কীভাবে যাবেন?
অলোক আচার্য
প্রতিটি ঐতিহাসিক স্থানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি নির্দিষ্ট সময়ের অসংখ্য স্মৃতি, মানুষের সুখ-দুঃখের ইতিহাস ও জীবন-যাপন পদ্ধতি। মোটকথা মাটির নিচে চাপা পড়া ইতিহাস সভ্যতার বিভিন্ন সময়ের গুরুত্ব তুলে ধরে।
হাজার হাজার বছর আগের জনপদ, জনবসতি যা আবিষ্কৃত হয়েছে অথবা এখনো অনাবিস্কৃত আছে সেই স্থানগুলোতে পা রাখলে মনের অজান্তেই ওই সময়ের দৃশ্যপট মনের গভীরে ভেসে ওঠে।
আরও পড়ুন: ভূমধ্যসাগরের তলদেশে ৭০০০ বছরের পুরোনো রাস্তার সন্ধান
বাংলাদেশে যে কয়েকটি স্থানে বহু পুরোনো সভ্যতার নির্দশন পাওয়া গেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো উয়ারী-বটেশ্বর। বাংলার সমৃদ্ধ নগর সভ্যতার ইতিহাস উয়ারী-বটেশ্বর।
নরসিংদী শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে বেলাবো উপজেলার উয়ারী ও বটেশ্বর দুটি গ্রাম অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রাচীন জনপদের খোঁজ মিলেছে এখানে। সেই সময়ের নগর সভ্যতার নিদর্শন, মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি, ব্যবহার্য জিনিসপত্র ইত্যাদি দেখেই বোঝা যায় তখন মানুষ কতটা পরিকল্পিত জীবনযাপন করতেন।
সেই ঐতিহাসিক স্থানে যাওয়ার অর্থাৎ নরসিংদী যাওয়ার সুযোগ হতেই ঠিক করেছিলাম উয়ারী-বটেশ্বর ঘুরে আসতেই হবে। একবার সেই ঐতিহাসিক স্থানটি না দেখলে সেখানে যাওয়ার পূর্ণতাই হবে না। মাধবদী বাসষ্ট্যান্ড থেকে গুগুল ম্যাপ আর স্থানীয়দের সহায়তায় প্রথমে পৌঁছালাম মরজাল।
আরও পড়ুন: ইয়েমেনের ‘মোখা’ শহর কেন বিখ্যাত?
কারণ সেখান থেকেই যেতে হবে ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থানে। মরজাল থেকে অটোতে রওনা হলাম উয়ারী-বটেশ্বরের দিকে। দু’ধারের রাস্তা কিছুটা সরু। গ্রাম্য নির্জন পরিবেশ। প্রচুর গাছপালা। চারদিকে লটকনের বাগান। আগে দেখিনি। নরসিংদী লটকন চাষের জন্য বিখ্যাত। তখন থোকায় থোকায় লটকনের ফুল ঝুলছে।
সে এক অপূর্ব দৃশ্য। চটপট ছবি তুলে নিলাম। এটাও আমার শখ। অটোতে চড়েই বটেশ্বরের কথা বলেছিলাম। ড্রাইভার সোজা নিয়ে বিখ্যাত সেই স্থানে নামিয়ে দিলেন। অনেকটা নিরব। খুব বেশি দর্শনার্থী নেই। যার কাছে জাদুঘরের চাবি থাকে তার সঙ্গে কথা বললাম। পুরোনো আমলের বাড়িতে তাদের বসবাস। জরাজীর্ণ দশা।
নির্ধারিত সময় অনুযায়ী দুপুর ১২টা থেকে উয়ারী বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘরের গেইট খুলে দেওয়া হয় দর্শনার্থীদের জন্য। আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন দর্শনার্থী ছিলেন। তারা স্থানীয় কি না বুঝতে পারলাম না। জাদুঘরের সামনের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রদত্ত তথ্য থেকে জানা যায়, উয়ারী বটেশ্বর ঐতিহাসিকভাবে আড়াই হাজারের পুরোনো।
আরও পড়ুন: একদিনের কাপ্তাই ভ্রমণে ঘুরে দেখবেন যেসব স্পট
অবশ্য উন্মুক্ত জাদুঘরে প্রবেশের আগেই একটি মাটির কূপ আপনাকে স্বাগত জানাবে। ভেতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, উয়ারী ও বটেশ্বর ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত বেলাব উপজেলার দুটি গ্রামের বর্তমান নাম। উয়ারী বটেশ্বর অঞ্চলে খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে খ্রিষ্টীয় ৮ম শতক পর্যন্ত সময়কালের ৫০টি প্রত্নপীঠ আবিস্কৃত হয়েছে।
