প্রকৃতির মায়ায় জড়ানো মহামায়া ইকো পার্ক : শেষ পর্ব

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:১২ এএম, ০৩ মে ২০১৭
ছবি : সৈয়দ মিজান

আমরা দুপুর দুইটায় পৌঁছলাম মহামায়া ইকো পার্কের গেটে। গেটের পাশের একটা চায়ের দোকানে বসলাম। মঈনকে পাঠানো হলো টিকিট কাটতে। ইকো পার্কে প্রবেশ করতে জনপ্রতি দশ টাকা করে দিতে হয়। চা পান করেই আমরা প্রবেশ করলাম মহামায়ায় জড়াবো বলে। প্রধান ফটক থেকে ঢালু একটা পথ এগিয়ে গেছে সামনে। অাবার কিছুটা উঁচুতে উঠে গেছে। পিচঢালা পথের দু’ধারে গাছের সারি। একপাশে ঝাউবন। বাহারি ফুলের মনকাড়া সৌন্দর্য চোখে পড়ার মতো।

maha

ঢালু পিচঢালা পথ বেয়ে উঁচুতে উঠতেই ডানদিকে বেঁকে গেছে একটি রাস্তা। বামদিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এগিয়ে গেছে আরেকটি পথ। দুই রাস্তার সন্ধিস্থলে স্পীডবোট বা নৌকা ঘাট। আমরা গেলাম বামদিকে। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে এগিয়ে গেলাম কিছুদূর। পাহাড়ে উঠতে লাঠির প্রয়োজন হয়। হাতে লাঠি থাকলে ভর দিয়ে পাহাড়ে উঠতে সুবিধা হয়। আমরাও হাতে লাঠি নিলাম। উঠতে উঠতে থেমে গেলাম। আর কোথাও যাওয়ার নেই। পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে দেখলাম বিস্তীর্ণ সবুজ প্রকৃতি। চূড়ায় উঠে মনে পড়লো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘পাহাড় চূড়া’ কবিতাটি। ‘একেবারে চূড়ায়, মাথার খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুলা পৃথিবী, চরাচরে তীব্র নির্জনতা।’ আবৃত্তি করলাম আপন মনে।

maha

চোখে পড়লো একটা ঘর। আগ্রহী হয়ে উঠলো মৃদুল ও রুয়েত। ওরা বাড়িটিতে যাওয়ার জন্য পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গেলো। আমরা ফিরে এলাম পূর্বের স্থানে। বিশ্রাম নিচ্ছি আর ছবি তুলছি। মিজানের ডিএসএলআরে ক্লিকের পর ক্লিক। তবে পাহাড়ের গায়ে খুব বেশি স্থাপনা নেই। ছায়া বা বিশ্রামের জন্য ছোট ছোট বেঞ্চ এবং ব্যাঙের ছাতার আদলে তৈরি কিছু ছাউনি রয়েছে। দুটি ছোট ভবন দেখলাম, তা-ও আবার তালাবদ্ধ।

maya

আমরা বিশ্রাম নিতে নিতে ওরা দু’জন ফিরে এলো। হাতে ছয়টি পাহাড়ি মরিচ। এসে জানালো- ওখানে একটি পরিবার বাস করে। তারা জুম চাষ এবং গরু পালনের সঙ্গে যুক্ত। ওদের কাছে পাহাড়ি পরিবারের গল্প শুনতে শুনতে মনে হলো- এখন অন্য কোথাও যাওয়া যাক। এবার সিদ্ধান্ত হলো জলপথে ভ্রমণের। পাহাড় থেকে নেমে কিছুটা এগোলে শানবাঁধানো ঘাট। ঘাটে সারি সারি নৌকা এবং স্পীডবোট। খোলা একটা দোকানে দাঁড়িয়ে কিছু ভাজাপোড়া আর চা খেয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করার দর কষাকষি চলল। নৌকাযোগে পাহাড়ের সুড়ঙ্গ পথ দেখতে যাবো। সেখান থেকে একটি ঝরনার কাছে গিয়ে নামবো। কিছুক্ষণ থাকবো- পরে যথাস্থানে ফিরবো। এতে পিচ্চি নৌকাওয়ালা এক হাজার টাকা ভাড়া চাইলো। বড়জোর একঘণ্টার ব্যাপার।

maya

অবাক ব্যাপার হচ্ছে, নৌকাঘাটেও রয়েছে সিন্ডিকেট। আপনি ইচ্ছা করলেই দরদাম করে যেকোনো নৌকায় উঠতে পারবেন না। নৌকার আবার সিরিয়াল রয়েছে। যার সিরিয়াল পড়বে, তার নৌকাতেই যেতে হবে। ফলে ভাড়া যা চাইবে তা-ই দিতে হবে। অগত্যা আমরাও উঠে পড়লাম।

