ঢাকা থেকে সড়কপথে কলকাতা পৌঁছে যা দেখলাম
মোস্তফা মহসীন
কলকাতা মানেই ‘মাছে ভাতে কলকাতা’ না-কি ‘দই-রসগোল্লার কলকাতা’! আমার কাছে কলকাতা মানে কিন্তু ধর্মতলার মোড়ে রেঁস্তোরা বা ‘কেবিন’এ বসে ডবল হাফ চা। কলকাতার ডবল হাফ চা ভাগ করে খাবার জন্য নয়। ভাববেন না যে, এটি আবার সস্তা। সাধারণ এক কাপ চায়ের থেকে এর গুণগত মান এবং দাম দু’টোই বেশি।
৭০ দশকে কলকাতার জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘মহিনের ঘোড়াগুলো’ যেমন গেয়ে গেছেন, ‘ভেসে আসা কলকাতা কুয়াশা-তুলিতে আঁকা/ শহরতলির ভোর মনে পড়ে/ কাঠালচাঁপা আর কৃষ্ণচূড়ার শৈশব শুধু/ স্মৃতির ভেতর ট্রামের ধ্বনি বিবাগী সুর তুলে/ এই প্রবাসে ক্যালেন্ডারের পাতাই শুধু ঝরে/ কলকাতা-ও-কলকাতা…’।
কলকাতা সম্পর্কে বাকি বিশ্বের ধারণাটা এখনো বিপ্লব-বিদ্রোহ, লাল পতাকা, হরতাল-বন্ধ; আর এর মাঝে একটু-আধটু শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির আরাধনা! এই গৎবাঁধা ধারণার বাইরে বের হলেই কিন্তু দেখা মিলবে টানা রিক্সা, ট্রামের শব্দ, ঐতিহ্যবাহি হলুদ রঙের ট্যাক্সি, পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট খেলার মাঠ, ভিড়-ভাট্টার নাগরিক বিজ্ঞাপন আর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে ভরপুর ঈর্ষা জাগানিয়া এক কসমোপলিটান সিটির।
ছোটবেলা থেকেই শুনছি, প্রতিবেশী দেশ হলো ভারত আর পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের কলকাতা সেই দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী। ইউরোপের অন্যান্য অভিজাত শহরের মতো কলকাতা এবং ঢাকার মধ্যে নেই কোনো ভিসামুক্তির চুক্তি। তবে এটা মানতেই হবে যে ভাষা, জীবনধারা এবং ভূ-খণ্ডীয় আবেগ মিলিয়ে পদ্মা ও গঙ্গাপাড়ের লোকেরা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে কাছাকাছি।
জীবনে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ, সেটাও আবার সড়কপথে। রাজারবাগ থেকে ছাড়া সোহাগ ভলভো এসি বাসগুলো অত্যন্ত উন্নত। কানে হেডফোন লাগিয়ে যারপরনাই মাদকতায় প্রিয় গানের সুরে আবিষ্ঠ হয়ে পৌঁছে যাই বেনাপোল বর্ডারে। ভোর নাগাদ ওখানে বাংলাদেশের কাস্টমস-ইমিগ্রেশন সেরে নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে ভারতীয় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা।
তাদের ভেতরে কাজ করছিলো নতুন দেশে গমনজনিত রোমাঞ্চ শিহরণ। কিন্তু নানা উদ্ভট প্রশ্নে জর্জরিত করে মধ্যবয়সী এক ভারতীয় ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা সব বাংলাদেশিদের সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ভ্রমণের ক্লান্তিটাই ভুলিয়ে দেন! বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উদার না হওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের দুই-একজন অফিসারই যথেষ্ঠ। মনে পড়লো আই কে গুজরাল সাহেবকে, পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি