পাহাড়প্রেমীদের অন্যতম তীর্থস্থান হামহাম

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:২৪ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২০

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা বন বিট এলাকায় অবস্থিত হামহাম ঝরনা। স্থানীয়ভাবে একে ‘চিতা ঝরনা’ নামেও ডাকা হয়। এর উচ্চতা নিয়ে কিছুটা মতান্তর রয়েছে। ১৬০-১৭০ ফুট উঁচু ঝরনাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঝরনা হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃত।

পাহাড়প্রেমীদের অন্যতম একটি তীর্থস্থান। অত্যন্ত দুর্গম আর গভীর জঙ্গলে অবস্থিত এ জলপ্রপাত পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রতি পদে পদে যেমন রয়েছে বিপদের ভয়, তেমনি রয়েছে রোমাঞ্চের হাতছানি। সেই রোমাঞ্চের টানেই পাহাড়প্রেমী আমি ও আমরা ১১ জন ২০১৯ সালের ০৫ জুলাই ঘুরে এলাম হামহাম জলপ্রপাত থেকে।

jagonews24

গাড়ি থেকে নামার পর আজানের ধ্বনিতে মুখরিত মৌলভীবাজার। পানসী হোটেলে ফ্রেশ হয়ে রওনা দিলাম আমি মানিক, তালেব, মাইদ, শিপলু, সাঈদ, শুভ, আজাদ, মামুন, এমরান, রফিক ও আলাল। মেঘলা আকাশে ভোরের ঝিরঝির ঠান্ডা বাতাসে আঁকা-বাঁকা, উচু-নিচু পাহাড়ি চা বাগানের পথ ধরে ছুটে চলল আমাদের জীপ গাড়ি। পথের পুরো সময়টা মাতিয়ে রেখেছিল সাথীদের গল্প, গান, আড্ডা আর দুষ্টুমি। পথে সবাই খুরমা ঘাটে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম সঙ্গে চায়ের দেশের বেস্বাদের চা।

একজন গাইড নিতে ভুলবেন না যেন। অত্যন্ত দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে হামহাম পর্যন্ত তিনিই নিয়ে যেতে পারবেন। আমাদের গাইডের সঙ্গে তালেব ও শিপলু গাইডের ভূমিকা পালন করাতে আমাদের ভ্রমণটা আরও সহজ হয়েছে। আনু মিয়ার হোটেলে কাপড় চেঞ্জ করে ব্যাগ রেখে প্রয়োজনীয় জিনিস ও শুকনা খাবার, পানি এবং লবণ-পানি সঙ্গে নিয়ে সবাই রওনা দিলাম।

jagonews24

কুরমা বন বিট রাজকান্দি রেঞ্জ। এখান থেকেই শুরু হবে পায়ে হেঁটে চলা। হামহাম যাওয়ার রাস্তা দুটো। একটি হচ্ছে ঝিরিপথ, আরেকটি হচ্ছে পাহাড়ি পথ। যদিও আমরা দু’পথেই বিচরণ করেছি। বর্ষাকালে এ ঋতুতে যেতে চাইলে আপনাকে পাহাড়ি পথ ধরেই এগোতে হবে। এ পথে আপনাকে পাড়ি দিতে হবে ঘন জঙ্গল, ছোট-বড় কয়েকটি পাহাড় আর ঝিরি।

বনে ঢুকতেই কানে আসবে হঠাৎ অচেনা পাখির ডাক আর অবিরাম ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ডাক। সময় গড়ানোর সাথে সাথে জঙ্গলও ঘন হতে থাকে। আমরা বন্যপ্রাণির দেখা পাইনি। কলা বন, বাঁশ বন দেখে মনে হবে পৃথিবীর সব বাঁশ এখানেই জন্মায়। দু’চোখ যতদূর যায়, বাঁশ আর বাঁশ। ঘন বাঁশ বনের ঝিরিপথটা ঢেকে রেখেছে বাঁশের ছাউনি দিয়ে। অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে ঝিরির পানি পথ দিয়ে। ঝিরিতে পিচ্ছিল পাথর, পড়ে থাকা বাঁশ দেখে না চললে বিপদের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।

