মেঘের রাজ্য মেঘালয়ে যেভাবে যাবেন

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৩৯ পিএম, ১২ আগস্ট ২০২০

এটিএম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ

বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বলেছিলেন, ‘ভ্রমণ প্রথমে তোমাকে নির্বাক করে দেবে তারপর তোমাকে গল্প বলতে বাধ্য করবে।’ ভ্রমণপ্রিয় মানুষ আমি, সময় সুযোগ পেলে বেরিয়ে পড়ি পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে এবং অজানাকে জানতে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২০-২১ তারিখ শুক্র-শনিবার দুই দিনে স্কুল জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু (পিপলু) ও তার একজন সহকর্মী (আজাদ) মিলে সিন্ধান্ত নিলাম মেঘালয় ঘুরতে যাবো।

যেহেতু আমাদের তিন জনেরই আগে থেকেই ভারতীয় ভিসায় ডাউকি পোর্ট যুক্ত করা ছিলো। তাই মাত্র এক সপ্তাহের সিদ্ধান্তে আমরা ট্রাভেল ট্যাক্স, ডলার এনডোর্সমেন্ট করাসহ প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে ভ্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছি। এখানে উল্লেখ্য, আমরা এ ভ্রমণের রিটার্ন পরিবহন ব্যবস্থাপনা আগেই করে রেখেছিলাম। বিশেষ করে সিলেট থেকে তামাবিল বর্ডার যাওয়া-আসার মাইক্রোবাস ও ডাউকি বর্ডার থেকে মেঘালয়ে দুই দিন বেড়ানোর প্রাইভেটকার স্কুলজীবনের আরেক বন্ধু ও সিলেটের বাসিন্দা জুলহাস ঠিক করে রেখেছিল।

jagonews24

পরিকল্পনামত আমরা ১৯ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ৫০ মিনিটের সময় এনা পরিবহনের ভলবো বসে রওনা করলাম মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে। পিপলু যেহেতু উত্তরা থাকে, তাই সে উঠলো উত্তরা থেকে। আর পিপলুর সহকর্মী আজাদ অফিসের কাজে আশুগঞ্জ ছিলেন বিধায় উনি বৃহস্পতিবার বিকেলেই সিলেট গিয়ে রাতে হোটেলে ছিলেন।

আমরা ভোর ছয়টায় পৌঁছে গেলাম সিলেট বাস টার্মিনালে। সেখান থেকে একটি সিএনজি চালিত অটো যোগে আমরা চলে আসলাম নুরজাহান হোটেলে, যেখানে আজাদ উঠেছেন। আজাদ আগে থেকেই হোটেলে থাকায় আমার আর পিপলুর জন্য ভালোই হয়েছে, এসে ভালোভাবে ফ্রেশ হতে পারলাম। এর মধ্যে মাইক্রোবাসের ড্রাইভার হোটেলের সামনে এসে ফোন দিয়ে জানালো, সে হাজির। এ ড্রাইভার আমাদের আজ তামাবিল বর্ডারে নিয়ে যাবে এবং আগামীকাল বিকেলে তামাবিল থেকে সিলেটে ফিরিয়ে আনবে।

আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে সকালের নাস্তা করার জন্য চলে আসলাম সিলেটের বিখ্যাত পানসী রেস্টুরেন্টে। সকালে পানসী কানায় কানায় পূর্ণ। বেশিরভাগই সিলেটে বেড়াতে আসা। নাস্তা সেরে আমরা রওনা করলাম তামাবিল বর্ডারের উদ্দেশ্যে। সিলেট শহর থেকে ৫৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তামাবিল বর্ডার। পথে চলতে চলতে ভোরের কোমল প্রকৃতি, চা বাগান, কাজে বের হওয়া মানুষের আনাগোনা দেখতে দেখতে আমরা সোয়া নয়টায় পৌঁছে গেলাম তামাবিল স্থলবন্দরে। পৌঁছে দেখি মেঘালয়গামী অনেক বাংলাদেশি ট্যুরিস্ট। এখানে উল্লেখ্য, তামাবিল ও ডাউকি বর্ডারে ইমিগ্রেশন কর্ম চলে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত।

