পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখতে কেমন?
সকালে ঘুম ভাঙলো মোবাইলের অ্যালার্মে। গতকাল সারা দিনের ক্লান্তিতে কম্বল মুড়ি দিয়ে জম্পেশ একটা ঘুম হলো। খুব ভোরে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম সূর্যোদয় দেখার জন্য। পাহাড়ে সূর্যোদয় সব সময়ই সুন্দর। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখতে পারা জীবনের সেরা অভিজ্ঞতাগুলোর একটি! কটেজ থেকে বের হয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না, কেওক্রাডংয়ের চারপাশ মেঘে ছেয়ে গেছে।
অনেক দূরের সবুজ পাহাড় দেখা যাচ্ছে। দৃষ্টিসীমাকে আটকে দিচ্ছে মাঝে মাঝে একখণ্ড মেঘ এসে। সামনের দুই পাহাড়ের গিরিখাতের মধ্য থেকে একটু পরপর দানব আকৃতির মেঘ বের হচ্ছে। আমরা অপেক্ষায় আছি সূর্যের। অপরূপ দৃশ্যাবলীর সমারোহ। পূব আকাশে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ মনে হলো কোনো ষোড়শী লজ্জা পেয়ে গাল লাল হয়ে যাওয়ার মতো মেঘের একটা কিনারা লাল হয়ে উঠেছে। ঠিক লাল নয়, কমলা। দিনের শুরুতে ঘোষণা করা আনকোড়া সূর্যের আলতো রশ্মি এসে পড়েছে মেঘের গায়ে। এতটাই মৃদু আলো যে, মেঘ ভেদ করে সে আলো এপারে আসতে পারছে না। সেই সাদা মেঘের উপর কমলা রঙের আভার যে কী রূপ! কোনো ক্যামেরার হয়তো সাধ্য নেই সে ছবি তোলার। অনেক শব্দ ভান্ডারে ঠাসা কোনো কবি হয়তো পারবেন ওই মুহূর্তের বর্ণনা দিতে। শুধু এ দৃশ্যটুকুর জন্য হলেও পাহাড় বেয়ে বারবার আসতে পারি অপরূপ কেওক্রাডংয়ে!
সবাই মিলে চূড়ায় বসে পাহাড়ে সূর্যোদয়ের মুহূর্ত উপভোগ করলাম। গতকাল চূড়ায় ওঠার পর আর আজ সকালের সূর্যোদয় দেখার পর নিজের কাছে মনে হচ্ছিল, এখানে না এলে তো জীবনটা ষোলোআনাই বৃথা ছিল। যতদূর চোখ যায় শুধু মেঘ আর মেঘ। এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না, আমাদের দেশটা এতো সুন্দর।
কিছুক্ষণ ছবি তোলার পর ব্যাগ গুছিয়ে সবাই নাস্তা করার জন্য চলে গেলাম লালা বমের হোটেলে। নাস্তা করেই কেওক্রাডংয়ের আর্মি ক্যাম্পে চেকআউট করেই আবার রওনা হলাম বগা লেকের উদ্দেশে।
যতই হাঁটছি; ততই পাহাড়কে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। এ পাহাড়ে কাটানো সময়টা পাহাড়কেই তো কত নিজের মনে হচ্ছিল। পাহাড় ছেড়ে যাওয়ার সময় তাই বুঝি মন খারাপ হচ্ছিল। তবুও কী আর করা? এ পাহাড়, সাদা সাদা মেঘ, নীল আকাশ আর সবুজ পাহাড়ের বিশালত্ব ছেড়ে যে যেতেই হবে।
হাঁটতে হাঁটতে মাত্র ৩০ মিনিটেই চলে এলাম দার্জিলিং পাড়ায়। হালকা একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হলো আমাদের হাঁটার মিশন। গতকাল থেকে আজ মনে হচ্ছে অনেক তাড়াতাড়িই এগোচ্ছি। তবুও গতরাতের বৃষ্টিতে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল আগের চেয়েও বেশি।
হাঁটতে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। বারবার পিছলে যাচ্ছিলাম সবাই। কিছু কিছু জায়গা খুবই সরু। এক ফুটও হবে না। মাঝে মাঝে এমন ছিল যে শুধু একটা পা রাখা যাবে। আর নিচে ১০০-২০০ ফুট গভীর খাদ। তবুও আস্তে আস্তে এগোচ্ছি সবাই, পা দুটোই শেষ ভরসা। শেষমেষ আর হাঁটতে না পেরে জুতা ব্যাগে ঢুকিয়ে খালি পায়েই হাঁটা শুরু করলাম।