জলপ্রপাত পর্যন্ত পৌঁছতে ছোট-বড় কয়েকটি পিচ্ছিল পাহাড়ও পাড়ি দিতে হয়। এ পথে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য দাঁড়ালেও আসবে বিপদ। সেই বিপদ আর কিছুই নয়, দাঁড়ানো মাত্রই চারপাশ থেকে আপনাকে ঘিরে ধরবে অসংখ্য জোঁক। সবাই বলে, হামহামের পথ হচ্ছে জোকদের রাজ্য। এর থেকে বাঁচতে চাইলে যতটুকু সম্ভব শরীর ঢাকা কাপড় পরুন। পায়ে জুতো বা উঁচু বুট পরলে ভালো। আর সাথে লবণ নিতে ভুলবেন না। সাবধানতা অবলম্বনের পরও যদি জোঁক ধরে, তখন লবণই ভরসা। লবণ দিলেই সাথে সাথে ছেড়ে দেবে।

jagonews24

আমাদের সবাইকে ধরেছে। আমাকে ধরেছে সবচেয়ে বেশি। এতে আমার জোঁকভীতি কমেছে। আমি জোঁক ছাড়ানোর চেষ্টা করছি আর দুষ্টু বন্ধু তালেব জোঁকের ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। দু’জন সাথীর জোঁকের কামড়ের ক্ষত দিয়ে রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না। তাই খুব বেশি না থেমে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হেঁটে যাওয়াই ভালো। তবে তাড়াতাড়ি হাঁটলেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ পথ অনেক পিচ্ছিল ও খাঁড়া। পরে গেলে মারা যাওয়ার ভয় না থাকলেও নাক-মুখ বা হাত-পা ভাঙার সম্ভাবনা আছে। আর যেহেতু পাহাড়ি পথে চলে অভ্যাস নেই অনেকেরই। তাই ছোট্ট একটু অসাবধানতাই হতে পারে বড় বিপদের কারণ। মাঈদের পায়ে রগ টান এবং আমরা দু’একবার পড়ে গেলেও বলার মত তেমন চোট পাইনি।

হামহামের কাছাকাছি গেলে ভারত সীমান্ত দেখা যাবে। বিপজ্জনক পাহাড়ি পথ শেষ হলেই দেখা মিলবে ঝিরির। ঝিরির কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও কোমর পানি। নিচে রয়েছে ছোট-বড় পিচ্ছিল পাথর। এ ঝিরি ধরে হাঁটলেই দেখা মিলবে সেই অধরা হামহাম। এ সুন্দরের দেখা পেতেই আমরা গাজীপুর থেকে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় দুষ্টু ছেলের দল ছুটে এসেছি দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে।

jagonews24

আমরা কয়েকজন ভয়ঙ্কর খাড়া পিচ্ছিল পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠার দুঃসাহস করেছি। আপনারা কিন্তু ভুলেও উপরে ওঠার চিন্তা এবং চেষ্টা করবেন না। এতে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। ঝরনার ঠিক নিচেই রয়েছে গভীর খাদ। তাই সাঁতার না জানলে খুব কাছে না যাওয়াই ভালো। ঝরনার পানিতে যত ইচ্ছে লাফালাফি করলেও খেয়াল রাখবেন, আপনাকে আবার সেই দুর্গম পথ হেঁটে পাড়ি দিতে হবে। এ ঘন জঙ্গলে বিকেলের পর সূর্যের আলো পৌঁছায় না। আর অন্ধকারে এ পথ পাড়ি দেওয়ার কথা চিন্তা না করাই ভালো।

আমরাও হামহাম দর্শন শেষে বিদায় নিলাম। আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টি হামহামের শীতল পানি কলকল ছলছল শব্দে জল তরঙ্গ তুলে নিচের দিকে স্ববেগে নেমে আসছে। হামহামের এ উচ্ছ্বল লাবণ্যময় সৌন্দর্য ভোলার নয়। হামহাম ঝরনা বছরের অন্য সময় যেমনই থাকুক, বর্ষায় অষ্টাদশী নারীর রূপ ধারণ করে।

আরো পড়ুন: হামহাম জলপ্রপাত যাওয়ার উপায়, খরচ ইত্যাদি

এসইউ/এএ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।