২০ টাকায় রাজধানীতে নৌভ্রমণ
‘মাথার ওপরে সুনীল আকাশ; তাতে বিক্ষিপ্ত মেঘবালিকার ক্ষণে ক্ষণে লুকোচুরি। নিচে স্রে্াতসিনীর কুল কুল ধারা। নদীপাড়ে কাশবন। পাড়ঘেঁষে থাকা দ্বীপসদৃশ বসতবাড়ির বড় কোনো গাছ থেকে হঠাৎ শ্বেতশুভ্র একঝাঁক বকের উড়ে যাওয়া। স্বর্পিল আকৃতিতে বহমান নদের জলরাশিতে পশ্চিমে ডুবতে বসা সূর্যের রক্তিম অবয়ব’- এমন অপার নিসর্গ চকিতে দেখে মনে হবে, শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো মূর্ত হয়ে ওঠা ছবি।
প্রকৃতির এ অপার নৈসর্গের দেখা মেলে রাজধানীর কোলঘেঁষে নিরবধি বয়ে চলা বালু নদের বুকে নৌভ্রমণে। ভূমিগ্রাস, অপরিকল্পিত খনন আর শহরায়নের প্রভাবে সরু হয়ে এলেও এই বর্ষায়ও স্পষ্ট বোঝা যায় বালু নদের যৌবনের ঝলক। মাত্র ২০ টাকায় বালু নদের এ স্বর্গীয় প্রকৃতি উপভোগ করছে দৈনিক শত শত ভ্রমণপিয়াসু মানুষ।
‘ভ্রমণ প্রথমে তোমাকে নির্বাক করে দেবে, তারপর তোমাকে গল্প বলতে বাধ্য করবে’- বালু নদীতে নৌভ্রমণ শেষে বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার এ বাণী সর্বাংশে সত্য হয়ে উঠতে বাধ্য।
কী বেকার, কী ব্যস্ত; প্রায় সবার কাছে ভ্রমণ বাড়তি আনন্দের। রাজধানী ঢাকার ছকবাঁধা জীবন আর গৎবাঁধা নিয়মের ভিড়ে কোথাও ঘুরে আসার মতো সময় পাওয়া ভার। ইচ্ছা থাকলেও সেটা কখনও সত্যি হয়ে ওঠে না।
অল্প সময়ে পূর্ণ ভ্রমণ, বিশেষত নৌভ্রমণে যাদের আগ্রহ; তারা চাইলে মাত্র ঘণ্টা দুয়েক সময় হাতে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন রাজধানীর অন্যতম নৌ-পর্যটন স্পট বালু নদ।
বালু নদ ভ্রমণের সাত-পাঁচ
বালু নদ রাজধানী ঢাকা ঘিরে থাকা পাঁচটি নদ-নদীর অন্যতম। গাজীপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা ছুঁয়ে বহমান বালু ৪৪ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পতিত হয়েছে শীতলক্ষ্যায়। অনিন্দসুন্দর বালুতে নৌভ্রমণের জন্য মাত্র ঘণ্টা দুয়েক সময় হলেই সদলবলে বেরিয়ে পড়তে পারেন। এজন্য পূর্ব প্রস্তুতি ও কোনো আনুষঙ্গিক উপকরণেরও প্রয়োজন নেই। খরচও একেবারে সাধ্যের মধ্যে।
কীভাবে যাবেন ও ভাড়া কত
রাজধানীর যেকোনো স্থান থেকে নতুন বাজার বাস স্টপেজে নেমে; অটোরিকশা, রিকশা বা লেগুনায় সরাসরি বালু নদের বেরাইদ ঘাটে পৌঁছা যায়। নতুন বাজার থেকে লেগুনায় জনপ্রতি ভাড়া ১০ টাকা, অটোরিকশায় ২০ টাকা। আর রিকশায় গেলে ৫০ টাকা।
চাইলে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা সংলগ্ন ৩০০ ফুট সড়ক হয়ে বা খিলক্ষেত থেকেও বালু নদের ঘাটে পৌঁছান সম্ভব। ৩০০ ফুট সড়কের চেকপোস্ট বা খিলক্ষেত থেকে অটোরিকশা জনপ্রতি ৩০ টাকা হিসেবে সরাসরি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকার ইছাপুরা ঘাটে আসে।