যে ‘গুজরাল ডকট্রিন’ অনুসরণ করেছিলেন, তার মূল কথাই ছিল বৃহৎ দেশ ‘বড় ভাই’ হিসেবে ভারতকে বৃহৎ হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে ‘গুজরাল ডকট্রিন’ এখন যেন স্রেফ নীতিকথা। তিস্তার জলের মতোই অধরা। এপাড়ে যখন জলশূন্য জনগণের দীর্ঘশ্বাস এবং সেই দীর্ঘশ্বাসের মাঝে জিইয়ে রাখা ভারত বিরোধিতা নিয়ে নির্বাচন মৌসুমে চায়ের কাপে আমরা দেখি ঝড়। আর ক্ষুদ্র প্রতিবেশিকে বঞ্চিত করে সীমান্তের ওপারে তখন ভোটের মৌসুমে বিজেপির দাদাদের জাতীয়তাবাদী দাম্ভিকতার ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’।
সব বাধা-বিপত্তি দূরে ঠেলে অবশেষে পদযুগল স্পর্শ করে বিশ্বকবি, জীবনানন্দ, শীর্ষেন্দু, সুনীল ও সমরেশের প্রিয় শহরে। গুনগুনিয়ে দুলে ওঠা চিত্তে শুনি ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে/ তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ’, দেখি তৃষ্ণা নিবারণে প্রস্তুত হরিদাসপুরের চা দোকানিরা! চা খেয়ে পুনরায় কলকাতা অভিমুখী নয়া বাস। ভাবছি মাদার তেরেসা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষ চন্দ্র বসু, জ্যোতি বসু কতো কতো যশস্বী মানুষের স্মৃতির সুরভী আগলে রেখেছে এই পশ্চিমবঙ্গ!
দেখছি ছায়ামাখা অঘ্রাণের মিঠে রোদ্দুর ছড়ানো ধান জমি। মেঠোপথে দুরন্ত গতিতে বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুল যাচ্ছেন কিশোরীরা। সবুজ মাঠে গরু চড়াতে শশব্যস্ত কিছু রাখাল। গাঁয়ের চা দোকান থেকে ভেসে আসছে হিন্দি ছবির গান, সেই সুরে বুঁদ হয়ে পায়ের উপর অন্য পা তুলে নাচাচ্ছেন কেউ কেউ। পাতার বিড়ি, সিগারেট আর চায়ের ধোঁয়া মিলমিশে একাকার! দেখছি, আরও দূরে শান বাঁধানো পুকুরে স্নান শেষে মনে হচ্ছে জগতের সব পার্থিব পুণ্য নিয়ে গৃহে ফিরছেন পশ্চিমবঙ্গের রমণীকুল!
সেখানে পৌঁছানোর পর পার্ক স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট, মারকুইস স্ট্রিট, নিউমার্কেট ঘুরে ঘুরে দেখি। পছন্দসই হোটেল খুঁজে পেতে গিয়ে পেয়ে গেলাম নয়নাভিরাম একটি গেস্টহাউজ। মুকুন্দপুর জায়গাটা মন্দ না। প্রতি রাত্রিবাসের খরচ সেখানে মাত্র পাঁচশ রুপি। এসময় মধ্যবয়সী এক লোক হাত নেড়ে ডাক দিলেন।
কাছাকাছি যেতেই বললেন, ‘নমস্কার, দাদা কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, না-কি?’ হ্যাঁ, বলতে না বলতেই জিজ্ঞাসা, বাড়ি কোথায়? সিলেট। ও চমৎকার জায়গা, আমার পূর্বপুরুষের বাড়ি তো ওখানেই! ৪৭-এ দেশভাগের পর আমার বাবা এখানটায় চলে আসেন। আসলে বাংলাদেশের মানুষ কি যে ভালো!
একটু পরেই তার মতলব টের পাই। যখন বলেন, ‘দাদা ডলার ভাঙ্গাবেন না-কি? আপনি যে হোটেলে, সেটা তো খুবই খারাপ। আরো কমে ভালো হোটেল আপনাকে দিতে পারবো। দাদা, আর কিছু লাগলেও অনায়াসে বলতে পারেন। কারণ আমি আপনার দেশের লোক। কলেজ-ভার্সিটির সুন্দরী মেয়ে ছেলে আছে, লাগবে নাকি? একদম খাসা মাল!’
