টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ- প্রথম পর্ব
ঘুরতে সবাই ভালোবাসেন। সুযোগ পেলেই হারিয়ে যান প্রিয় কোনো জায়গায়। মানসিক রিফ্রেশমেন্টের জন্য ভ্রমণে যাওয়াটা মন্দ নয়। তবে কেউ কেউ ঘুরে এসে শেয়ার করেন সবার সঙ্গে। অনেকেই আবার নিজে নিজেই উপভোগ করেন। যারা সবার সঙ্গে আনন্দটুকু ভাগাভাগি করতে চান; তারা ভ্রমণকাহিনি লিখে সবাইকে জানান। তেমনি টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ করেছিলেন তাসলিমা খানম বীথি। বিস্তারিত জানাচ্ছেন আজ প্রথম পর্বে-
১.
‘আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে।’
কোকিলের কুহু ডাক আর গাছে গাছে রক্ত পলাশ, কৃষ্ণচূড়া প্রকৃতির বুকে রঙ ছড়াবে। আম্রমুকুলের আগমনে ঋতুরাজ প্রকৃতি ফুলে মধুময় হয়ে উঠবে বসন্ত। যৌবনের উচ্ছ্বাস আর আনন্দের মন-প্রাণ কেড়ে নেওয়ার প্রথম দিন আজ। নতুন রূপে প্রকৃতিকে সাজাবে ঋতুরাজ বসন্ত। এ ঋতুতে আমগাছ মুকুলিত হয়। মৌ মৌ সুবাসে মুখরিত হয় চারিদিক। ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত।
সেই দিনটি ছিলো ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। বসন্তের প্রথম দিনে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে যাচ্ছি ভাবতেই মনটা কোকিলের মত নেচে উঠলো। পীর স্যারের কথা মনে হতে দ্রুত রেডি হতে থাকি। কারণ তিনি সময়ের প্রতি খুবই সিরিয়াস। স্যারের বাসা আর আমার বাসা প্রায় কাছাকাছি। তাই তিনি আগেই বলে রেখেছেন, যাবার সময় তাদের পরিবারের সাথে নিয়ে যাবেন। নাস্তা শেষ করে স্যারকে সাড়ে ৬টার দিকে কল করি। হ্যালো বলতেই স্যার বললেন- ‘আমরাও রেডি হইলাম, বাসা থাকি বাইর হইবার সময় তোমারে কল দিমু’। মোবাইলের লাইন কাটার পর। পরের কলটির জন্য অপেক্ষায় থাকি। সকাল সাড়ে ৭টায় স্যারের কল আসেনি। সকাল ৮টায় গাড়ি ছাড়ার কথা। পীর স্যারের ফোন কলের অপেক্ষা না করে নিজেই কল করি। হ্যালো বলার আগেই ‘স্যরি’! তোমারে আনতে ভুলে গেছি, রিকশা করে দ্রুত আইও’। স্যারের ‘স্যরি’ বলার কারণ তখন বুঝতে পারি। আমিও ১ মিনিট লেট না করে বাসা থেকে বের হই। ভাগ্য ভালো ফাঁকা রাস্তায় একটি মাত্র রিকশা যাচ্ছিল। ডাক দিতেই রিকশা থামলে দ্রুত উঠে পড়ি। কাজিটুলা এলাকায় আসতেই বশির ভাইয়ের কল- ‘বীথি তুই কোনানো আছোত? তাড়াতাড়ি আয় তর ভাবির খানদাত সিট রাকছি।’ ‘আমি আইলাম বলে’ লাইন কেটে দেই।
> আরও পড়ুন- ঘুরে আসুন হরিণঘাটা বনাঞ্চল
হোটেল হলি সাইডে পৌঁছতেই আমাকে দেখে পীর স্যার বললেন- তুমি কল না দিলে তো চলেই যেতাম। গাড়ি আটকে রাখছি। তোমার জন্য। দ্রুত উঠে পড়। গাড়িতে উঠে ভাবিদের সালাম দিয়ে সিটে বসতেই রোটারিয়ান মিজানুর রহমান এসে হাজির। গাড়ির জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে তিনি অন্য গাড়িতে ঢুকে গেলেন।
২.
