তবে একলা চলো রে...

মো. মুখলেছুর রহমান (মুকুল)
মো. মুখলেছুর রহমান (মুকুল) মো. মুখলেছুর রহমান (মুকুল) , সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ০৮:১৬ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮
পাহাড়ের বুক চিরে চারদিকে বয়ে চলছে ঝর্না, স্তরে স্তরে সাজানো নানা রঙের নুড়ি পাথর

সময় মানুষকে হাঁপিয়ে তোলে। সময়ের স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে এক সময় ক্লান্তি চলে আসে ঠিকই। মনে হয় এবার একটু বিশ্রাম নেয়া যাক। এই শহরের এতসব অলিগলি মাড়াতে মাড়াতে জীবনটা কেমন জানি স্রেফ একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় শহরের এই কোলাহল ছেড়ে দূরে, বহুদূরে কোথাও পালিয়ে যাই। প্রকৃতির রূপের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেই। একান্ত আপন করে রং রসের সুধা পান করি। এভাবে সময়ের কাছ থেকে পালাতে পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু সময় কই জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচার। তবুও রোজ ভাবি যদি সুযোগ আসে।

অবশেষে এবার ঈদের পর সুযোগ আসলো এমন অবকাশ যাপনের। অফিস থেকে ছুটি মিললো বেশ কয়েকদিনের। তবে এমন হারিয়ে যাওয়ার মতো সময়ে তো বন্ধুদের পাশে চাই। বন্ধুদের কয়েকজনকে বললাম আমার ইচ্ছের কথা। সবাই সময় চাইলো। বললো ভেবে জানাবে। তাদের ভাবনা আমার অপেক্ষাকে দীর্ঘায়িত করেছে শুধু কোনো সুখবর নিয়ে আসেনি। আর চাইলেও তো যে কাউকে নেয়া যায় না। আমার মতো ভবঘুরেদের আবার সবার সঙ্গে মেলে না। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গানটির কথা মনে পড়ে গেল ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে...’

ঠিক করলাম মেঘ-পাহাড় আর নদী দেখবো। একের ভেতর তিন। প্রকৃতির এই ত্রয়ী রূপের সাক্ষাত সিলেট ছাড়া তো আর পাওয়া যাবে না কোথাও। শুরু হলো আমার একলা চলার প্রস্তুতি। যেহেতু একাই যাচ্ছি প্রস্তুতিটাও তাই ভিন্নভাবে নিলাম। মনের ভেতর একটু ভয়-ভয় লাগছিল তবুও ভেবে বেশ লাগছিলো যে, এবার হারিয়ে যাওয়া যাবে। একান্ত নিজের মতো করে ঘুরে দেখবো মায়াময়ী প্রকৃতিকে।

Tamabil33

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আচ্ছাদিত তামাবিল। সিলেট-শিলং সড়কের বাংলাদেশ অংশে অবস্থিত

সবকিছু ঠিকঠাক করে সন্ধ্যায় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। উত্তর বাড্ডা থেকে বের হয়ে যাত্রাবাড়ী। তবে টিকিট আগে থেকে করে না রাখায় বেগ পেতে হলো কিছুটা। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর অবশেষে রাত ১০টায় বাসের টিকিট পেলাম। তবে একেবারে পেছনের একটা সিট। ওই সিটটা বুঝি আমার জন্যই ফাঁকা ছিলো। উঠে গেলাম গাড়িতে। শুরু হলো আমার একলা চলার যাত্রা।

সারারাতই গাড়িতে জেগেই ছিলাম। কারণ সঙ্গে ক্যামেরা মোবাইল ছিল। ভাবলাম নিজের সেফটি নিজেকেই নিতে হবে সেহেতু ঘুমানো যাবে না। মাঝে মাঝে গাড়ি থামছে, আমিও গাড়ি থেকে নেমে একটু জিড়িয়ে নিচ্ছি। রেস্টও বলা চলে। যথারীতি সকালে নেমে পড়লাম সিলেটের জৈন্তাপুরে। এক ছোট ভাইয়ের বাড়িতে উঠলাম। একটানা ঘুম দিলাম বেলা ১১টা পর্যন্ত।

