পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : ষষ্ঠ পর্ব
১৪ ফেব্রুয়ারি। আজকের পথটা বেশ লম্বা। প্রায় ৩২ কিলোমিটার। ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুতি নিলাম। ৬টায় হাঁটা শুরু করলাম। সকালের খাবার না খেয়েই রওনা হয়েছি। তবে রওনা দেওয়ার সময় ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার চা পানের নিমন্ত্রণ করলে না করিনি। ভদ্রলোক রাতে খাওয়ানোর কোনো আগ্রহই দেখাননি। তাই রাতে আমিও তার সাথে তেমন ভাব করিনি। এখন যেহেতু চা পানের অফার করছেন, তাই একটু যাওয়ার বেলায় ভাব করে যাই। দোকানদার খুব আয়েশিভাবে পা দুটো ভাঁজ করে বসে চা বানাচ্ছেন আর আড়চোখে আমাকে দেখছেন। বুঝতে পারলাম না তিনি ওভাবে দেখে আমাকে নিয়ে কী ভাবছেন? তবে এটুকু বুঝতে পারলাম, দোকানদারির সাথে সাথে সারাদিন তিনি পান মুখে তৃণভোজীর মতো জাবর কাটেন। পান খাওয়া লাল মুখে তিনি ভালো হেসে হেসে কথা বললেন। তবে যে পরিমাণ পানের রস-সমৃদ্ধ থু-থু আমাদের চায়ের কাপে এসে পড়ছে তাতে পানের কিছুটা পুষ্টি গুণাগুণ চায়ের সাথে ফ্রি পেয়ে গেলাম।
হেঁটে চলেছি একা। ফেব্রুয়ারির শীতের সকাল। যখন বের হয়েছি তখন পুবাকাশে সূর্যের রক্তিমাভা দেখেছি। মনে হলো রোদময় সকাল পাবো। কিন্তু না! চারদিক শীতল করে কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেল। দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। গাড়িগুলো হর্ন বাজিয়ে লাইট জ্বালিয়ে পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। রাস্তায় ভোরবেলায় বাস ও ট্রাকই বেশি চলে। দূর থেকে গাড়ির লাইট দেখলেই বুঝতে পারতাম কোনটা বাস আর কোনটা ট্রাক। বোঝার একটা কারণও আছে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ ট্রাকের এক চোখ খোলা থাকে। একচোখ মানে হেড লাইট। হয় দু’টা লাইটের একটা নষ্ট, না হয় দু’টাই নষ্ট। একটা বিকল্প লাইট মাঝখানে লাগিয়ে নিয়েছে। ভোরবেলার গাড়ি অনেকটা ভীতিকরও হয়। ড্রাইভাররা সারা রাত জেগে গাড়ি চালান। ভোরবেলায় ঘুমে দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আর রাস্তায় গাড়ি কম থাকায় ড্রাইভাররা ঘুমচোখে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাড়ি চালান।
আরও পড়ুন- পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : প্রথম পর্ব
আমি দাঁড়িয়ে আছি একদল কৌতূহলী মানুষের ভিড়ে। একটি ট্রাক রাস্তা থেকে নেমে পাশের একটি গাছের সাথে আটকে আছে। ট্রাকটির সামনে ভোঁতা হয়ে গেছে। লোকমুখে জানতে পারলাম, ঘণ্টাখানেক আগে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। একজন মারা গেছেন আর দু’জনকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। আমি হেঁটে চললাম। মনের ভেতরে একটু ভয় কাজ করছে। তাই যতটা সম্ভব রাস্তা থেকে নেমে হাঁটলাম।
কুয়াশা কমছেই না। যতক্ষণ হাঁটি শীত কম মনে হয়। আবার যখন থামি তখন শীত বেড়ে যায়। প্রায় দশটার কাছাকাছি এখনো সকালের খাবার হলো না। লম্বা রাস্তা হেঁটে এলাম। অচেনা পরিবেশ। মনে হচ্ছিলো হলিউডের কোন ভৌতিক মুভির রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। মানুষ নেই রাস্তায়। আশেপাশের তেমন কিছু দেখা যায় না। শীতল বাতাস। শুধু পাশ কাটিয়ে গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ। বাড়ি-ঘর রাস্তা থেকে দূরে দূরে। খাবারের মতো কোন দোকান বা বাজার নেই।
