পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : পঞ্চম পর্ব

ইকরামুল হাসান শাকিল
ইকরামুল হাসান শাকিল ইকরামুল হাসান শাকিল , পর্বতারোহী ও লেখক
প্রকাশিত: ০৭:৩৮ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

১৩ ফেব্রুয়ারি। আজ রাতের ঘুমটা মনে হলো খুব আপন আপন ছিল। স্বদেশ বলে কথা। ভোরেই ঘুম ভাঙলো। হোটেল থেকে বের হয়ে সকালের বেনাপোল শহরটা ঘুরে দেখছি। ধোঁয়া ওঠা গরম চা খেয়ে শরীরটা একটু চাঙা করে নিলাম। বাম পায়ের গোড়ালিতে ফোসকা পড়েছে। হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। রাতে যেখানে খেয়েছি সেখানে বলা ছিলো, তাই সকালের নাস্তাটাও সেখানেই করে নিলাম। হোটেলে চেক-আউট করে প্রেস ক্লাবে চলে এলাম। অপ্রয়োজনীয় ও ময়লা পোশাকের প্যাকেট প্রেস ক্লাবের পিয়ন বাবুলের কাছে রেখে দিলাম। সে সময় করে কুরিয়ারে ঢাকা পাঠিয়ে দেবে।

সকাল আটটায় প্রেস ক্লাব থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। মহসিন মিলনসহ আরো কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আজ থেকে আমাকে একা একা চলতে হবে। ভারতের অংশে যেমন সাথে লোকজন, পুলিশ ও গাড়ি ছিল এখন আর এসব থাকবে না।

Kolkata

আমার পোশাক আর গেটআপ দেখে রাস্তার মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তাদের এমনই কৌতূহল যে, আমি হয়তো ভিনগ্রহের প্রাণি। তবে হয়তো তেমনটাই ছিল। আমাকে জানতে মানুষ কাছে আসে। কেউ পেছন থেকে ডেকে থামান। তবে যতটা সম্ভব চলার মাঝেই তাদের সাথে কথা বলতাম। হাঁটতে আজ কিছুটা কষ্টই হচ্ছে। একা বলে হয়তো। তবে এটা অনুভব করতে পারছি যে, আমি নিজের দেশে আছি। তখন বুঝতে পারলাম সীমানার এপার-ওপারের তফাৎ কী? আমাদের সাথে তাদের ভাষাসহ আরো অনেক কিছুই মিল আছে। তবে আমরা বাঙালি তারা ভারতীয়। এই তফাৎটাই বোঝা যায় সীমানায় পা দিয়ে।

অনেক কথাই হলো। এখন আমার এ দীর্ঘ পথ হাঁটার আসল উদ্দেশ্যটা বলি। হয়তো ভাবতে পারেন শুরুতে না বলে এখন বলছি কেন? ভেবেছিলাম একটু কৌতূহল নিয়েই পড়ুন। এমনিতেই আমার উদ্দেশ্যটা খুঁজে পাবেন। সেটা আর পারলাম না। আজ দেশের বেশ কয়েকটি জাতীয় সংবাদমাধ্যমে আমাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের কারণেই মুখ খুলতে হচ্ছে। আমরা বাংলায় আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করি। এ ভাষাই আমাদের মায়ের ভাষা, মায়ের কাছ থেকে শেখা ভাষা। এ ভাষার জন্যই ১৯৫২ সালে জীবন দিতে হয়েছে। খালি হয়েছে মায়ের বুক। রক্তে লাল হয়েছে পিচ ঢালা রাজপথ। তারপর ১৯৭১ সালে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে দীর্ঘ নয় মাস। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি স্বাধীনতা। পেয়েছি একটি লাল-সবুজের পতাকা, পেয়েছি মানচিত্র। দেশের জন্য মায়ের বুক খালি হয়েছে, ভাই হারিয়েছেন বোন, পিতা হারিয়েছেন সন্তান, সন্তান হারিয়েছেন পিতা, স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামী। এই দেশের জন্যই ঘর ছেড়ে যুদ্ধে গিয়েছেন বাংলা মায়ের সন্তানরা। কেউ বিজয়ী পতাকা হতে ফিরে এসেছেন, কেউ আসেননি। হারিয়ে গেছেন চিরদিনের জন্য। তারা দেশেরে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পায়ে হেঁটে গিয়েছেন বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে। তারা কঠিন ত্যাগ স্বীকার করেছেন দেশকে ভালোবেসে।

Kolkata

আজ তরুণ প্রজন্ম ২০১৩ সালে এসে দেখছি সেই রক্তে কেনা বাংলাদেশ। একাত্তর কেমন ছিলো আমরা জানি না। সেই হিংস্রতা আমরা দেখিনি। সেই রক্তাক্ত শকুন ওড়া লাশের গন্ধযুক্ত দেশ দেখিনি। শুধু বছরে কয়েকটি দিবসে বন্দি বাংলাদেশকে আমরা দেখি। সেইসব দিবস পালন করতে হয়, তাই করি। দেশের জন্য যারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন তাদের আমরা কতটা মনে রাখতে পেরেছি? যারা আজও বেঁচে আছেন; তাদের কেমন দিন কাটছে- সেই খবর আমরা কতটা রাখছি?