jagonews24

গাড়ি থেকে নেমে ফরম সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশনের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। মিনিট পনেরোর মধ্যে ইমিগ্রেশন শেষ করে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য আবার লাইনে দাঁড়ালাম। তামাবিল স্থলবন্দরে কাস্টমসের কার্যক্রম ম্যানুয়াল, লাইন খুব ধীরে এগোচ্ছিল। এর মধ্যে মেঘালয়ের ড্রাইভার আলিম মজুমদার হোয়াটসঅ্যাপে কল করে জানালো, সে ডাউকি ইমিগ্রেশন অফিসের পাশে গাড়ি পার্কিং করে দাঁড়িয়ে আছে।

আমরা কাস্টমস শেষে বিজিবি চেক শেষে পায়ে হেঁটে ডাউকি প্রবেশ করে প্রথমে বিএসএফ চেক সেরে চলে গেলাম ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসে। সেখানকার কার্যক্রমও ম্যানুয়াল। বেশ সময় নিয়ে ইমিগ্রেশন শেষ করে আমাদের নির্ধারিত গাড়িতে উঠে রওনা করলাম। ড্রাইভার আলিম মজুমদার খুব আন্তরিক ও চমৎকার মানুষ। তার বাসা শিলং শহরে, সে বাংলা, হিন্দি, খাসিয়া, আসামীয়, ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারে। সে আমাদের সব বিষয়ে সঠিক তথ্য দিত এবং পুরো দু’দিন আন্তরিকতা ও আনন্দের সাথে ঘোরালো। উল্লেখ্য, যারা শেয়ারড জীপে করে ঘুরতে যান; তারা ডাউকি বর্ডার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে এসে জীপস্ট্যান্ড থেকে গাড়িতে উঠবেন।

মেঘের রাজ্য মেঘালয়। বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি প্রদেশ। এ রাজ্যের উত্তর ও পূর্ব দিকে আসাম রাজ্য এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে বাংলাদেশ। মেঘালয় উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর অন্যতম। শিলং হচ্ছে তার রাজধানী। শিলংকে বলা হয় প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৯০৮ ফুট উচ্চতায় শিলংয়ের অবস্থান। খাসিয়া এবং গারো প্রধানত এ দুই জনগোষ্ঠীর বসবাস এ রাজ্যে। মেঘালয় ভারতের তিনটি খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যের মধ্যে একটি। রাজ্যের ৭৫% মানুষ খ্রিস্টধর্মের অনুগামী। বেশিরভাগ খ্রিষ্টান হওয়ায় তারা গরু, শূকর সবই খায়।

jagonews24

খাসি ভাষা ও গারো ভাষা এ রাজ্যের প্রধান দুই প্রচলিত ভাষা। তবে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজির প্রচলনও রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল এলাকা চেরাপুঞ্জির অবস্থান এ রাজ্যে। রয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিননং। মেঘালয়ে অনেক নদী রয়েছে, এদের অধিকাংশই বৃষ্টি নির্ভর ও মৌসুমী। মেঘালয়ের মোট জেলার সংখ্যা ১১টি। পুরো মেঘালয় রাজ্যজুড়ে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যা ভ্রমণপিপাসুদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। পর্বতসংকুল হওয়ায় এ রাজ্যে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম গড়ে উঠেছে।

ডাউকি বাজারে এসে গাড়ি থামলো। ডাউকি বাজার সীমন্তবর্তী একটি ছোট বাজার, বিভিন্ন দোকানে মোটামুটি সব জিনিসের সমাগম আছে। মানি এক্সচেঞ্জ সংখ্যায় কম এবং সাধারণ মুদি দোকানেও এক্সচেঞ্জ করা যায়, এখানে বাংলা টাকার রেট ডলারের চেয়ে ভালো। আমরা দরাদরি করে টাকা এক্সচেঞ্জ করে নিয়ে কিছু প্যাকেটজাত খাবার, জুস কিনে নিয়ে রওনা হলাম।

