সিলেটে ঘুরতে গিয়ে কোথায় কী দেখবেন
সময় মানুষকে হাঁপিয়ে তোলে। সময়ের স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে এক সময় ক্লান্তি ভর করে। মনে হয়, এবার একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক। অলিগলি মাড়াতে মাড়াতে জীবনটা কেমন যেন স্রেফ একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। তাই মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কোলাহল ছেড়ে দূরে, বহুদূরে কোথাও পালিয়ে যাই। প্রকৃতির রূপের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেই। নিজের মতো করে রং-রসের সুধা পান করি। এভাবে সময়ের কাছ থেকে পালিয়ে নিজেকে নিয়ে থাকতে পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচার সময় কই? তবুও রোজ ভাবি, যদি সুযোগ আসে, তাহলে সত্যি পালাবো।
বেশ কিছুদিন আগে হঠাৎ একটি মেসেজ এলো- ‘মুকুল, তোমাকে কিন্তু মেসডার (মেহেরপুর ছাত্র উন্নয়ন সংঘ) ট্যুরে যেতে হবে।’ উত্তরে বললাম, ‘ভাই, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। তারপরও খোঁজ নিচ্ছি। আমি পৃথিবীর সব ট্যুর মিস করলেও মেসডার কিছুই মিস করব না। কারণ মেহেরপুর মেসডা আমাকে যা দিয়েছে তো ভুলবার নয়।’
সপ্তাহখানেক আগে মেসডার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখার সভাপতি আশরাফুল জানালো, ‘ভাই, ট্যুরে যেতে হবে আপনাকে। আপনি যাবেন না সেটা আমরা কল্পনা করতে পারবো না। যেভাবেই পারেন প্রস্তুত হন।’ আমারও খুব মন চাচ্ছিল। সিদ্ধান্ত নিলাম ট্যুরে যাব।
এরপর অফিসে গিয়ে বিষয়টি জানালাম। তিনদিনের ছুটি প্রয়োজন। কারণ হিসেবে সত্যটা বললাম। মিলে গেল পাঁচ দিনের ছুটি। বহুদিন ধরে পালানোর সেই সুযোগটি পেয়ে গেলাম। ট্যুরে যাওয়ার দিন ঠিক হলো ১০ এপ্রিল, কিন্তু আমার কাছে সে দিনটি যেন আর আসতে চায় না! তিন বছর আগে ছেড়ে আসা প্রাণের ক্যাম্পাস থেকে ছোট ভাইরা আসবে। তাদের সাথে কতো না মজা হবে। আবার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুভূতি- এসব ভেবে আমার দিন যেন কাটে না!
ইতোমধ্যে জানতে পারলাম, ট্যুরের সব আয়োজন সম্পন্ন। ১০ তারিখ বিকেল তিনটার দিকে রাবি থেকে বাস রওনা দেবে। ঢাকায় পৌঁছবে রাত সাড়ে ১০টার দিকে। আমি আমার মতো প্রস্তুত হয়ে সন্ধ্যার দিকে মিরপুর চলে গেলাম। কারণ আমি আগে মিরপুর থাকতাম। আগেকার কিছু ভালোবাসার মানুষ আছে, তাদের সঙ্গ দিতে হবে। তারাও আমার অপেক্ষায় আছে।
সবাই মিলে গাবতলীতে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমরা ঢাকা থেকে উঠব ৬ জন। বাকিরা সব রাবি থেকে উঠেছে। সব মিলিয়ে ৪১ জনের এক বিশাল দল। কিছুক্ষণ পর গাড়ি চলে এলো। গাড়িতে উঠে চুপ করে বসলাম।
আমার সমস্যা হলো, কেউ নিজে থেকে কথা না বললে পরিচয় হতে ভালো লাগে না। তবে কারও সঙ্গে একবার কথা হলে সে আবার পিছু ছাড়ে না। আস্তে ধীরে সবার সঙ্গে পরিচয় হলাম। গাড়িতে গান-বাজনার আয়োজন আছে। একটু পরেই দেখি ছোট ভাইয়েরা নাচতে নাচতে ক্লান্ত। ভাবলাম, তাদের যখন শেষ আমার তখন শুরু!