আরও জানা যায়, এই ঐতিহাসিক স্থানটি যার কারণে সকলের দৃষ্টিগোচর হয় তিনি হলেন স্থানীয় স্কুল শিক্ষক হানিফ পাঠান। ১৯৩০ এর দশকে তিনিই প্রথম এই স্থান নিয়ে ও এর প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের গুরুত্ব সবার সামনে আনেন। তারপর তার সুযোগ্য সন্তান হাবিবুল্লাহ পাঠান এই স্থান নিয়ে গবেষণা, লেখালেখি ও প্রত্ন বস্তু সংগ্রহ করেন।
এরপর ২০০০ সাল থেকে নিয়মিতভাবে উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রম শুরু হয়। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম, টিন দিয়ে ঢাকা মাটির কুপটিতে এখনো পানি আছে। হাত দিয়ে ছোঁয়ারও ইচ্ছে ছিল! তবে তা পূর্ণ হয়নি।
আরও পড়ুন: চা বাগানসহ শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে আরও যা দেখবেন
গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আপনি দেখতে পাবেন ছোট ছোট ফলকে হাতের ডান দিকে লেখা আছে বসত ঘর, শস্যাগার, গর্ত বসতি রেপ্লিকা, (গর্ত বসতির সামনে লেখা তথ্য থেকে জানা যায়, মূল গর্তের মধ্যে আরেকটি গর্ত রয়েছে যা ছিল একটি শস্যাগার।
গর্ত বসতির পাশে আবিস্কৃত হয়েছে একটি কূপ ও ছাইভর্তি একটি চুলা। চুলার মেঝেতে একটি পাথরও পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, অধিকতর তাপ উৎপাদনের জন্য চুলার নিচে পাথর রাখা হয়েছিল। গর্ত বসতি তাপ-প্রস্তর যুগের বসতি, সময়কাল আনুমানিক ৩-৪ হাজার বছর। সে সময় আবহাওয়া ছিল শুষ্ক, বৃষ্টিপাত ছিল খুবই কম।
সেখানে আরও আছে রান্নাঘর, মাটির তৈজসপত্র, উয়ারী-বটেশ্বর দুর্গ নগর ভূসদৃশ্য, বৌদ্ধ ধর্মীয় কুন্ডু (কূপ), বিভিন্ন ঐতিহাসিক মন্দিরের স্থাপনার নিদর্শন ইত্যাদি। এছাড়া ভেতরে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, উয়ারী বটেশ্বরে কার্নেলিয়ান ও কালো অ্যাগেট পাথরে ইচিং করা প্রচুর পুঁতি উয়ারী-বটেশ্বরে আবিস্কৃত হয়েছে।
আরও পড়ুন: সঙ্গীকে নিয়ে ঘুরে আসুন ভারতের ‘ছোট্ট স্কটল্যান্ডে’
প্রাপ্ত নির্দশন থেকে ধারণা করা হয়, একসময় এখানকার শাসকদের যোগাযোগ ছিল রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গেও। ভাবা যায়! একটি ইতিহাস কত বছর মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল! সময় আসলে কত কিছুই চাপা দিতে পারে! আবার সেসব বেরও হয়।
সেই সময়ের মানুষের পেশা, জীবনধারণ প্রভৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায় এসব নির্দশন থেকে। বোঝা যায়, এখানকার অধিবাসীরা অধিকাংশই কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারা ধাতু গলিয়ে মুদ্রা তৈরি করতো বলেও জানা যায়। দুর্গের বাইরেও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ঘিরে আরও ৫০টির মতো প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন আবিস্কৃত হয়েছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক
জেএমএস/জিকেএস