সকাল ৮টায় আমাদের গাড়ি পঙ্খীরাজের মত ছুটে চলল প্রকৃতির কন্যা টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্দেশ্যে। পীর স্যারের নেতৃত্বে রোটারিয়ানদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ৪টি গাড়িসহ ভ্রমণ যাত্রা শুরু হয়। সর্বপ্রথম গাড়িটি ছিলো আমাদের। সেই গাড়িতে ছিলেন পীর স্যার, মিসেস পীর, মিসেস বশিরুদ্দিন, পীর স্যারের একমাত্র মেয়ে রিয়া, শামীমা আপা ও রাইসা। আমার পাশে বসা শামীমা আপা জিজ্ঞাসা করলেন, কিসে কাজ করি? বললাম, অনলাইন পত্রিকায় সিলেট এক্সপ্রেসে। ভিজিটিং কার্ড দিতেই তিনি মোবাইলে ফেসবুকে সার্চ দিয়ে সিলেট এক্সপ্রেসের লাইক দিয়ে আমাকেও ফ্রেন্ড করে নিলেন। গাড়িতে প্রথমে কিছুটা নিরবতা। ভেবেছিলাম পুরো ভ্রমণ হয়তো নিরামিষ কাটবে। কিন্তু না। শামীমা আপা বেশ হাসিখুশি। মনে মনে ভাবলাম, যাক কথা বলার একজন সঙ্গী পাওয়া গেলো।
৩.
মদিনা মার্কেটের সামনে আসতেই আমাদের গাড়িটি থেমে যায়। টাঙ্গুয়ার হাওরে যাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আরো কয়েকজন। গাড়ি থামতেই অট্টহাসি দিয়ে পীর স্যার বলে উঠলেন, ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, সিট খালি নাই’। ভাবির সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। সে কথা মনে হতে পীর স্যার ভাবিকে বললেন, ‘বীথিরে চিনছোনি, অনলাইন পত্রিকা সিলেট এক্সপ্রেসে কাজ করে।’ ভাবি জবাব দেন, ‘বীথি’র লগে মাত অইছে’। স্যার ড্রাইভারকে গান অন করার কথা বললেন। গান ছাড়া কী ভ্রমণ জমে। কখনও না। আমিও খুব মিস করছিলাম গানকে। যা-ই হোক। গানের জন্য পীর স্যারকে মনে মনে ধন্যবাদ দেই। হাসন রাজা, লালন শাহ, শাহ আব্দুল করিমের গানে জমে উঠে আমাদের ভ্রমণ।
৪.
ভাবিদের জীবনে ফেলে আসা বসন্তের কথা বলছেন। সেইদিনগুলো কত রঙিন ছিলো, কত আনন্দের ছিলো। তারা কথা বলছেন আর উচ্ছ্বসিত হচ্ছেন। আমি আর শামীমা আপা কথা বলছি সাহিত্য নিয়ে। তিনিও কবিতা লেখেন। ভ্রমণের শুরুতে নিরবতা পালন করে আসছে রিয়া। তার সাইলেন্ট থাকা দেখে ভাবছি সে কীভাবে কথা না বলে থাকছে। আমি হলে এতক্ষণ বোমার মত ফুটে যেতাম। জাউয়াবাজার আসতেই ভাবলাম চলে আসলাম নাকি। কিন্তু না। এখনো অনেক দেরি। তখন পীর স্যার একটি বাড়ি দেখিয়ে বললেন, ‘এটি হচ্ছে মঞ্জিলা পলা উদ্দিনের বাড়ি।’ পাশেই সুরমা নদী বয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ রোডে ভটের খাল নদী দেখি। স্যার বলছেন, ‘এটির নাম ভট্টাচার্য থেকে ভটের খাল নদী হয়েছে।’ তখন মিসেস পীর বললেন, ‘বটগাছ থেকেও হতে পারে এটির নাম।’
> আরও পড়ুন- মন হারায় ধরন্তির ঘোলা জলে
৫.