শুরু হয়ে গেল নাচ। আমি যেন কোনোভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। আবেগ আমাকে অতিক্রম করে ফেলেছে। সবাই মিলে একসঙ্গে নাচ আর গান। মনে হচ্ছে স্বর্গে আছি। ট্যুরের সবার সঙ্গে আমার তেমন একটা পরিচয় ছিল না। কারণ অনেকে জুনিয়র। কারো কারো সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় ছিল। ঢাকা থেকে উঠেছিলাম রাবির সাবেক সভাপতি আরিফুল ইসলাম আরিফ ভাইয়ের সঙ্গে। একমাত্র মজার বন্ধু মকবুল। এ ছাড়া আরও কায়েকজন ভাই-ব্রাদার।
যাদের পদচারণায় এই ভ্রমণ আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল- আরিফুল ইসলাম প্রতিষ্ঠাকালীন সাবেক সভাপতি রাবি, মুখলেছুর রহমান, প্রতিষ্ঠাকালীন সাবেক সহ-সভাপতি, মকবুল আহম্মেদ এক্সিকিউটিভ এটিএন নিউজ লিমিটেড সাবেক সভাপতি রাবি, আব্দুর রাজ্জাক টিটন প্রভাষক খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়, রাবির সাবেক সেক্রেটারি, মেসডা। মো. জারাফাত ইসলাম, লেখক এবং কাউন্সিলর, বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটি ও ইবির সাবেক সভাপতি, রাছিব নাহিদ সাবেক সেক্রেটারি রাবি।
যাদের নেতৃত্বে এ মনোমুগ্ধকর ট্যুর সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে- আশরাফুল ইসলাম সভাপতি রাবি মেসডা, আশিকুল ইমন সেক্রেটারি রাবি মেসডা, আখতারুজ্জামান সাবেক সভাপতি মেসডা, আল মামুন, সামিদা আক্তার, মৌমিরা খাতুন, মৌলিকা মৌলি, দীপ্ত, মোহনা, সুমনা, সেফা, আয়েশা, রুমি, মারুফ, ফাইজুল, শাহিন, ইসরাত জাহান সিফা, শাহিন রেজা, মো. সাইফুল ইসলাম ডলার, লাল মোহাম্মদ ছাড়াও অনেকে ছিলাম।
> আরও পড়ুন- দু’টি পাতা একটি কুড়ির দেশে
প্রকৃতির ত্রয়ী রূপের সাক্ষাৎ সিলেট ছাড়া তো আর পাওয়া যাবে না কোথাও। শুরু হলো প্রস্তুতি। যেহেতু একসঙ্গে অনেকেই যাচ্ছি, প্রস্তুতিটাও তাই ভিন্নভাবে নিলাম। মনের ভেতর একটু ভয় ভয় লাগছিল। তবুও ভেবে বেশ লাগছিল যে, এবার হারিয়ে যাওয়া যাবে। একান্ত নিজের মতো করে ঘুরে দেখবো মায়াময়ী প্রকৃতিকে।
গাড়িতে সারারাতই জেগে ছিলাম। কারণ, সিনিয়র হিসেবে আমার তো কিছু দায়িত্ব থেকেই যায়। মাঝে মাঝে গাড়ি থামছে, আমিও গাড়ি থেকে নেমে একটু জিড়িয়ে নিচ্ছি। রেস্টও বলা চলে। যথারীতি সকালে নেমে পড়লাম সিলেটে।
লাউয়াছড়া
কমলগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এখানে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য ভান্ডার অকৃপণভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা, বিচিত্র রকমের বন্যপ্রাণী, যেমন- হরিণ, বানর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, বন মোরগ, মেছো বাঘ দেখতে পাওয়া যায়। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় চিরহরিৎ ও মিশ্রচিরহরিৎ বন, যার আয়তন ১ হাজার ২৫০ হেক্টর।
জুলভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে করা ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ ছবিটির একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল এ বনে। বন ঘেঁষে যে রেলপথ চলে গেছে, ঠিক সেখানেই হয়েছে ছবিটির কিছু দৃশ্যের শুটিং। ছবিটির একটি দৃশ্য ছিল এ রকম- ট্রেন ছুটছে। হঠাৎ চালক খেয়াল করলেন, লাইনের সামনে একপাল হাতি আপন মনে চড়ে বেড়াচ্ছে। ট্রেন থেমে যায়। কামরা থেকে নেমে আসেন নায়ক ডেভিড নিভেন; ব্যাপারটা কী দেখতে। সামনের গ্রামেই তখন হচ্ছিল সতীদাহ। নায়ক ছুটে গিয়ে মেয়েটিকে বাঁচান। মেয়েটি শার্লি ম্যাক্লেইন। ছবির এ অংশই চিত্রায়ন করা হয় লাউয়াছড়ার রেললাইন এলাকায়।