পাহাড়ি নদীর বুক চিড়ে এগিয়ে চলছে ছোট্ট ইঞ্জিনচালিত নৌকা। একটু কাতচিৎ হলেই হেলেদুলে ওঠে। আমরা চুপচাপ বসে আছি। চোখ মেলে দেখছি সৃষ্টির অপার রহস্য। নৌকায় চড়ে সুড়ঙ্গ পথের দিকে যেতে যেতে চোখে পড়লো অনেক কিছুই। কেউ কেউ নদীর পাড়ে বসে মাছ ধরছে। কেউ বা গভীর পাহাড়ি বন থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে ফিরছে। কখনো কখনো পানকৌড়ি এক ডুবে চলে যায় বহুদূর। আবার কোথাও মাথা তুলে তাকায়। নদীর কূল ঘেঁষে জুম চাষ করা হচ্ছে। কলাগাছের চাষ দেখছি কোথাও কোথাও।

maya

ঘাটে বসে সুড়ঙ্গ বলতে যা বোঝানো হয়েছে- আসলে তা নয়। নদীর শেষপ্রান্ত মিশেছে কোন এক পাহাড়ের গায়ে। দুই পাহাড়ের ভেতর দিয়ে গর্তের মতো কিছুদূর এগিয়ে গেছে পানি। ওটাই মনে হয় সুড়ঙ্গের মতো। সেখানে বাঁশ সংগ্রহ করছিলো একটি দল। এক মাপে কাটা বাঁশ আটি বেঁধে নিয়ে আসে তারা। বাঁশগুলো পানের বরজসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। পানিতে টুকরো টুকরো বাঁশ ভেসে থাকায় নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করতে হলো। তারপর নৌকা ভাসিয়ে পরিষ্কার পানিতে এসে আবার স্টার্ট দিয়ে ছুটলাম ঝরনার দিকে।

ঝরনার কাছে পৌঁছতেই চোখে পড়লো একটি দুর্ঘটনা। ঝরনার পাশে নৌকা ভেড়াতেই দেখি- আহত এক যুবক মৃতের মতো পড়ে আছে। তাকে ঘিরে উৎসুক জনতার ভিড়। জানতে পারলাম, ছেলেটি স্থানীয়। কোনো নৌকার মাঝি বা গাইড হবে। ঝরনার পানিতে ভিজতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় ছেলেটি। ভাগ্য ভালো যে ঝরনাটি বেশি উঁচু নয়। তবে ঝরনার পাথরগুলো শ্যাওলাযুক্ত হওয়ায় আমরা সতর্ক হয়ে গেলাম।

maya

দশ মিনিট পরেই নৌকার ছেলেটি হাক দিতে শুরু করলো। ছেলেটা জানাল, দশ মিনিট হয়ে গেছে। এখানে দশ মিনিটের বেশি অবস্থান করা যায় না। তাই আমাদের ফিরতে হবে। মৃদুল, মিজান, নিপুল ও রুয়েত পাহাড় বেয়ে ঝরনার উৎসস্থলে গিয়েছিল। ওরা নেমে আসতেই আমরা আবার নৌকায় উঠে পড়লাম। তবে কেউ ঝরনার জলে আর ভিজতে সাহস পেলাম না।

ঝরনা দেখে ফেরার পথে পাশ দিয়েই যাচ্ছিল পাহাড়িদের একটি নৌকা। তারা বাঁশ সংগ্রহ করে ফিরছিল। তাদের হাতে পাহাড়ি ফল। আমরা চাইতেই পাঁচ-ছয়টি ছুড়ে মারলো আমাদের দিকে। আমরা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে খেতে শুরু করলাম। ওনারাও খাচ্ছিলেন। ফলটির স্বাদ অনেকটা কামরাঙার মতো। যথেষ্ট টক লাগে। ফলটি দেখতে অনেকটা চমচম আকৃতির। তবে যে পথ দিয়ে সুড়ঙ্গ দেখে ঝরনার কাছে গিয়েছি। আসার সময় সে পথে আর যেতে হয়নি। ঝরনা থেকে অন্য পথে ফিরে এলাম ঘাটে।

maya

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ঢাকাও ফিরতে হবে। তাই একটু দূরে দেখা একটি দ্বীপে আর যাওয়া হয়নি। পাহাড়ি নদীর জলে হাতমুখ ধুয়ে ছুটলাম গাড়ির দিকে। গেট পার হয়ে বাইরে এসে দেখি বিক্রি হচ্ছে স্থানীয় আচার, মুরুল্লি ও মনেক্কার মতো কিছু খাবার। আমরা কেউ কেউ পাহাড়ি আচার কিনলাম।

গাড়ি তখন স্টার্ট নিয়ে নিয়েছে। আমি দৌড়ে গিয়ে উঠলাম। গাড়ি চললো ঢাকার উদ্দেশ্যে। পথে মহিপাল এলে ইমামের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। একই সঙ্গে সন্ধ্যার নাস্তাও সারলাম। এরপর সারাদিন অপেক্ষারত মিলনের সঙ্গে দেখা করার জন্য থামলাম ময়নামতি সেনানিবাস এলাকায়। রাতের খাবারটা ওখানেই খেলাম। দারুণ আয়োজন ছিলো। খাবার শেষে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম রাত নয়টায়।

maya

ময়নামতি পার হতেই শুরু হলো প্রকৃতির উদ্দাম নৃত্য। ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি। তবুও থেমে থাকেনি গাড়ি। ঝড়-বৃষ্টিকে পাশ কাটিয়ে দুরন্ত গতিতে চলতে থাকে গাড়ি। কখনো ঝড়োবৃষ্টি- কখনো হাল্কাবৃষ্টি। শান্তিনগর যখন গাড়ি আসে তখন ঢাকার রাস্তায় একহাঁটু জল। গাড়ি থেকে নেমে জল-কাদা ভেঙে রাত ১২টায় পৌঁছলাম নিপুলের বাসায়। চোখে তখনও প্রকৃতির মায়া। যেন এক বিশাল মহামায়া। স্বপ্নের ঘোর। ক্লান্তির পরশে দুচোখে শুধু ঘুমের আবেশ।

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।