উজবেকিস্তান ভ্রমণে কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন ও খাবেন?

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:০০ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২৩

সাইফুর রহমান তুহিন

সমগ্র বিশ্বের অগণিত পর্যটকের মধ্যে অধিকাংশই মূলত দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে ভ্রমণে বের হন। একাংশ চান প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করতে, আর বাকিরা পছন্দ করেন কোনো ঐতিহাসিক স্থান আবিষ্কার করতে ও ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ভালো করে জানতে।

আপনি যদি বাকিদের দলে হন তাহলে আপনার জন্য আদর্শ এক গন্তব্য হতে পারে মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তান। এটি একটি ভূমিবেষ্টিত রাষ্ট্র ও দেশটির সঙ্গে সীমান্ত আছে আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্থান, তুর্কমেনিস্তান ও কিরঘিজিস্তান।

আরও পড়ুন: সিকিম ভ্রমণে যে ভুল করলে বিপদে পড়তে পারেন 

ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও নজরকাড়া সব মুসলিম স্থাপত্যকর্মের জন্য ব্যাপক পরিচিতি আছে উজবেকিস্তানের। তাসখন্দ, সমরখন্দ, বুখারা, খিভা প্রভৃতি স্থান মুসলিম সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

jagonews24

চমৎকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কারণে উজবেকিস্তান তার প্রতিবেশী অন্যান্য মধ্য এশিয়ান দেশগুলোর তুলনায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ১৯৯১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর দেশটির পর্যটন শিল্প দ্রুত প্রসার লাভ করছে।

দেশটির প্রধান কয়েকটি গন্তব্য হলো-

তাসখন্দ

ঐতিহাসিক তাসখন্দ নগরী শুধু উজবেকিস্তানের রাজধানীই নয়, পুরো মধ্য এশিয়ার অর্থনৈতিক, আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের চতুর্থ বৃহত্তম নগরী ছিলো তাসখন্দ।

আরও পড়ুন: যে গ্রামের নারীরা ৭০ বছরেও দেখতে ‘তরুণীর’ মতো 

তাসখন্দের রাস্তায় রাস্তায় দেখতে পাবেন মাথায় তারব্যান্ড বাঁধা ও সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা রাখালদের সঙ্গে ভেড়ার পাল। দায়েউ নেক্সিয়াসের সামনে একটার পর একটা টিকো কার, মাটির নিচে মেট্রোরেলের নড়াচড়া- এসব দেখে আপনি ভালোভাবেই টের পাবেন যে, আপনি তাসখন্দ শহরে আছেন।

যদিও অনেক সময় ঐতিহাসিক সিল্ক রোড সংলগ্ন শহর সমরখন্দ, বুখারা ও খিভার সন্ধানের ছায়ায় তাসখন্দ একটু ঢাকা পড়ে যায় তারপরও আপনি ঘুরে দেখতে পারেন চোরসু বাজার, আমির তৈমুর স্কয়ার, খাস্ত-ইমাম এনসেম্বল, ফলিত শিল্প জাদুঘর, তাসখন্দ মেট্রোরেল, তাসখন্দ টাওয়ারে (যা বিশ্বের দীর্ঘতম টেলিভিশন টাওয়ারগুলোর একটি)।

আরও দেখবেন, দৃষ্টিনন্দন কুকেলদশ মাদ্রাসা, স্বাধীনতা স্কোয়ার, উজবেক পার্লামেন্ট ভবন, উজবেকিস্তানের রাষ্ট্রীয় জাদুঘর প্রভৃতি। আর শহরের বাইরে আছে নজরকাড়া চিমগান পর্বত যা একটি চমৎকার পিকনিক স্পট।

jagonews24

আরও পড়ুন: ছুটির দিনে ঘুরে আসুন লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি 

থাকা-খাওয়া

রাতে থাকার জন্য ভালো হোটেলের কোনো অভাবই নেই তাসখন্দ নগরীতে। এ শহরটির তেমন কোনো নির্দিষ্ট প্রাণকেন্দ্র নেই। তাই বেশির ভাগ হোটেল গড়ে উঠেছে মূল শহর ও বিমানবন্দরের আশেপাশে।

লা গ্র্যান্ড প্লাজা হোটেল, হোটেল উজবেকিস্তান, মিরান ইন্টরন্যাশনাল হোটেল, শডলিক প্যালেস হোটেল, হোটেল ইন্টারন্যাশনাল তাসখন্দ, হোটেল সিটি প্যালেস, লোটে সিটি তাসখন্দ প্যালেস হোটেল, র্যাডিসন ব্লু তাসখন্দ হোটেল, গোল্ডেন ভ্যালি হোটেল প্রভৃতি হলো তাসখন্দ নগরীর সুপরিচিত হোটেলসমূহ।