এসব আমার মনে বেশ নাড়া দিতো। তাই সেইসব মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমার এই পদযাত্রা। এর ফলে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলতে পারবো। তাদের মুখে শুনতে পারবো যুদ্ধের সেই ভয়াল কাহিনি। যা আমাকে অনুপ্রাণিত করবে এবং সঠিক ইতিহাস জানতে সহায়তা করবে।

Kolkata

আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল। তা হলো, একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো সেই দেশের তরুণ সমাজ। তারাই দেশকে নিয়ে যাবে সামনের দিকে। তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে দেশ। আর এই তরুণ সমাজই আজ মাদকের নেশায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তারা মাদকের পেছনেই ছুটে চলছে। আমি সেই তরুণ সমাজের একজন। তাই তরুণ সমাজকে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করতেই আমার এই হেঁটে চলা। আমি চাই- আমাকে দেখে তরুণ সমাজ মাদক ছেড়ে সুন্দর জীবনে ফিরে আসুক। তাই ‘মাদক ছেড়ে নিয়মিত হাঁটুন, ভাষা আন্দোলনের চেতনায় দেশ গরবো আমরা তরুণ’- স্লোগানে এই পদযাত্রা।

বেনাপোল শহর ছেড়ে এসেছি অনেক আগেই। রাস্তার দু’পাশে গ্রাম আর ফসলের জমি। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বিজিবি চেকপোস্টে। এখানে গাড়ি থামিয়ে চেক করা হয়, গাড়িতে অবৈধ কোন মালামাল আছে কি না। আমাকে তারা দূর থেকেই দেখছে। ছোট একটা ছেলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে। হলুদ রঙের টি-শার্ট বলেই দূর থেকে বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। হাতে লাঠি, কাঁধে বড় আকারের ব্যাগ। তাই তারাও কৌতূহলী হয়েছে। চেকপোস্টের কাছে আসতেই আমাকে থামালেন। আমি কে? কী করি? কোথা থেকে এসেছি? আরো অনেক প্রশ্ন। সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর তারা খুবই উৎসাহী হলেন। আমাকে তাদের ওখানে বসতে দিলেন, চা খেতে দিলেন এবং সব শেষে আমার সাথে তারা ছবিও তুললেন।

Kolkata

দু’পায়ের অবস্থাই খারাপ। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছি। রাস্তায় এখন তেমন মানুষ নেই। রাস্তার দু’পাশেই ফসলের জমি। বাড়ি-ঘরও নেই। সেই দূরে গ্রাম দেখা যায়। কাগজপুকুর নামক একটি জায়গায় রাস্তার পাশে চায়ের দোকান। দোকানের কাছে এসে থামলাম। একটু বিশ্রাম নেবো বলে। সেখানে দু’জন লোক ও দোকানের ভেতরে বয়স্ক লোক। সেই বুড়ো দাদুকে বললাম, ‘এক কাপ চা দেন তো।’ তিনি চা দিলেন। তার সাথে কথা হলো। আমাকে বেশ উৎসাহ দিলেন। বৃদ্ধ দোকানদার যুদ্ধের সময় ২৪-২৫ বছর বয়সী তরুণ ছিলেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি। তবে যুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন। সে সময় তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তাই তাকে ফেলে যেতে পারেননি। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করে ক্যাম্পে দিয়ে আসতেন। তিনি জানতে পেরেছিলেন, মসজিদের ইমামদের পাকসেনারা হত্যা করে না। তাই পাঞ্জাবি, পাজামা ও টুপি পরে থাকতেন। ফলে তিনি সহজেই চলাফেরা করতে পারতেন। সেই সুযোগে তিনি পাকসেনাদের খবর মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছেন। তবে আজ তিনি স্বীকৃত কোন মুক্তিযোদ্ধা নন। তখন তিনিও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এসব করেছেন। শুধু বাড়ি ছেড়ে যেতে পারেননি। তিনিও স্বীকৃতি চান। কথাগুলো বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেললেন। চোখের জলও চিৎকার করে বলছে, এই দেশের স্বাধীনতায় আমারও ভাগ আছে।

Kolkata

সত্যি, দেশের সোনার ছেলেরা কতভাবেই না যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আমরা ক’জন তাদের সম্পর্কে জানি। আমাদের চারপাশে হয়তো এরকম আরো কতো মুক্তিযোদ্ধা আছেন। যারা হয়তো স্বীকৃতি পেয়েছেন বা পাননি। তাদের কথা কেউ জানে বা জানে না। এখন তো আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি, কথা বলতে পারছি। একসময় আসবে যখন তারা থাকবেন না। তখন ইতিহাসের পাতা ছাড়া কোথাও পাওয়া যাবে না।

পথে একজন ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হলো। তিনি একটি এনজিওতে চাকরি করেন। কথায় কথায় চলে এলাম একটি ছোট বাজারে। বাজারে তার বেশ পরিচিতি আছে। তিনি আমাকেও অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাকে দুপুরের খাবার খাওয়ালেন এবং নিজেও খেলেন। খাওয়া শেষে তিনি আধা কিলোমিটারের মতো এগিয়ে দিলেন।

সন্ধ্যার দিকে ঝিকরগাছা এসে পৌঁছলাম। সেখানে আমাকে রিসিভ করলেন স্থানীয় পত্রিকার একজন সাংবাদিক। তিনিই আমার সাথে দুপুরের দিকে ফোনে যোগাযোগ করেন। আমাকে উপজেলা ডাকবাংলোতে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাকে সেখানে রেখে চলে গেলেন। এরপর ঝিকরগাছা বাজারে কিছু সময় কাটালাম। অনেক দিন পরে গরুর দুধের চা খেলাম। রাতের খাবার খেয়ে আবার ডাকবাংলোয় চলে এলাম। পায়ের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। শরীর ব্যথাও কমছে না। সারা শরীরে মুভ লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সারা দিনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম?

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।