যেহেতু খালি পায়ে হাঁটছি, সেহেতু মনে মনে একটু ভয় হচ্ছিল। পায়ে আবার জোঁক ধরে কি না? তাই একটু পরপর পা চেক করে নিচ্ছিলাম। যাত্রার মাঝপথে সবাই একটু থেমে আদিবাসীদের ছোট ছোট দোকান থেকে শরবত আর কলা খেয়ে আবারও চলা শুরু করলাম।
যেতে যেতে মনে হচ্ছিল, এবার সত্যি বুঝি আমাকে জোঁকে ধরেছে। কেমন জানি ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল পায়ে। আর দেরি না করে সাথে সাথে চেক করে দেখি, দুই দুইটা জোঁক পায়ের দুই আঙুলের ফাঁকে কখন ঢুকে রক্ত খাচ্ছে কে জানে? ভয়ে ভয়ে জোঁক দুটা সরিয়ে ফেললাম পা থেকে। কিন্তু পায়ের রক্ত বের হওয়া থামছে না। তখন নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, দূষিত রক্ত বের হচ্ছে- সমস্যা নেই।
পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর ভয়ও লাগছিল, কখন যেন পড়ে যাই। চিংড়ি ঝরনার আগের রাস্তাটা সবচেয়ে ভয়ানক ছিল। ৯০ ডিগ্রি কোণে বাঁকানো। গাছের ডালে ধরে ধরে নামতে হয়েছিল। সবচেয়ে সমস্যা করছিল পাথরগুলো। বৃষ্টির জন্য পাথরের উপরে কাদা জমে গিয়েছিল। আর যদি কেউ পড়ে যায়, তাহলে পড়বে এ পাথরগুলোর ওপর। প্রচুর ঝুঁকিপূর্ণ ছিল এগুলো।
অবশেষে আমরা সেই চিংড়ি ঝরনায় এসে পৌঁছলাম। চিংড়ি ঝরনায় গিয়ে আমরা মোটামুটি অনেকেই আবার গোসল করি। পাহাড়ি পথের ক্লান্তি দূর করার জন্যই বোধহয় সৃষ্টিকর্তা এ অপরূপ ঝরনা সৃষ্টি করেছেন। ঝরনায় গা ভিজিয়ে আরও ১ ঘণ্টা হেঁটে আমরা একপ্রকার বিধ্বস্ত অবস্থায়ই বগা লেকে পৌঁছাই।
বগা লেকে গিয়ে সিয়াম দিদির কাছ থেকে জামা-কাপড় নিয়ে আবারও নেমে পড়লাম বগা লেকে। বগা লেকের গোসল শেষ করে সিয়াম দিদি দোকানে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করলাম। তারপর সবাই চলে গেলাম বগা লেক আর্মি ক্যাম্পে চেকআউটের জন্য। চেকআউট শেষ করতে করতে চান্দের গাড়িও হাজির।
সাইন শেষ করে সবাই চান্দের গাড়িতে চেপে বসলাম। পাহাড়কে একা রেখে আমরা ছুটে চললাম ইট-পাথরের জঞ্জালের গন্তব্যে। আসলেই কি পাহাড়কে রেখে চললাম? না কি নিজেরাই পাহাড় হয়ে চলছি অবিরত? আমাদের মধ্যে কি পাহাড় নেই? পাহাড়ের মতো কতশত আনন্দ, দুঃখ, বেদনা সঙ্গে করে নিয়ে চলছি। পাহাড়ের কঠিন পাথর ভেদ করে তার কান্না বয় ঝরনা হয়ে। সেই কান্নার জল আনন্দের জোগান দেয় অন্য কাউকে। আমাদের মধ্যে বুকে পাথর বেঁধে রাখা মানুষের সংখ্যা কি খুব কম? সব মানুষই একেকটা পাহাড়ের মতো। একেকটা সমুদ্রের মতো। প্রত্যেক মানুষই একেকটা মহাকাব্যের মতো। নগরের অলিতে-গলিতে থাকা দলিত পাহাড় মানবেরা সুখী হোক।
দূর থেকে মেঘ তো সবাই দেখেছে, কিন্তু মেঘের একদম মাঝে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছে কজন? সেই আনন্দে গুনগুন করে গেয়ে উঠলাম, ‘মেঘের দেশে পাহাড়ে, আহা রে! আহা রে!’
এসইউ/এএ/এমকেএইচ