বাংলাদেশের একমাত্র জীবিত আফ্রিকান টিকওক গাছটি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আছে। পৃথিবীর মাত্র চারটি দেশে বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক পাওয়া যায় এবং এ উদ্যানেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক উল্লুক দেখা যায়। উদ্যানে বনরুই, অজগর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ প্রায় ২৭৬ প্রজাতির বন্যপ্রাণী আছে। এর ভেতরে রয়েছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী খাসিয়াপুঞ্জি, যারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধারণ করে আছে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর রয়েছে এক, দেড় ও তিন ঘণ্টার তিনটি ট্রেইল, যেখানে পর্যটকরা প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে উপভোগ করতে পারেন।
শ্রীমঙ্গল
প্রকৃতিকে বিরক্ত না করে তৈরি করা এ তিনটি পথে চোখে পড়বে নানা প্রজাতির কীটপতঙ্গ, গাছপালা, পাখি ও অর্কিড। ভাগ্য ভালো হলে হনুমান, বানর এবং উল্লুকেরও দেখা মিলতে পারে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক প্রতিদিন লাউয়াছড়ায় প্রকৃতি ভ্রমণে আসেন। বছরজুড়েই এ বনে পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও, শীতের সময় সবচেয়ে বেশি লোকসমাগম হয়।
চারদিকে সুউচ্চ পাহাড় আর মাঝখানে মাধবপুর লেক। সত্যি অপূর্ব! এটি মৌলভীবাজার শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে ও শ্রীমঙ্গল থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। লেকের ঝলমল পানি, ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ, শাপলা, শালুকের উপস্থিতি মনকে আরও মুগ্ধ করে তোলে। যতই সামনের দিকে এগোতে থাকবেন, ততই ভালো লাগবে।
মাধবপুর লেকে পৌঁছতেই সবুজ পাতার গন্ধ যে কারো মনকে চাঙা করে তুলবে। চারদিকে সবুজ পাহাড়। পাশাপাশি উঁচু উঁচু টিলা। সমতল চা বাগানে গাছের সারি। মাধবপুর লেক যেন প্রকৃতির নিজ হাতে অঙ্কিত মায়াবী নৈসর্গিক দৃশ্য। সুনীল আকাশ আর গাঢ় সবুজ পাহাড়, শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মত চা বাগানের এই মনোরম দৃশ্য নিয়ে যাবে ভিন্ন জগতে।
কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নে পাত্রখলা চা বাগানে মাধবপুর লেকটির অবস্থান। খানাখন্দে ভরা চা বাগানের রাস্তা দিয়ে এ লেকে যেতে হয়। মাধবপুর লেকের ঝলমল পানি, ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ, শাপলা, শালুকের উপস্থিতি মনোমগ্ধকর অনুভূতি জন্মায়। দশটি বাঁক নিয়ে এঁকেবেঁকে পাহাড়ের ভেতর তার চলা। শীতকালে অতিথি পাখির দল আসে এ হ্রদে। হ্রদের জলে গোলপাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে নীল শাপলা। হ্রদের দুই পাশে টিলায় টিলায় ছড়ানো চায়ের গাছ।
মাধবকুণ্ড
