বিশ্বের প্রথম ভাসমান হোটেলের করুণ পরিণতি!
বর্তমান বিশ্বে ভাসমান এমনকি আন্ডার ওয়াটার হোটেলগুলোর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। সারাবছরই বিশ্বের বিভিন্ন ভাসমান হোটেলে পর্যটকের আনাগোনা লেগেই থাকে। কখনো কি মনে প্রশ্ন জেগেছে, বিশ্বের প্রথম ভাসমান হোটেলটি কেমন ছিল?
সুইডেনের একটি প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন করা বিশ্বের প্রথম ভাসমান হোটেলটি নির্মিত হয়েছিল সিঙ্গাপুরে। বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার এক বন্দরে অবস্থিত হোটেলটি তার বাণিজ্যিক জীবন শুরু করেছিল অস্ট্রেলিয়ায়। সেখান থেকে ভিয়েতনাম হয়ে হোটেলটি দুই দশকেরও বেশি সময় আগে উত্তর কোরিয়ায় এসে পৌঁছায়।
১৯৮৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম কোরাল রিফ ‘গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ’-এ পর্যটক সংখ্যা বাড়াতে একটি ভাসমান হোটেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সুইডেনের একটি প্রতিষ্ঠানকে হোটেলের নকশা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। নকশা আঁকা শেষে তা বাস্তবায়নের কাজ দেওয়া হয় সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠানকে।
১৯৮৭ সালের শেষদিকে হোটেলটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, হোটেলটি নির্মাণে খরচ হয়েছিল সাড়ে ৪ কোটি ডলার। নির্মাণকাজ শেষে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার সাগর পাড়ি দিয়ে হোটেলটি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন উপকূলে পৌঁছায়।
গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের অবস্থান মেলবোর্ন উপকূল থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে। মেলবোর্ন বন্দর থেকে হোটেলটি স্থানান্তরের পর কয়েকবার নোঙর ফেলে তা সাগরের নিচে বেঁধে ফেলা হয়। ভাসমান হোটেলটি ফোর সিজনস ও গ্রেট রিফ ব্যারিয়ার কো-অপারেটিভ সংস্থার অর্থায়নে তৈরি হওয়ায় এর নাম দেওয়া হয় ‘ফোর সিজনস ব্যারিয়ার রিফ হোটেল’।
পাঁচ তারকা হোটেলটি ৭ তলা বিশিষ্ট। পর্যটকদের থাকার জন্য ছিল অত্যাধুনিক রুম, সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট, জিম ও রেস্টুরেন্ট। সেইসঙ্গে একাধিক নাইট ক্লাবের ব্যবস্থা তো ছিলই।
সুসজ্জিত হোটেলটি তার বাণিজ্যিক জীবন শুরু করার আগেই অস্ট্রেলিয়ার উত্তর উপকূলে শক্তিশালী এক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে বয়ে চলে ঘূর্ণিঝড়টি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় হোটেলটির কিছু অংশ। তবে ঝড়ের কারণে ১৯৮৭ সালের পর্যটন মৌসুমে মন্দা থাকায় হোটেলটির উদ্বোধন কার্যক্রম এক বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়।
এর মধ্যে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে বিদ্যমান বর্ণিল জীব-বৈচিত্র্যে ভাসমান হোটেলটি খারাপ প্রভাব ফেলবে বলে দাবি জানায় পরিবেশবিদরা। যত দ্রুত সম্ভব তারা হোটেলটি দূরে সরানোর প্রস্তাব জানান। যৌক্তিক এসব আশঙ্কা দূর করতে গিয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষের পরিচালনা ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
পরিচালনা ব্যয় বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ ছিলো- হোটেলে থাকা অতিথিদের বর্জ্য পদার্থগুলো বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরিশোধিত করা হতো। পয়ঃনিষ্কাশন প্ল্যান্ট থেকে বের হওয়া পরিশোধিত বর্জ্য পরবর্তীতে ফেলা হতো কয়েক কিলোমিটার দূরে। এ ছাড়াও হোটেলের পানির চাহিদা মেটাতে বিশাল একটি পাম্প বসানো হয়। এটি প্রতিদিন কয়েক টন সাগরের নোনা পানি পরিশোধন করে মিনারেল ওয়াটারে পরিণত করতো।