নীল আকাশের নিচে সারি সারি গাছপালা, সবুজ ধানক্ষেত, পুকুর, পানিতে সাঁতার কাটা হাঁসের দল। কতদিন এসব দৃশ্য দেখি না। পীর স্যার বললেন, ‘জাউয়াবাজার হচ্ছে সবচেয়ে বড় গরুর হাট। আজ বাজার বসছে। লোকজন ভিড় করছে বাড়ির জন্য বাজার করতে।’ এ সময় স্যার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন সাঁতার জানি কিনা? বললাম- না। উত্তর শুনে মিসেস পীর বললেন, ‘তুমি যত বড় মানুষ বা সাংবাদিক হও না কেন? সাঁতার না জানলে সব মাটি হয়ে যাবে।’ ভাবির কথা শুনে পীর স্যার বললেন, ‘আমি যদি পানিতে ডুবে যাই তাহলে নাকি ড্রোন আনাবেন আমাকে উদ্ধার করতে।’ এ কথা শুনে সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলেন।
৬.
সকাল সাড়ে ৯টায় আমাদের গাড়ি এসে থামে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড। মেজর ইকবাল রোডের সুনামগঞ্জ হোটেল ও নূরানী মোল্লা রেস্টুরেন্টের সামনে। গেস্টরুম দেখে মনে হলো, হয়তো ভ্রমণ শেষে থাকা হবে। মিজান ভাই আসতেই তাকে বললাম, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরে কী রাত হয়ে যাবে? তারপর কী আমরা এখানে থাকবো।’ ‘টাঙ্গুয়া ঘুরে আপনাকে রেখে চলে যাব সিলেটে। হা... হা।’ তিনি হেসে উঠলেন। বুঝতে পারলাম। থাকবো না। রুমে বসেই পরোটা, ডিম ভাজি ও সবজি দিয়ে নাস্তা করি সবাই। গাড়িতে ওঠার আগে মিজান ভাইয়ের মোবাইল ক্যামেরার ক্লিকে বন্দি হই আমরা। নাস্তা শেষ করে যে যার গাড়িতে উঠতে শুরু করেন। এদিকে আমাদের গাড়ি ড্রাইভার তেল নিতে গিয়ে আসার নাম নেই। অন্যদেরকে পীর স্যার বললেন, ‘তাহিরপুর ব্রীজে গিয়ে যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করেন। এ সময় আমরা হোটেল নূরানীতে বসে চা খাওয়ার মধ্য দিয়ে হালকা আড্ডা দেই।
৭.
সকাল সাড়ে ১০টায় আবারো আমাদের গাড়ি ছুটে চলল টাঙ্গুয়ার হাওরের দিকে। সময় নষ্ট করার জন্য গাড়িতে উঠেই স্যার রেগে গিয়ে ড্রাইভারকে ঝারি দিলেন। তাকে কখনো রাগ করতে দেখিনি। রাগ করে কথা বলার সময় স্যারের মুখটি রক্তজবার মত লাগছিল। এই প্রথম রাগাম্বিত মুখটি দেখলাম পীর স্যারের। তাহিরপুর ব্রিজে এসেই আমরা বাকিদের পেয়ে যাই। প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে মিসেস পীর বললেন-
‘আমাদের দেশটারে কত ভালোবাসি
সবুজ ঘাসের বুকে শেফালীর হাসি
মাঠে মাঠে চড়ে গরু নদী বয়ে যায়
জেলে ভাই ধরে মাছ মেঘের ছায়ায়।’
চলবে...
এসইউ/এমএস