ঘুরে আসুন প্রকৃতিকন্যা বাকৃবি : প্রথম পর্ব

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ০৮:২৮ এএম, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

যারা ঢাকা বা এর আশেপাশে থাকেন; তারা খুব সহজেই ঘুরে আসতে পারেন ময়মনসিংহে অবস্থিত প্রকৃতিকন্যা খ্যাত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ক্যাম্পাস থেকে। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে অবস্থিত এই ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে বিমোহিত করবে। তাই দেরি না করে বেরিয়ে পড়ুন আজই।

নভেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে এলে দেখতে পাবেন রং-বেরঙের শীতের গাঁদা, ডালিয়া, জিনিয়া, সূর্যমুখী, গোলাপ, মোরগ ইত্যাদি ফুলের বাহার। মনে হবে, প্রতিটি স্থান যেন এক একটি নার্সারি। এসময় প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনীও চলতে থাকে প্রতি শুক্র-শনিবার। ক্যাম্পাস থাকে আলোকসজ্জাময়।

bau-auditorium

১২শ’ একরের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ বেষ্টিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। ক্যাম্পাসে রয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেন, পৃথিবীখ্যাত জার্মপ্লাজম সেন্টার, মুক্তিযুদ্ধের সৃতিস্তম্ভ বিজয়-৭১, গণহত্যার স্মৃতিস্তম্ভ বধ্যভূমি, শহীদ মিনার, নদের পাড়, বৈশাখী চত্ত্বর, এক গম্ভুজ বিশিষ্ট বৃহৎ কেন্দ্রীয় মসজিদ, দেশের একমাত্র কৃষি মিউজিয়াম, ফিশ মিউজিয়াম, দেশের দুটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কেন্দ্র বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), আম, লিচু, নারিকেল, কলা বাগান, সুবিশাল পানির ট্যাঙ্ক, ছয়টি অনুষদীয় ভবন, দুটি প্রশাসনিক ভবন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, গ্রাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ভবন, কেন্দ্রীয় গবেষণাগার, দুই হাজার আসন বিশিষ্ট আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন মিলনায়তন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সম্মেলন ভবন, প্রকৌশল ভবন, অতিথি ভবন, ক্লাব ভবন, ৬৫৭টি আবাসিক ইউনিট, ১২টি ফার্ম, ফিল্ড ল্যাব, ক্লিনিক, ওয়ার্কশপ, শিক্ষার্থীদের জন্য মনোরম ১৩টি হল, স্টেডিয়াম, জিমনেসিয়াম, ঈশা খাঁ হল লেক, হেলথ কেয়ার সেন্টার, ফ্যাকাল্টি করিডোর, বঙ্গবন্ধু চত্ত্বর, প্রেম বারান্দা, মারন সাগর, ডরমেটরি, কমিউনিটি সেন্টার, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ (কেবি কলেজ), কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হাইস্কুল (কেবি হাইস্কুল), নৈশ বিদ্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান।

bau-auditorium

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করেন প্রথমেই প্রাণ জুড়িয়ে যাবে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশের নরম হাওয়ায়। প্রধান ফটকের সাথেই দেখা মিলবে সাজানো-গোছানো পরিপাটি প্রাচীরে ঘেরা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ (কেবি কলেজ)।

গণহত্যার স্মৃতিস্তম্ভ
কেবি কলেজ পার হলেই হাতের বাম পাশের রাস্তায় ঢুকলে দেখতে পাবেন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব, কমিউনিটি সেন্টার, গণহত্যার স্মৃতিস্তম্ভ বধ্যভূমি।