কিছুদূর এগোতেই আমরা চলে আসলাম ডাউকি ব্রিজের ধারে। যেটা আমরা জাফলং থেকে দেখতে পাই। নিচে প্রবাহমান ডাউকি নদীর স্বচ্ছ পানির উপর দুই পাহাড়ের সংযোগ স্থাপনকারী ব্রিজটি দেখতে ভালোই লাগে। এ ব্রিজ পার হয়েই সব গাড়ি শিলং-চেরাপুঞ্জি অভিমুখে যায়। ড্রাইভার আলিম ভালো ছবি তুলতে পারে। তাকে দিয়েই আমাদের ছবি তোলার কাজ সারলাম। পাহাড়ের নিচে নদীর দুই ধারে খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে, অনেকে আবার নৌকায় করে পর্যটকদের নদীতে ঘুরাচ্ছে। কিছুক্ষণ ওখানে সময় কাটিয়ে আমরা রওনা করলাম পরবর্তী গন্তব্য উমক্রেম ফলসের দিকে।

পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয়জুড়ে দেখা মেলে অজস্র ঝরনা। উমক্রেম ফলস, বোরহিল ফলস, ক্রাংসুরি ফলস, নোকালিকাই ফলস, সেভেন সির্স্টাস ফলস, এলিফেন্ট ফলস, সুইট ফলস, রেংথিয়াম ফলস, স্প্রেড ঈগল ফলস, বিশপ ফলস ও বিডেন ফলসসহ অসংখ্য ঝরনা রয়েছে। চলতি পথে নাম না জানা অনেক ঝরনা চোখে পড়বে। সবগুলো ঝরনা দেখতে গেলে কয়েকদিন সময় লেগে যাবে। আমরা এখন পর্যায়ক্রমে এ দুই ঝরনা দেখতে যাবো, এ দুটির অবস্থান একই পথে।

jagonews24

বেশ কিছু পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম উমক্রেম ফলসের ধারে। পাহাড়ি স্বচ্ছ জলরাশির নয়নাভিরাম একটি ঝরনা। কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে ছবি তুলে এবার রওনা করলাম বোরহিল অভিমুখে। এই পুরো পথটাই বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়ের ভাঁজে। একপাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যেও পাহাড় অন্যপাশে বাংলাদেশের সমতলভূমি, মাঝে মাঝে কাঁটাতারের বেড়া, কিছুদূর পরপর বিএসএফ সীমান্ত ফাঁড়ি পাড়ি দিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের বহনকারী টাটা অল্টো মিনি কার।

কিছু সময় পর আমরা এসে পড়েছি বোরহিল ফলসের কাছে, যেটা বাংলাদেশের পাংতুমাই গ্রাম থেকে দেখা যায়। গাড়ি থেকে নেমে ঝরনার দিকে তাকাতেই আমাদের চোখ ছানাবড়া। বিশাল বিশাল কালচে রঙের পাথরের উপর বেয়ে পড়ছে পাহাড়ি সাদা জলরাশি। দেখে মনে হচ্ছে, এ যেন দুগ্ধধারা বেয়ে পড়ছে। একটি বেইলি ব্রিজের নিচ দিয়ে গড়িয়ে জলধারা এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। অসাধারণ সুন্দর একটি ঝরনা দেখে মনে প্রশান্তি এলো। কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে ছবি তুলে আবার আমাদের যাত্রা শুরু হলো। এবারের গন্তব্য লিভিং রুট ব্রিজ ও এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম ‘মাওলিননং’।

চলবে...

লেখক: কলাম লেখক।

এসইউ/এএ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।