যে হোটেলেই থাকুন না কেনো রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সময় উজবেকদের জাতীয় খাবার পালভের (ইংরেজি নাম পিলাফ) স্বাদ পরখ করতে ভুলবেন না।

ভেড়ার মাংস, চাল ও সবজি দিয়ে তৈরি খুবই মুখরোচক এই খাবারটি পাবেন তাসখন্দ কিংবা অন্যান্য শহরের যে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে। এছাড়া সেখানকার তান্দির কাবাব, মান্টি ও শরবা নামের একজাতীয় স্যুপও খুবই জনপ্রিয়।

আরও পড়ুন: মনের মতো সঙ্গী না পেয়ে একাই ‘হানিমুনে’ তরুণী 

সমরখন্দ

আধুনিক উজবেকিস্তানের সবচেয়ে বিখ্যাত শহর হলো সমরখন্দ। খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ২০০০ সালে এই নগরীর গোড়াপত্তন ঘটে। পুরোনো শহরটি আফরোসিয়াব নামে পরিচিত ও গ্রিকরা একে বলে মারাকান্দা।

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৯ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের শাসনামলে পার্সিয়ান প্রদেশ সোগদিয়ানার রাজধানী ছিলো সমরখন্দ। পরবর্তী সময়ে এটি চীন ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যকার সড়কের একটি বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।

অষ্টম শতাব্দীর শুরুর দিকে এটি আরবদের দ্বারা শাসিত হয় ও মুসলিম সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে ওঠে। ১২২০ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল শাসক চেঙ্গিস খান সমরখন্দকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলেন। ১৩৬৯ সালে সম্রাট তৈমুর লং সমরখন্দকে তার রাজধানী বানালে আবার পুনর্গঠিত হয় সমরখন্দ।

jagonews24

আরও পড়ুন: উত্তর-পূর্ব ভারতে ঘুরে দেখুন জনপ্রিয় ৮ স্পট 

নিজের রাজধানী হিসেবে সমরখন্দকে বিশ্ব মানচিত্রে তুলে ধরেন তৈমুর লং। এখন সেখানে যেসব স্থাপত্যকর্ম দেখা যায় সেগুলো তৈমুর লং ও তার বংশধরদের হাতে গড়া।

ইমাম আল বুখারী স্মৃতিস্তম্ভ, সেন্ট ড্যানিয়েলস স্মৃতিস্তম্ভ, উলুগবেক অবজারভেটরি, শাহ-ই-জিন্দা কমপ্লেক্স, বিবি খানম মসজিদ, গুর আমির স্মৃতিস্তম্ভ ও রেগিস্তান স্কোয়ার হলো সমরখন্দের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান।

থাকা-খাওয়া

সমরখন্দে বেড়াতে গেলে থাকা-খাওয়া নিয়ে চিন্তার কিছুই নেই। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের পর অনেক আধুনিক হোটেল গড়ে উঠেছে সেখানে।

কামিলা হোটেল, গ্র্যান্ড সমরখন্দ হোটেল, ক্যারাভ্যান সেরাইল চোরাখা হোটেল, হোটেল রেগিস্তান প্লাজা, ওরিয়েন্ট স্টার হোটেল, এশিয়া সমরখন্দ হোটেল, মালিকা প্রাইম হোটেল, হোটেল আর্ক সমরখন্দ, জাহোঙ্গির হোটেল প্রভৃতি হলো সমরখন্দ নগরীর উল্লেখযোগ্য হোটেল।

আরও পড়ুন: ৫০ টনের বৃহত্তম সোনার খনির খোঁজ মিললো চীনে 

বুখারা

মধ্য এশিয়ার প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি হলো বুখারা। এই শহরের অবিভক্ত ঐতিহাসিক ভবনগুলোর বেশিরভাগই মধ্যযুগীয় সময়ের শেষ পর্যায়ে নির্মিত। নানান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে বুখারার বিভিন্ন জায়গাজুড়ে।

jagonews24

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিরামিক পটারি, ফায়ারপ্লেস, ছবি ও লেখাযুক্ত প্রাচীন মুদ্রা, প্রাচীন ধাতব সামগ্রী, অলংকার, হস্তশিল্পের সরঞ্জাম প্রভৃতি। দীর্ঘ একটি সময় ধরে বুখারা পার্সিয়ান শাসনের অধীনস্থ ছিলো।
প্রাচীনকালে আরিয়ানরা এখানে বসতি গড়েছিলো ও বুখারার স্থানীয় বাসিন্দারা এদেরই উত্তর পুরুষ।

ইরানের সোগদিয়ানরাও এখানে বসবাস করেছিলো ও এর কয়েক শতাব্দী পর এখানে পার্সিয়ান ভাষার বেশ প্রাধান্য ছিলো। বুখারায় বেড়াতে গেলে যেখানে অবশ্যই যাবেন তা হলো হিস্টোরিক সেন্টার অব বুখারা। ইতিহাস ও সভ্যতার অনেক নিদর্শনই আছে সেখানে।