বৈশাখী চত্ত্বর
প্রধান সড়ক দিয়ে শিক্ষকদের আবাসিক এলাকার মধ্য দিয়ে একটু এগোলেই নিরাপত্তা জোন-১ এর হাতের বাম পাশের রাস্তায় বৈশাখী চত্ত্বর। নদের পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে চত্ত্বরটি। নদের পাড়ে বাঁধা ঘাটে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতেই পারেন। সারা বছর নীরবে পড়ে থাকে পহেলা বৈশাখকে বরণ করার জন্য। সেদিন এখানে ছোটখাটো মেলাও বসে। শিক্ষার্থীরা নানা সাজে ভিড় জমায় এখানে। মিলতে পাড়ে বৈশাখী গানের আসরও।

bau-auditorium

বিজয়-৭১
প্রধান সড়ক দিয়ে আসতে থাকুন। শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, কামাল রঞ্জিত মার্কেট (কেআর মার্কেট), মেয়েদের চারটি হল পার হয়ে বিভিন্ন অনুষদীয় ভবন পার হয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এলেই চোখে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ বিজয়-৭১। বিশ্ববিদ্যালয়ের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য। স্মৃস্তি ধরে রাখতে একটি ছবি তুলে নিতে পারেন। চারপাশে ফুল গাছ বেষ্টিত মনোরম পরিবেশ।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন মিলনায়তন
বিজয়-৭১ এর পাশেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন মিলনায়তন। এখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে। ভাগ্য ভালো থাকলে শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় সুন্দর এক সাংস্কৃতিকসন্ধ্যা উপভোগ করতে পারেন। অডিটোরিয়ামের সামনের দিকে তৈরি করা হয়েছে মুক্তমঞ্চ। এখানেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

bau-auditorium

বঙ্গবন্ধু চত্ত্বর
মুুক্তমঞ্চ থেকে একটু সামনে এগোলেই আম বাগান, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, প্রশাসনিক ভবন দেখতে পাবেন। কৃষি অনুষদের পাশেই রয়েছে বঙ্গবন্ধু চত্ত্বর। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রয়ারি এই স্থানে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিবিদদের ১ম শ্রেণির কর্মকর্তা ঘোষণা দেন। সেই স্মৃতিকে ধারণ করেই গড়ে উঠেছে এই চত্ত্বর। সাথে পাশের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিও ঘুরে দেখতে পারেন। সাথে রয়েছে একটি সরকারি গ্রন্থাগার, মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের কর্নার ও মাস্টার্সের থিসিস এবং পত্রিকায় চোখ মেলাতে পারবেন নিচতলায়। দোতলায় রয়েছে শিক্ষার্থীদের পড়ার স্থান। পাশে সাইবার কক্ষ। তিনতলায় সেমিনার কক্ষ রয়েছে।

টিএসসি
প্রধান সড়ক হয়ে উপাচার্যের বাসভবন থেকে হাতের ডান দিকে প্রবেশ করলে একটু সামনেই হাতের বামে দেখতে পাবেন হ্যালিপ্যাড, মারন সাগর, শহীদ মিনার। তার ঠিক সামনেই টিএসসি। এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা, কনফারেন্স কক্ষ, বাকসুর অফিস, পত্রিকা পড়ার কক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি কার্যালয়সহ বিভিন্ন সংগঠনের কার্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পাশেই রয়েছে পুলিশ ক্যাম্প।

bau-auditorium

বোটানিক্যাল গার্ডেন
বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ প্রজাতির সংরক্ষণের দিক থেকে বাংলাদেশের এক নম্বর এটি। দুষ্প্রাপ্য গাছ-গাছালির সংগ্রহ নিয়ে ২৫ একর জায়গাজুড়ে ব্রক্ষপুত্র নদীর পাড়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠেছে গার্ডেনটি। নদের পাড়ে রয়েছে বসার স্থান। গার্ডেনের সবুজ-শ্যামল আর পাখির কোলাহল এক নিমিষেই শহুরে ক্লান্তি দূর করে দেবে। এখানে মোট ৬০০ প্রজাতির গাছ আছে। হাজারখানেক বিশাল গাছ, ১ হাজার ২৭৮টি মাঝারি ও ৪ হাজার ৪৬৭টি ছোট আকারের গাছ আছে। ফলে বিশাল এই বাগানকে ৩০টি জোনে ভাগ করে দেখাশোনা করতে হয়।