বাংলাদেশের সুউচ্চ জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় এ সুন্দর নয়নাভিরাম জলপ্রপাতটির অবস্থান। একসময় পর্যটকদের কাছে প্রাকৃতিক জলপ্রপাত মানেই ছিলো মাধবকুণ্ড। এখন দেশের ভেতরে আরও অনেক ঝরনার সন্ধান মিলেছে। তবে এখনো জলপ্রপাত অনুরাগী পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ মাধবকুণ্ড। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত এ স্থানটিতে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের রেস্ট হাউস ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি যে পাহাড়টির গা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, সেটি পাথারিয়া পাহাড় (পূর্বনাম আদম আইল পাহাড়) নামে পরিচিত। এর বৃহৎ অংশজুড়ে রয়েছে ছড়া। পাহাড়টির উপর দিয়ে গঙ্গামারা ছড়া বহমান। এই ছড়া মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত হয়ে নিচে পড়ে হয়েছে মাধবছড়া। অর্থাৎ গঙ্গামারা ছড়া হয়ে বয়ে আসা জলধারা ১২ অক্টোবর ১৯৯৯ সালের হিসাবমতে, প্রায় ১৬২ ফুট উঁচু থেকে নিচে পড়ে মাধবছড়া হয়ে প্রবাহমান।
সাধারণত একটি মূল ধারায় পানি সব সময়ই পড়তে থাকে। বর্ষাকালে মূল ধারার পাশেই আরেকটি ছোট ধারা তৈরি হয় এবং ভরা বর্ষায় দুটো ধারাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পানির তীব্র তোড়ে। জলের এ বিপুল ধারা পড়তে পড়তে নিচে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট কুণ্ডের। মাধবছড়ার পানি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে হাকালুকি হাওড়ে। মাধবকুণ্ড ঝরনা থেকে ১৫-২০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে রয়েছে আরেকটি ঝরনা, যা পরিকুণ্ড ঝরনা নামে পরিচিত।
বিছনাকান্দি
সিলেট শহর থেকে খানিকটা পথ দূরে। প্রকৃতির আপন লীলাখেলায় মেতে আছে অপার সৌন্দর্যের জলপাথরের ভূমি বিছনাকান্দি। যা সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত। বিছনাকান্দির এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে পাথর আর পাথর। দেখে মনে হবে, পাথরের বিছানা। এ এক অপূর্ব সৌন্দর্য! সারারাত না ঘুমিয়ে এই সৌন্দর্য দেখলে নিমিষেই ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।
মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার পানিতে পা ফেলে মনে হবে পৃথিবীর সব শান্তি এখানে। শুকনো মৌসুমে বিছনাকান্দির আসল সৌন্দর্য চোখে পড়ে না। বর্ষাকালে পানির ঢল জায়গাটিকে মায়ায় ভরিয়ে তোলে। স্বচ্ছ শীতল পানির তলদেশে পাথরের পাশাপাশি নিজের শরীরের লোমও দেখা যাবে স্পষ্ট। দীর্ঘ সময় জলপাথরের বিছানায় শুয়ে বসে ছবি তুলতে তুলতে আর গোসল করতে হয়তো সময়ের হিসেব হারিয়ে ফেলবেন।
বিছনাকান্দির সৌন্দর্য অসাধারণ। দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত শুধু পাথর আর পাহাড়। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, আকাশ আর মেঘের সঙ্গে পাহাড়ের দলগুলো মিশে আছে। যতোই কাছে যাই, পাহাড়গুলো ততোই আকাশ থেকে যেন দূরে যেতে থাকে। এ এক লুকোচুরি খেলা। আর পাহাড়ের গায়ে বেপরোয়া সাদা মেঘের দলগুলো যেন আঠার মতো লেগে থাকে।