পা আর চলছে না। সম্ভব হলে পা দুটো অনশন করতো। খাবার না পেলে আমরা আর সামনে এগোব না। শরীরটাও দুর্বল হয়ে আসছে। শক্তিও কমে আসছে। তার মধ্যে তো পিঠে বোঝা আছেই। হাঁটতে হাঁটতে ছোট বাজারের দেখা মিললো। একটি খাবার হোটেল পেলাম। সোজা ঢুকে পরলাম ভেতরে। ডিম ভাজি দিয়ে রুটি খেলাম। খাবার সময় পরিচয় হলো মোতালেব নামের এক বয়স্ক লোকের সাথে। বয়স ষাট কি পঁয়ষট্টি হবে। বয়সের ভারে ক্লান্ত, চোখেও মোটা ফ্রেমের চশমা, চুলগুলো দেখে মনে হচ্ছে শরতের কাশবন। জীবনের প্রায় পুরো সময়টা তিনি শিক্ষকতা করেছেন। এখন অবসরে আছেন। তবে তার বড় পরিচয় তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আরও পড়ুন- ঈদে হিমালয় কন্যার দেশে
খাবার শেষে তিনি আমাকে খাবারের বিল দিতে দিলেন না। আমি যে পথে যাবো; সেই পথেই তার বাড়ি। তাই তিনি আমার সাথেই হাঁটতে শুরু করলেন। আমারও ভালো লাগতে শুরু করলো। বয়স্ক হলেও তো কিছু সময়ের জন্য কাউকে পেলাম। যুদ্ধের সময় তিনি তরুণ যুবক ছিলেন। যৌবনের তেজ ছিলো বুকভরা। দেশকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলেন। আমি খেয়াল করলাম, তিনি খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘পায়ে ব্যথা পেয়েছেন? খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছেন?’ তিনি বললেন, ‘না, ব্যথা পাইনি। এটা আমার যুদ্ধের স্মৃতি।’ আমি তার যুদ্ধজীবন সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি খুব উৎসাহিত হয়ে বললেন।
তিনি একবার পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণের জন্য রেকি করতে যান। তারা ছিলেন দু’জন। রাতের অন্ধকারে বনের ভেতর দিয়ে ক্যাম্পের কাছে যান। ক্যাম্পটি ছিলো একটি মাদ্রাসায়। অন্ধকারের মধ্যেই দু’জনে রেকি করছেন। খুব কাছ থেকে। হঠাৎ করেই কুকুর ডেকে ওঠে। সেই কুকুরের শব্দে পাকসেনারা টের পেয়ে যায়। কোন উপায় না পেয়ে তারা দৌড়ে পালান। অন্ধকার থাকায় রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। তার সাথে যিনি ছিলেন; তিনি একটি ভাঙা পরিত্যক্ত পায়খানার ভেতরে পরে যান। পেছনে পাকসেনারা। কী এক ভয়ানক রাত! প্রায় দুই ঘণ্টার মতো ওই সাথের জন পায়খানার ভেতরেই ছিলেন। আর তিনিও পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেন। কোন মতে সেই রাতে নিজেদের জীবন নিয়ে ফিরে আসেন। সেদিনের কথা বলতে গিয়ে বারবার কথা আটকে আসছিলো। আমি বুঝতে পারছিলাম সেই ভয়াল রাতটা তাদের জন্য কতটা কষ্টের ও ভয়ের ছিল।
হঠাৎ গল্প থামিয়ে বললেন, ‘আমার বাড়ির কাছে চলে এসেছি।’ আমি এগিয়ে চলেছি। তিনি কিছুসময় দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছিলেন। এখন আর তেমন কুয়াশা নেই। কুয়াশা আর সূর্যের লুকোচুরি চলছে। একটি অপরিচিত নম্বর থেকে আমার মোবাইলে ফোন এলো। ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে বললেন, ‘আপনি যে এক মুক্তিযোদ্ধার সাথে পরিচিত হয়েছেন, আপনার সাথে কিছু পথ হেঁটেছেন; তিনি আমার শ্বশুর। তিনিই আপনার নম্বর দিয়েছেন। আপনি যশোর শহরে ঢুকেই আমাকে ফোন দেবেন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।’
আরও পড়ুন- সাইকেলে চড়ে চন্দনের হিমালয় জয়
প্রায় দুপুর দু’টার দিকে যশোর পৌঁছলাম। ওই ভদ্রলোককে ফোন দিলাম। তিনি এসে আমার সাথে দেখা করলেন। যশোর প্রেস ক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনের ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল। এটা অবশ্য দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সেখানে সংবাদ সম্মেলন শেষ করে আমরা দুপুরের খাবার খাই। মোতালেব সাহেবের মেয়ের জামাইয়ের নাম সাখাওয়াত। তিনি এখানেই থাকেন। খুব বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ। তিনি যশোর মনিহার সিনেমা হলের সামনে থেকে আমাকে একটা সানগ্লাসও কিনে দেন।