বেরাইদ ঘাট থেকে ইছাপুরা বা ইছাপুরা ঘাট থেকে বেরাইদের উদ্দেশে প্রতি ৫-১০ মিনিট বিরতিতে ছেড়ে যায় ইঞ্জিনচালিত ট্রলার। জনপ্রতি নৌভ্রমণের ভাড়া মাত্র ২০ টাকা। আর মোটামুটি আকৃতির ট্রলারে অনায়াসে জনা চল্লিশেক মানুষের ব্যবস্থা থাকলেও যাত্রী তোলা হয় মাত্র আটজন। সকাল থেকে মোটামুটি সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলাচল করে এসব ট্রলার।
তবে চাইলে ঘণ্টা হিসেবেও ভাড়া নেয়া যায় ট্রলার। সেক্ষেত্রে ভাড়া ঘণ্টাপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকার মধ্যে। তবে রিজার্ভ করা হলে ভ্রমণের নির্দিষ্ট কোনো রুট নেই। সেই সঙ্গে উভয় ঘাটেই রয়েছে ছোট ডিঙি নৌকা। এগুলোতে দরদাম সাপেক্ষে ভ্রমণের সুযোগ আছে। বিশেষ করে প্রেমিক জুটির কাছে এই ভিঙিতে চড়ে নৌভ্রমণের চাহিদা বেশি বলে জানান ঘাটের মাঝিরা।
নদীপাড়ের বাজার
ইছাপুরা-বেরাইদ রুটে ভ্রমণে সময় লাগে মিনিট বিশেক। সাধারণত বিকেলের দিকে নৌভ্রমণে আসা মানুষের ভিড় বাড়ে। তবে সকালে এলে ভ্রমণের সঙ্গে বেরাইদ ঘাটের বিশাল মাছ বাজারে পাইকারি ও টাটকা মাছের দেখা মিলবে।
ওপারে ইছাপুরা ঘাট সংলগ্ন বাজারে রয়েছে স্থানীয়ভাবে তৈরি হরেক মিষ্টির সম্ভার। কম দামে পাওয়া যায় সুস্বাদু মিষ্টি। রয়েছে গ্রামের তরতাজা সবজি ও ফলের পসরা। একটু দূরে ৩০০ ফুট ঘেঁষে গড়ে ওঠা ভোলানাথ বাজারে চটপটি-ফুচকা বা ফাস্টফুডের দোকানসহ হোটেল এবং ফলের বাজার। এখানে বিকেলে রাজধানী থেকে ঘুরতে অসংখ্য প্রচুর মানুষ।
বালু নদ ঘিরে জীবন-জীবিকা
বালু নদের বুকে নৌকা চালিয়ে তিন দশক পার করে দিয়েছেন বৃদ্ধ হোসেন আলী মাঝি। আগে মালামাল ও যাত্রী টানার কাজ করলেও এখন মূলত পর্যটক নিয়ে বালুর বুক চষে বেড়ান অল্পভাষী হোসেন আলী। জানান, দিনে ১০-১২টি ট্রিপ মারেন। ভালোই চলছে এভাবে। সময়ের সঙ্গে প্রচার বাড়ায় বর্তমানে প্রচুর মানুষ ঘুরতে আসে বালু নদ এলাকায়। তাদের অনেকেই ওঠেন ট্রলারে।
ঘাটে তার মতো মাঝির সংখ্যা শ’খানেক। পাশেই রয়েছে টোলঘর। সেখান থেকে শ’ খানেক গজ দূরত্বে ডিঙি নৌকায় ওপারে আড়াআড়ি রূপগঞ্জের যাত্রীরা যান। টোল দুই টাকা ও ভাড়া দুই টাকা।
দিন দিন বালু নদে ভ্রমণপিয়াসুদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় বাড়ছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সংখ্যা। তাদের একজন কিশোর বয়সী সুজন মাঝি। আড়াই লাখ টাকা খরচ করে গত বছরই নতুন ট্রলারটি নামিয়েছে। দিনে আয়-রোজগারও ভালোই।
সুজন জানায়, বিকেলে মানুষের ভিড় বাড়ে। অনেকেই নৌকা রিজার্ভ করেন। তবে বেশিরভাগই ঘোরেন জনপ্রতি ভাড়া হিসেবে।
বালু নদ এলাকা ও নৌভ্রমণকে কেন্দ্র করে দু’পাড়ের বাজারে গড়ে উঠেছে নানা রকম দোকান। এতে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের তৈরি হয়েছে। ইছাপুরা ও বেরাইদ ঘাটের একাধিক দোকানি ও এলাকাবাসীর প্রত্যাশা, সরকারি উদ্যোগে দুই পাড়ে কিছু স্থাপনা সংস্কারের কাজ করা হলে বালু নদ আরও বেশি পর্যটনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
এসআর/এমএআর/আরআইপি