পাথর, পানি, পাহাড় আর মেঘ নিয়েই যেন বিছনাকান্দি। এখানে যাওয়ার পর যে কথাটি সর্বপ্রথম মনে হবে, তা হলো প্রশান্তি। এ প্রশান্তিটুকু নিমিষেই ভুলিয়ে দেয় নিত্যকার শত গ্লানি। প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে নাগরিক সভ্যতাকে হার মানতেই হয়। আর এই চরম সত্যটুকু উপলব্ধি করতে হলে আপনাকে যেতে হবে বিছনাকান্দিতে।
জাফলং
প্রকৃতির কন্যা হিসেবে পরিচিত জাফলং। সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে এ জায়গাটি সবার পছন্দ। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা প্রকৃতির দানে রূপের পসরা সাজিয়ে আছে জাফলং। সিলেট থেকে জাফলংয়ের দূরত্ব মাত্র ৬২ কিলোমিটার। পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানির ধারা, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, উঁচু উঁচু পাহাড়ে সাদা মেঘের খেলা জাফলংকে করেছে অনন্য। একেক ঋতুতে জাফলং একেক রকম রূপের প্রকাশ ঘটায়, যা ভ্রমণের জন্য সারা বছরই পর্যটকদের আগ্রহ ধরে রাখে।
> আরও পড়ুন- জীবনে জীবন মেলাবার গল্প
যাত্রাপথে উপভোগ করেছি ঝরনা, মেঘ, পাহাড়-পর্বত। শরতের আকাশ কেমন নীল হয়ে আছে। যেন পাহাড়ের গা ঘেঁষে ছুটে চলেছে কোনো অজানা পথে। মাঝে মাঝে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে বেড়ানোর সুযোগও ছিল। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ এখানে আরো প্রশস্ত, আরো বেশি সবুজ যেন। তামাবিল সড়কের দুই ধারে একটি বিশাল পুকুর। লেকও বলা চলে। পুকুরের টলটলে জলে মেঘলা আকাশের সাদা সাদা মেঘপরীরা ওড়না ছুঁইয়ে ভেসে চলেছে পাহাড়ের চূড়া ঘেঁষে।
মেঘালয় আর শিলং পাহাড়ের গায়ে ঝরনার জল সমতলে নেমে এসে জলার সৃষ্টি করেছে। তাতে স্নানরত এক খাসিয়া নারীকে দেখে মনে হলো, এই বুঝি স্বর্গরাজ্যের অপ্সরী নেমে এসেছে।
বিশাল সে পাহাড় বেঁয়ে গড়িয়ে পড়ছে জাফলংয়ের জলধারা। সেটা পেরোলেই ছোট্ট এক নদী। সেখান থেকে পাথর উত্তোলন করছেন কয়েকজন। নদী পেরিয়ে প্রায় ১ ঘণ্টার পায়ে হাঁটা বালিয়াড়ি, সেখানেই প্রথম চোরাবালির খেলা দেখলাম। নদী পার হতে চোখে পড়লো ঝুলন্ত সেতু, মেঘালয় আর শিলং পাহাড়ের অপরূপ মেলবন্ধন।
সেতুটি দিয়ে ভারতীয় পর্যটকের গাড়ি ছুটে চলেছে শিলং পাহাড়ের উদ্দেশে। আর তার পাদদেশে বাংলাদেশি পর্যটকের ভীড়। সবাই সবাইকে দেখছে, ব্যবধান কেবল সীমান্তে কয়েক হাত দূরত্বের। তবুও এ সীমান্ত পারস্পরিক আনন্দের লেনদেনে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারেনি। বিশাল সে পাহাড় বেঁয়ে গড়িয়ে পড়ছে জাফলংয়ের জলধারা
বালিয়াড়ি পেরিয়ে মায়াবী ঝরনা। কী অসাধারণ সে জলের শব্দ! মগ্ন হয়ে সে শব্দ না শুনে উপায় নেই। মনে হলো, এ তো মাধবকুণ্ডর চেয়েও বেশি কাছে টানছে আমায়। বেশ কিছুটা উঁচু থেকে নেমে এসে পাথরের বুকে আঁছড়ে পড়ছে তার জলধারা। তার চলার পথে যেন দাঁড়িয়ে থাকাই দায়। আর একটু পায়ে হাঁটলেই দেখা যায় প্রান্তরজুড়ে শুধু সবুজ চায়ের বাগান। কিছুদূর সামনে গেলেই দেখা যায় পুরনো সব জমিদার বাড়ি।
পুরো ট্যুর নিয়ে আমার এতো মুগ্ধতা যে, সেগুলো অল্পকথায় বর্ণনা দেওয়া সম্ভব না। ফেরার পথে আবার পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে মনে হলো, শরীর বুঝি বিশ্রাম চাচ্ছে। এবার বিশ্রাম নেওয়ার পালা। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে আমাকে।
এসইউ/এমকেএইচ