যশোর শহর থেকে বের হওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে তিনি রয়ে গেলেন আর আমি এগিয়ে চললাম আজকের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। বাঘারপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে ফোনে কথা হলো। আমার অবস্থান জানালাম। তিনিও জানালেন তারা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। এখন হাঁটার গতিটা একটু বাড়াতে হলো। আজ অনেক সময় ব্যয় হয়ে গেছে। এখনো অনেক পথ বাকি। এদিকে সন্ধ্যাও আসি আসি করছে। হামিদপুর বাজারে এসে একটু বিশ্রামের জন্য থামলাম। একটি চায়ের দোকানে অনেক মানুষ বসা। সেখান থেকে কেউ একজন আমাকে ডাকলো। আমি কাছে গেলাম। সবাই হা করে তাকিয়ে আমাকে দেখছে। মনে হচ্ছে- এরকম প্রাণি তারা আগে কখনো দেখেনি। একজন আমাকে বললেন, ‘ভাতিজা, তুমি কি কানা?’ আমি বললাম, ‘না, আমি অন্ধ না।’ তিনি বললেন, ‘তাইলে এই লাঠি নিয়ে হাঁটছো ক্যানো? আর কানারা তো সাদা লাঠি ব্যবহার করে।’ তারা আমার সম্পর্কে জানতে চাইলে আমি বললাম। তারা শুনে বাহবা দিতে শুরু করলেন। পাশের মিষ্টির দোকান থেকে দই আর মিষ্টি এনে দিলেন। সময় নেই বলে সেগুলো খেয়েই আবার হাঁটা শুরু করি।
দোরাস্তা বাজার থেকে বামে চলে গেছে বাঘারপাড়ার রাস্তা। উপজেলা চেয়ারম্যান আমাকে আগেই বলে দিয়েছেন, দোরাস্তা বাজার থেকে যেন বামের রাস্তায় যাই। তবু আমি স্থানীয় লোককে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নেই। মেইন রোড হয়ে এখান থেকে ভেতরের দিকে যাচ্ছি। পথটুকু আমার হিসেবের মধ্যে ছিল না। চেয়ারম্যান বলেছিলেন আমি যেন এখান থেকে গাড়িতে বাঘারপাড়া যাই। কিন্তু আমার মন চাইলো না। যেহেতু হাঁটতে এসেছি; সেহেতু কোথাও গাড়িতে উঠবো না। বেশি হাঁটতে হয়, হাঁটবো।
আরও পড়ুন- পাহাড়-ঝরনাকে বাঁচতে দিন!
গ্রামের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা। ধান ক্ষেত, তালগাছের সারি- সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, আমার জন্য এ রাস্তাটা বোনাস। এতো সুন্দর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে। ক্লান্তিও চলে গেছে। তবে চিন্তার বিষয় হলো- পশ্চিমাকাশ রক্তিম করে সূর্য আজকের মতো বিশ্রামে চলে গেল। অপরিচিত জায়গা। আমি একদম একা। বড় বড় বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে রাস্তা। চারদিক অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। এদিকে রাস্তাও শেষ হচ্ছে না। সত্যি খুব ভয় পেয়েছি।
রাত সাড়ে আটটার দিকে বাঘারপাড়া এসে পৌঁছাই। এখানে উপজেলা চেয়ারম্যান তার লোকজন নিয়ে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। তারা আমাকে প্রথমে ফুলেল শুভেচ্ছা জানালেন। তারপর আমাকে উপজেলা ডাকবাংলোতে নিয়ে গেলেন। সবার সাথে পরিচয় হলো। কিছুসময় আমার সাথে গল্প করে তারা চলে গেলেন। ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার আমার জন্য খাবার নিয়ে এলেন। আমি গোসল সেরে খেতে বসে গেলাম। খাবারটা বেশ মুখরোচক ছিল।
শরীরটা বেশ ক্লান্ত। আজ পরিশ্রম, আনন্দ, ভয় সবকিছুই বেশি ছিল। যা হোক, গন্তব্যে ভালোভাবেই পৌঁছতে পেরেছি- এটাই মূল কথা। আস্তে আস্তে শরীর ব্যথায় জমে যাচ্ছে। ঢাকাতে সেলিম ভাইকে ফোনে আজকে আমার অবস্থান জানালাম। তিনি আমাকে সকালে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিভিল সার্জনের সাথে দেখা করতে বললেন।
ঘুমে দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। জোর করেও চোখ খুলে রাখতে পারছি না। আর শরীর তো ব্যথায় টনটন করছেই। এখন ঘুমাই। সকালে আবার শুরু হবে আমার স্বপ্নের যাত্রা।
এসইউ/আরআইপি