ঠান্ডায় যে শহরের মানুষের চোখের পাপড়ি-দাড়িও জমে যায় বরফে
বিশ্বের শীতলতম শহর হিসেবে পরিচিত ইয়াকুটস্কর নাম হয়তো অনেকেই জানেন। আর্কটিক সার্কেল থেকে ৩০০ মাইল দক্ষিণে এই শহরের অবস্থান। ৩ লাখ জনসংখ্যার বাস করেন ইয়াকুটস্কতে।
শীতে এই শহরের মানুষ এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে যান যে, বাইরে বের হলে তাদের চোখের পাপড়ি এমনকি দাড়িও জমে যায় বরফে। মাথা, নাক, কান ভারি কাপড়ে ঢেকে রাখলেও চোখ তো খুলে রাখতেই হয়! অনেকের মনেই এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তারা তো চাইলে সানগ্লাস বা চশমা পরতে পারেন!
তবে চশমা পরলে সেটাও বরফে ঢেকে যায় এমনকি ত্বকের সঙ্গে লেগে যায়, পরে চশমা খোলা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। এমনই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবেলা করে টিকে থাকে ইয়াকুটস্করা।
আপনি যদি অত্যধিক ঠান্ডা স্থান পছন্দ করেন তাহলে রাশিয়ার ইয়াকুটস্কের শহরে ঢুঁ মেরে আসতে পারে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এ পর্যন্ত সেখানে শীতকালে মাইনাস ৮৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট রেকর্ড করা হয়েছে।
শীতে যেমন এ শহরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বিরাজ করে, একইভাবে গরমেও বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ স্থান হয়ে ওঠে ইয়াকুটস্ক। এই শহরের গড় বার্ষিক তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
ইয়াকুটস্ক সাখা প্রজাতন্ত্রের আঞ্চলিক রাজধানী, যা ইয়াকুটিয়া নামেও পরিচিত। এ শহরের অনেক বাড়ি ও দালান মাটির গভীরে পুঁতে রাখা স্টিলের উপর নির্মিত, যা তাদের নীচের দিকে বায়ু চলাচল করে ও পারমাফ্রস্ট গলতে বাধা দেয়। এমনকি পানি ও গ্যাসের লাইনগুলো প্রায়শই মাটির উপরে থাকে।
বিশ্বের এই শীতলতম শহরের মানুষেরা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, অনেক থিয়েটার ও উত্সবের মধ্যে বিনোদন খুঁজে পান। বর্তমানে ইয়াকুটস্ক সমগ্র রাশিয়ান সুদূর পূর্ব ফেডারেল অঞ্চলের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
১৯ ও ২০ শতকে এই অঞ্চলে শিল্প বিকাশের সময়কালে ইয়াকুটস্কের অর্থনৈতিক টার্নিং পয়েন্ট ঘটেছিল। বর্তমানে ইয়াকুটস্কের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অংশ আঞ্চলিক খনি থেকে আসে। কয়লা খনি সাধারণ হলেও হীরার খনি অনেক বেশি লাভজনক।
সাখা প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন কোম্পানি বিশ্বের কাঁচা হীরার ২৬ শতাংশ উত্পাদন করে। সোনা হলো এই অঞ্চলের আরেকটি খনিজ পণ্য, যেখানে খনির কাজগুলো এত বড় আকারে হয় যে, সেগুলো মহাকাশ থেকেও দেখা যায়।
অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও, শহরের উপকণ্ঠে বসবাসকারী অনেকেই দারিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। কারো কারো কাছে তাদের খামারের পশুদের জন্য যতটা ভালো আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করার মতো যথেষ্ট সম্পদও নেই।
ইয়াকুটস্কবাসীর গড় মাসিক মজুরি প্রতি মাসে প্রায় ৬০০ ডলারের সমতুল্য। এই অঞ্চলে বসবাসকারীরা দুগ্ধজাত দ্রব্য, মাংস, মাছ ও বেরি জাতীয় খাবারের উপর প্রচুর নির্ভর করে। রেইনডিয়ার মাংস জনপ্রিয় সেখানে।
স্থানীয়রা প্রায়শই ইন্ডিগিরকা নামক একটি খাবার পরিবেশন করে, যেখানে থাকে সামান্য গলানো মাছের কিউব। এর উপরে পেঁয়াজ, লবণ, গোলমরিচ ও উদ্ভিজ্জ তেল থাকে।
বিশ্বের শীতলতম এই শহরে বরফ ও তুষারপাত ছাড়াও প্রচণ্ড কুয়াশা পড়ে। এর সঙ্গে বাতাস তো আছেই! ইয়াকুটস্ক লেনা নদীর উপর একটি প্রধান বন্দর, আর্কটিক মহাসাগরে প্রবাহিত তিনটি নদীর মধ্যে একটি।
লেনা স্তম্ভগুলো পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। সেখানে ৬৫০ ফুট লম্বা চুনাপাথরের স্তম্ভগুলো সবাইকে আকর্ষণ করে।
সাখা প্রজাতন্ত্রের কোথাও এমন কোনো সেতু বা রাস্তা নেই যা লেনা নদীকে অতিক্রম করে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রত্যন্ত শহরগুলোর মধ্যে একটি ইয়াকুটস্ক।
অন্যান্য হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগকারী শুধু একটি রাস্তা আছে, যার নাম লেনা হাইওয়ে। এই রাস্তা কেবল গ্রীষ্মকালে বা শীত মৃতদেহ অন্য স্থানে পাঠানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।
যদিও ইয়াকুটস্কতে দুটি বিমানবন্দর আছে। ইয়াকুটস্ক বিমানবন্দর ও মাগান বিমানবন্দর। তবে শীতের মাসগুলোতে বিমান টেক অফ করা অসম্ভব হতে পারে।
ইয়াকুটস্ক ভ্রমণে ম্যামথের জাদুঘর ঘুরে আসতে ভুলবেন না। সেখানে ম্যামথের মৃতদেহ আছে, যা তুষারপাত বা বন্যা দ্বারা সমাহিত হয়েছিল ও পারমাফ্রস্ট থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছিল।
এছাড়া সেখানে আছে পারমাফ্রস্ট কিংডম। এটি একটি অত্যাশ্চর্য ভূ-গর্ভস্থ জাদুঘর যেখানে কয়েক ডজন বরফের ভাস্কর্য আছে, যা কখনো গলে না।
স্থানীয় পৌত্তলিক দেবতা, বুদ্ধ, ডেড মরোজ (রাশিয়ার সান্তা ক্লজ) এর মূর্তি এমনকি বরফের ভাস্কর্য পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’ এর একটি ব্যাখ্যাও আছে সেখানে।
সূত্র: আটলাস অবসকিউর
জেএমএস/জিকেএস