এবার লোকটিকে ভালোমতো পরখ করলাম; খোঁচা খোঁচা আধপাকা দাড়ি, গালের চোয়াল ভেঙ্গে গেছে, পরনে সাদা ফতুয়া। এরকম দালালে যে গিজগিজ করছে গোটা কলকাতা, তা আগে থেকেই জানতাম। ‘ধন্যবাদ’ বলে তাই পায়ের গতি দ্রুতই বাড়িয়ে দিলাম।
কলকাতার ল্যান্ডমার্ক কোনটি এ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। তবে বিদেশিরা হাওড়া ব্রিজের চাইতে সবসময়ই এগিয়ে রাখেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলকে। ১৯০১-এ রানির মৃত্যুর পর মূলত কার্জন সাহেবের উদ্যোগেই শুরু হয়েছিলো এ স্মৃতিসৌধ তৈরির কাজ। স্থাপত্যের মধ্যভাগের একটি ডোম বা গম্বুজ এটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। এই ডোমটির ঠিক নীচের ঘরটিকে বলা হয় ‘কুইন‘স হল’।
চোখ বারেবারে সাঁতার কাটে, এই ডোমটির মধ্যস্থলে বসে থাকা বিউগল হাতে ডানা মেলা ব্রোঞ্জের সেই পরীটি দেখে! নীচে, ভেতরে এই ঘরটির পাশ দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে চলে যাওয়া যায় ওপরে। ডোমটির গোলাকৃতি ঘিরে রেলিং দেওয়া পথ বেশ সুন্দর। এর মাঝেই ছড়িয়ে রয়েছে ১২টি বেশ বড় মাপের ছবি।
আঁকিয়ে একজন উন্নত রুচির শিল্পী। বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রতিকৃতি আঁকিয়ে শিল্পী ফ্রাঙ্ক। ১৮৩৭ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত রানি ভিক্টোরিয়ার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী এই চিত্রশৈলীতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাজমহল এখনো দেখিনি, তবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে আমার কাছে ছবিতে দেখা তাজমহলের কাছাকাছিই মনে হলো। পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে ফোনে কথা হয় আনন্দবাজার গ্রুপে কর্মরত কবি শ্যামল কান্তি দাশ এবং ঈশিতা ভাদুড়ীর সঙ্গে।
এর মধ্যে ঈশিতা ভাদুড়ী এসে পরদিন কলেজ স্ট্রিটে দেখা করেন। উত্তর কলকাতায় বেড়ে ওঠা এবং ওখানটাতে পড়াশোনা করা ঈশিতা জানান, কলকাতা ঘুরতে হলে চোখে মেখে রাখতে হয় একটু কলকেতে আমেজ। হাঁটতে হবে শহরের হলুদ ল্যাম্পপোস্টের রাস্তায়। কলকাতাকে ভালোবাসতে হবে আর ভালোবাসা অবশ্যই বিলিয়ে দিতে হবে হরেক রকম রঙে রাঙানো দেয়ালগুলোকে!
দুপুরে খাসির মাংস দিয়ে ভরপুর খাইয়ে তিনি আমাকে নিয়ে ছুটলেন মান্না দে ক্যাফেতে; যখন জানলেন হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে তার জন্য জমা আছে অনেক ভালোবাসা! শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাল-জমানার কফি কর্নারের কাছে বেশ কোনঠাসা মান্না দে’র কফি হাউস। তবু মনে হলো এক কাপ কফি, কিছু স্ন্যাক্স, হালকা গান আর বই মিলিয়ে লিজেন্ডকে স্মরণ; মন্দ হয় না!