সব মিলিয়ে হোটেলটির পরিচালনা ব্যয়ের চাপ গিয়ে পড়ে অতিথিদের ওপর। ভাসমান এ হোটেলের সিঙ্গেল রুমে এক রাত কাটানোর জন্য খরচ পড়ত ৫৫০ ডলার। হোটেলটিতে থাকার খরচ বেশি পড়লেও কয়েক মাস পরেও দেখা যায়, প্রায় ৯০ শতাংশ রুমে অতিথি রয়েছে।
মেলবোর্ন থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরের এ ভাসমান হোটেলে পৌঁছানোর উপায় ছিলো দু’টি। ওয়াটার ট্যাক্সি নামক নৌযানে ১২০ ডলার দিয়ে যেতে হতো হোটেলে। এতে সময় লাগত দুই ঘণ্টার মতো। অথবা ৩২৫ ডলার ব্যয় করে ২০ মিনিটেই একটি হেলিকপ্টারে চড়েই যাওয়া যেত হোটেলটিতে।
ভাসমান হোটেলটির দুর্দিন শুরু হয়, যখন একটি ওয়াটার ট্যাক্সিতে আগুন ধরে যায়। এ দুর্ঘটনায় একধিক যাত্রী আহত হন। আরও বিপত্তি বাঁধে কিছুদিন পর, যখন কিছু অতিথি স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য হোটেল থেকে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে সাগরতল থেকে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করেন। এরপর সেখানে অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনী বিশেষজ্ঞ দল পাঠায়। তাদের গবেষণায় জানা যায়, উদ্ধারকৃত গোলাবারুদগুলো ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল।
ওই সময় খোলা সাগরে তাজা গোলাবারুদ ফেলে দেওয়া বৈধ ছিল। সমস্যা হলো, কোনো কারণে গোলাবারুদ বিস্ফোরিত হলে হোটেলটির ক্ষতি হতে পারে। এ খবরে হোটেলের খ্যাতি নিমিষেই ধসে পড়ে। এরপর কর্তৃপক্ষ সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ১৩০ ডলারে নামিয়ে আনেন। তবে ব্যবসায়ে ক্রমাগত ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না পেরে কর্তৃপক্ষ একবছরের মাথায় জাপানের এক প্রতিষ্ঠানের কাছে হোটেলটি বিক্রি করে দেয়।
জাপানি ওই প্রতিষ্ঠান ভাসমান হোটেলটি নিয়ে যায় ৫ হাজার কিলোমিটার দূরে ভিয়েতনামের হেনই নদীতে। ভিয়েতনামে হোটেলটির নাম দেওয়া হয় সাইগন ফ্লোটিং হোটেল। সেখানে প্রায় ১০ বছর সাফল্যের সঙ্গে দিন কাটায় বিশ্বের প্রথম ভাসমান হোটেলটি। তবে ১৯৯৮ সাল নাগাদ চারদিকে উন্নতমানের হোটেল নির্মাণ বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা কমতে থাকে ভাসমান হোটেলের। এরপর হোটেলটিকে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান হুন্দায়ের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
আরও এক দফা সাগর পাড়ি দিয়ে হোটেলটি গিয়ে পৌঁছায় উত্তর কোরিয়ায়। সেখানেও প্রায় ১০ বছর ভালো সার্ভিস দেয় হোটেলটি। সেখানে দুই কোরিয়ার বাসিন্দাদের পারিবারিক মিলনমেলার স্থান হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে ভাসমান হোটেলটি। তবে ২০০৮ সালে উত্তর কোরিয়ার এক সেনা হোটেলে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার এক সেনাকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার পরে হোটেলটি আবার অতিথিশূন্য হয়ে পড়ে।
সেই থেকে এখন পর্যন্ত হোটেলটি উত্তর কোরিয়ার উপকূল সীমানায় পড়ে আছে। মেরামত আর তদারকির অভাবে হোটেলের চেহারা আজ শোচনীয়। ২০১৯ সালে উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং উন স্থাপনাটি ধ্বংসের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ এখনো কার্যকর হয়নি।
ডেইলি মেইল/জেএমএস/এসইউ/জিকেএস