bau-auditorium

জোনগুলোর নামও দেওয়া হয়েছে- ঔষধি, ফুল, ফল, ক্যাকটাস, অর্কিড, পাম, মসলা, টিম্বার, বাঁশ, বেত, বিরল, বনজ উদ্ভিদ ইত্যাদি। জলজ উদ্ভিদের জন্য ওয়াটার গার্ডেন, মরুভূমি ও পাথুরে এলাকায় জন্মে এমন উদ্ভিদের জন্য রক গার্ডেন আছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জোগাড় করা বিলুপ্ত ও বিরল ক্যাকটাস আছে নিসর্গ ভবনে। একেবারে দক্ষিণে আছে অর্কিড হাউজ। সুন্দরবন জোনে আছে সুন্দরবনের গাছগুলো। এমনকি সেখানে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া, পশুর, বাইন, হোগলা ও ফার্ন জাতীয় গাছ আছে। নিসর্গ ভবনে আছে বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় ক্যাকটাসের সারি। ‘পট হাউস’ নামের বিশেষ সংরক্ষণাগারে আছে অশ্বগন্ধা, সর্পগন্ধা, গন্ধভাদুলি, পূর্ণনভা, কুর্চি, বচ, উলটচন্ডাল, অর্জুনর্মূল, অঞ্জন ইত্যাদি জাতের ওষুধি উদ্ভিদ।

bau-auditorium

আছে সুগন্ধি জাতের উদ্ভিদ। বাগানে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছের মধ্যে আছে স্টার আপেল, আমেরিকান পেয়ারা, থাই পেয়ারা ইত্যাদি। ফুলের মধ্যে আছে কমব্রিটাম, রনডেলসিয়া, পালাম, ক্যামেলিয়া, আফ্রিকান টিউলিপ, রাইবেলি ইত্যাদি। বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের মধ্যে আছে রাজ অশোক, নাগলিঙ্গম, কালাবাউশ, ক্যারিলিফ, ফলসা, মনগোটা, মাক্কি, বনভুবি, লোহাকাট, উদাল, পানবিলাস, টেকোমা, বহেরা, হরিতকী, কাঁটাসিংড়া, ম্যালারিউকা, প্যাপিরাস, রুপিলিয়া, স্ট্যাভিয়া, হিং, পেল্টো ফোরাম ইত্যাদি। আরো আছে পদ্ম-শাপলার ঝিল, কৃত্রিম দ্বীপ, নারিকেল কর্নার, বিলুপ্ত বাঁশঝাড় ইত্যাদি।

bau-auditorium

এত সব গাছ ঘুরে দেখার সময় মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে মেলবন্ধনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় পশু-পাখির প্রতিকৃতি আছে। মূল গেটের কাছে বাঘ, সিংহ, দ্বীপ জোনে দুুটি রাজহাঁস ও দুটি সারস, আর্কেডিয়া গাছের নিচে আছে হরিণ। বাগানে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রামের জন্য বেঞ্চ আছে। নদীর পাড়ে বেড়াতে আসা মানুষ সেখানে বসে গল্প করে। সেই সঙ্গে নদীতে ভেসে বেড়ানো নৌকা দেখে তাদের চোখ জুড়িয়ে যায়। রবি-বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা-বিকেল ৫টা ও শুক্র-শনিবার সকাল ৯টা-বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ গার্ডেন। গার্ডেনে প্রবেশমূল্য ৫ টাকা। আর কোথাও কোন ফি নেওয়া হয় না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কোন ফি নেই।

bau-auditorium

ফ্যাকাল্টি করিডোর
ছয়টি অনুষদের মধ্য দিয়ে রয়েছে সুন্দর করিডোর। করিডোময় বাকৃবিও বলা যেতে পারে। করিডোরের মধ্য দিয়েও আনমনে হেঁটে বেড়াতে পারেন।

মো. শাহীন সরদার/এসইউ/আইআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।