সোভিয়েত আমলে বুখারায় ব্যক্তিমালিকানাধীন আধুনিক আবাসিক হোটেল একপ্রকার অকল্পনীয়ই ছিলো ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হোটেলগুলোর পরিবেশ ছিলো খুবই বাজে।

আরও পড়ুন: কাশ্মীর ভ্রমণে যে ৫ কাজ করলেই বিপদ 

তবে এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। কমিল বুখারা বুটিক হোটেল, বুখারা প্যালেস হোটেল, ওল্ড সিটি হোটেল, হোটেল গ্র্যান্ড বুখারা, ওমর খৈয়াম হোটেল, এশিয়া বুখারা হোটেল, মিনজিফা বুটিক হোটেল, কামেরলট হোটেল প্রভৃতি সদা প্রস্তুত আপনাকে উষ্ণ আতিথেয়তা দিতে।

jagonews24

খিভা

আরল সাগরের দক্ষিণে অবস্থান খিভা শহরের। খিভা বিখ্যাত তার সব প্রাচীন ভবনগুলোর জন্য যার অনেকগুলোই জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত। উজবেকিস্তানের প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি হলো খিভা।

এখানকার বেশিরভাগ ঐতিহাসিক ভবনগুলো উনবিংশ শতাব্দীতে স্থাপিত ও স্থাপত্যের বৈচিত্র্যের কারণে খিভা আপনাকে একটি স্পষ্ট ধারণা দেবে যে, মধ্য এশিয়ার অন্যান্য শহরগুলো আগে দেখতে কেমন ছিলো।

এখানে থাকার জন্য আছে ওরিয়েন্ট স্টার খিভা হোটেল, আজিয়া খিভা হোটেল, হোটেল মালিকা খিভা, হোটেল আরকাঞ্চি, হোটেল মালিকা খিয়েভাক, ইসলামবেক হোটেল, মেরোস হোটেল প্রভৃতি।

আরও পড়ুন: কাশ্মীর ভ্রমণে যে ৫ কাজ করলেই বিপদ 

গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী

পর্যটকবান্ধব একটি দেশ হিসেবে উজবেকিস্তানের ভিসা যোগাড় করা খুব কঠিন নয়। গুগলে সার্চ দিয়ে আপনি সহজেই ভিসা সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জেনে নিতে পারবেন।

বাংলাদেশে উজবেকিস্তান কনস্যুলেটের ঠিকানা হলো- ওয়াইল সেন্টার (৩য় তলা), বাড়ি নং-৭৪, গুলশান এভিনিউ, ঢাকা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দ নগরীর কোনো সরাসরি ফ্লাইট নেই। তবে কানেকটিং ফ্লাইট সহজেই পাওয়া যাবে।

টার্কিশ এয়ারলাইনস, এমিরেটস এয়ারলাইনস, কাতার এয়ারওয়েজ, থাই এয়ারওয়েজ, ইতিহাদ এয়ারওয়েজ, সৌদি এয়ারলাইনস, গালফ এয়ার, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস, এয়ার ইন্ডিয়া প্রভৃতি ঢাকা ও তাসখন্দের মধ্যে কানেকটিং ফ্লাইট পরিচালনা করে।

jagonews24

উজবেকিস্তানের জলবায়ু একটু উষ্ণমণ্ডলীয়। গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ও শুষ্ক। এপ্রিল থেকে জুন এবং আগস্টের দ্বিতীয় ভাগ থেকে নভেম্বর হলো উজবেকিস্তান ভ্রমণের সেরা সময়। দেশটির অফিসিয়াল ভাষা উজবেক তবে রুশ ভাষার প্রচলনও ভালোভাবেই আছে।

আরও পড়ুন: নীলাচল ভ্রমণে থাকা-খাওয়া ও যাতায়াত খরচ কত? 

তবে তরুণ প্রজন্মের কাছে ইংরেজি ভাষা দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রার নাম সুম। এক মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য হলো আনুমানিক ১১৪৩৭.৫০ উজবেক সুম।

দেশটির বিভিন্ন স্থানে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে বলে ভ্রমণের সময় একজন ইংরেজি জানা স্থানীয় গাইড সঙ্গে রাখা ও কমপক্ষে ১০-১২ দিন সেখানে অবস্থান করা উচিত। জাতি হিসাবে উজকেরা খুবই অতিথিপরায়ণ ও পর্যটকবান্ধব যা আপনাকে বাড়তি সুবিধা দেবে।

লেখক: সাংবাদিক ও ফিচার লেখক।

জেএমএস/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।