কফির উষ্ণতায় আর বাংলাদেশিদের প্রতি শ্রদ্ধামাখা মুগ্ধতার গল্পে মজে, কখন যে চলে এসেছি হাওড়া ব্রিজে টের পাইনি। হুগলি নদীর তীরে দুই যমজ শহর কলকাতা আর হাওড়ার এটি সংযোগ রক্ষাকারী ব্রিজ। এটির অভিনবত্ব হলো, একটিও নাট-বল্টু লাগাতে হয়নি। আবার ব্রিজটির দিকে ভালো করে তাকালে দেখবেন, কোন পিলার বা স্তম্ভ ছাড়াই ব্রিজটি দাঁড়িয়ে আছে।
আদি পন্টুন ব্রিজ বা ভাসমান সেতুটিই পরবর্তী সময়ে নতুন নির্মাণে হাওড়া ব্রিজ। যার পোশাকি নাম ‘রবীন্দ্র সেতু’। শহরে গরম বেড়েছে, দূষণ বেড়েছে, ক্ষয় বেড়েছে। ব্রিজের নীচ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গা আগের চাইতে ক্ষীণ হয়েছে, তবু নতুন ব্রিজটির বয়স ছিয়াত্তর হলেও শরীরে জরা থাবা বসায়নি। স্বাস্থ্য টাল খায়নি একটুও!
মোহময়ী সন্ধ্যার সোডিয়াম আলোয় হাওড়া স্টেশনে এসে ট্রেন ফেল করা মানুষের মতোই আমিও অনেকটা অবাক বিস্ময়ে দেখছি লোহার নকশার জাল! শিল্পের কী অসাধারণ বুনট! ১৭০০ রুপি দিয়ে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনের টিকিট কাটি। এবারের গন্তব্য রাজধানী দিল্লী। যেখানকার লাড্ডু খুবই বিখ্যাত! খেলে পস্তাতে হয় আবার না খেলেও!
তবুও পর্যটকের চোখে এঁকে রেখেছি কলকাতার প্রতিটি মুহূর্ত যেমন এর বনেদীয়ানার স্বাক্ষর বহন করা পুরনো অভিজাত দালান, আর তার মাঝখানের সরুগলির পুরনো কলকাতা। আর অন্যদিকে চকচকে আধুনিক স্থাপত্যের সল্টলেকের নিউ কলকাতা। অন্যপৃষ্ঠায় থাকা ঘোড়ার গাড়ি, জীর্ণ ঘুপচি দালাল-বাড়ি। মধ্যবিত্তের পরিশ্রান্ত মুখাবয়ব।
লোকাল বাস আর মেট্রোয় গাদাগাদি করে ঝুলে ঝুলে নারী-পুরুষের কর্মস্থলে যাওয়া-আসা। রাস্তাজুড়ে হকারদের চিৎকার, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে পুরো জাতির দুই ভাগ হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ক্রিকেটপ্রীতি, এই ম্যাটার অব সাবজেক্টে ঢুকে পড়লে কলকাতা আর ঢাকা যেন অবিচ্ছিন্ন সংযোগ শহর! বাঙালির অস্তিত্ব থেকে একে আলাদা করা যায় না বলেই কি-না মনের গোপন মেমোরি কার্ডে সাজিয়ে রাখছি প্রিয় কলকাতার জন্য কয়েকছত্র-
পথের পাথর থেকে জলস্রোত ঝরে না কখনো/আমাকে ডাকে তোমার জনস্রোতে লেপ্টে থাকা সেই চেনা দৃশ্য/ সল্টলেক, কলেজস্ট্রিট, র্ধমতলার মোড়.../ দুঃখের মহড়া পায়ে কলকাতা ছুটে ঘরছাড়া স্রোতের মানুষ!/ দু’পা এগিয়ে এক পা পিছিয়ে জ্ঞান ও বোধের সড়কে আমিও তোমাকে ছুঁই/ শুনি ভোরের স্বপ্ন ভেঙেচুরে র্প্রাথনায় বসা দু’পারের মানুষের মৌনবাণী/ ভাষার পবিত্র শক্তি একদিন বদলে দেবে সীমান্তের জ্যামিতি!
জেএমএস/এমকেএইচ