পরিকল্পনা করেই বের হয়েছি। প্রথমে জাফলং এরপর সুযোগ বুঝে বাদবাকি জায়গাগুলো দেখবো। যদিও আগেও কয়েকবার এখানে আসা হয়েছে আমার। তবুও ভ্রমণের নেশা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

দুপুর ১২টায় বের হলাম। জাফলংয়ে যখন পৌঁছাই তখন বেলা দুটো। যাত্রাপথে উপভোগ করেছি ঝর্না, মেঘ, পাহাড় পর্বত। শরতের আকাশ কেমন নীল হয়ে আছে। যেনো পাহাড়ের গা ঘেঁষে ছুটে চলেছে কোন অজানা পথে। মাঝে মাঝে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে বেড়ানোর সুযোগও ছিল। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ এখানে আরো প্রশস্ত, আরো বেশি সবুজ যেন! তামাবিল সড়কের দুই ধারে একটা বিশাল পুকুর। লেকও বলা চলে। পুকুরের টলটলে জলে মেঘলা আকাশের সাদা সাদা মেঘপরীরা ওড়না ছুঁইয়ে ভেসে চলেছে পাহাড়ের চূড়া ঘেঁষে।

মেঘালয় আর শিলং পাহাড়ের গায়ে দুগ্ধফেননিভ ঝর্নার জল সমতলে নেমে এসে জলার সৃষ্টি করেছে। তাতে স্নানরত এক খাসিয়া নারীকে দেখে মনে হলো এই বুঝি স্বর্গরাজ্যের অপ্সরী নেমে এসেছে।

Mayabi-Jhorana2

নদীর স্বচ্ছধারা এক অপার্থিব মায়াবি সৌন্দর্যের অবতারণা করে মায়াবী ঝর্না

বিশাল সে পাহাড় বেঁয়ে গড়িয়ে পড়ছে জাফলংয়ের জলধারা। সেটা পেরোলেই একটা ছোট্ট নদী। সেখান থেকে পাথর উত্তোলন করছেন কয়েকজন। নদী পেরিয়ে প্রায় ১ ঘণ্টার পায়ে হাঁটা বালিয়ারি, সেখানেই প্রথম চোরাবালির খেলা দেখলাম। নদী পার হতে চোখে পড়লো ঝুলন্ত সেতু, মেঘালয় আর শিলং পাহাড়ের কি অপরূপ মেলবন্ধন।

সেতুটি দিয়ে ভারতীয় পর্যটকের গাড়ি ছুটে চলেছে শিলং পাহাড়ের উদ্দেশে। আর তার পাদদেশে বাংলাদেশি পর্যটকের ভিড়। সবাই সবাইকে দেখছে, ব্যবধান কেবল সীমান্তে কয়েক হাত দূরত্বের। তবুও এ সীমান্ত পারস্পারিক আনন্দের লেনদেনে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারেনি।

Jaflong4

বিশাল সে পাহাড় বেঁয়ে গড়িয়ে পড়ছে জাফলংয়ের জলধারা

বালিয়ারি পেরিয়ে ‘মায়াবী ঝর্না’। কি অসাধারণ সে জলের শব্দ। যেনো মগ্ন হয়ে শুনতে হয়। মনে হলো এতো মাধবকুন্ডর চেয়েও বেশি কাছে টানছে আমায়। বেশ কিছুটা উঁচু থেকে নেমে এসে পাথরের বুকে আঁছড়ে পড়ছে তার জলধারা। তার চলার পথে যেনো দাঁড়িয়ে থাকাই দায়। আর একটু পায়ে পায়ে হাঁটলেই দেখা যায় প্রান্তরজুড়ে শুধু সবুজ চায়ের বাগান। কিছু দূর এগোলেই দেখা যায় পুরোনো সব জমিদার বাড়ি।

আমার এত মুগ্ধতা যে অল্পকথায় তার বর্ণনা দেয়া দেয়া সম্ভব না। ফেরার পথে আবার পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে মনে হলো শরীর বুঝি বিশ্রাম চাচ্ছে। এবার বিশ্রাম নেবার পালা। কাল যে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে আমায়।

এমআরএম/এএসএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।