রোনালদোর শৈশবের ‘মাদেইরা’ এক রূপের নগর


প্রকাশিত: ০৬:২১ এএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

পর্তুগালে থাকি প্রায় বছর ছয়েকের কাছাকাছি। বলা যায় আটলান্টিকের পাড়ের পর্তুগালের বড় বড় বা বিখ্যাত অনেক দর্শনীয় স্থান দেখা প্রায় শেষ। সেই আমেরিকার কাছের দ্বীপ ঐতিহাসিক ‘আজোরস’ থেকে ছোট শহর ‘এলভাস’ পর্যন্ত ঘোরা শেষ। বাকি ছিল ঐতিহাসিক দ্বীপ ‘মাদেইরা’ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর জন্মস্থান। গত মাসের শুরুর দিকে হঠাৎ করে একজন বললো- ‘চলেন, মাদেইরা ঘুরে আসি’। মনের মাঝে অনেক দিনের আগ্রহ আছে তাই সাথে সাথে সম্মতি জানালাম। রাতের বেলা একজন ফোন করে পাসপোর্টের ফটোকপি চাইলো, আর সাথে সাথে পাঠিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি ‘হোয়াটস অ্যাপে’ বিমানের টিকেটের কপি। পরদিন সকাল আটটায় ফ্লাইট। রাতভর অপেক্ষা সেই সকালের।

প্রচণ্ড বৃষ্টির মাঝে রাতে ছয়জন এক হলাম লিসবনে। সকালে ইজি জেটের ফ্লাইটে করে প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টার যাত্রা শেষে পৌঁছালাম ‘মাদেইরা’ নামক আইসল্যান্ডে। বর্তমানে যেটি ‘রোনালদোর দ্বীপ’ নামে অনেকের কাছে পরিচিত। যাই হোক বিমান যখন ল্যান্ড করছিলো জানালার পাশে বসে আকাশে মেঘের খেলা আর নিচে আটলান্টিক মহাসাগর দেখে ভাবনার অতল সাগরে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক বিমান বন্দরের একটি এই মাদেইরা এয়ারপোর্ট। বিমান থেকে নেমে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে বেরিয়ে ট্যাক্সি করে মাদেইরার রাজধানী শহর ‘ফোংশাল’ এর উদ্দেশ্যে এবার যাত্রা। ফোংশালে এসে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঐতিহ্যবাহী এক পর্তুগীজ ক্যাফেটেরিয়ায় সকালের নাস্তা সেরে নিলাম সকলেই এবং সেই সাথে কফির মগে চুমুক দিতে ভুলিনি।

যথারীতি আগে বুক করা হোটেল খুঁজতে বের হলাম। এমন সময় রাস্তায় এক বাংলাদেশির দেখা পেলাম। ভদ্রলোক গত ছয় মাস ধরে এখানে বসবাস করছেন। তার সাথে আলাপে প্রাথমিক কিছু ধারণা পেলাম শহরটি সম্পর্কে। খুবই সুলভে মানসম্পন্ন হোটেল পেয়ে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে ঘোরাঘুরির শুরুতেই ভ্রমণের কোড নেম দেয়া হলো ‘টিম সিক্স’। যেহেতু আমাদের ছয় সদস্যের এ আনন্দভ্রমণ তাই নাম ‘টিম সিক্স’। দুই পর্বের এই ভ্রমণ কাহিনিতে চেষ্টা করবো প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা পরিচয় তুলে ধরতে।

Ronaldo
যেহেতু এটি ছিল একটি আনন্দভ্রমণ তাই আমরাও চেষ্টা করেছি এই সময়ের ভেতরে সবকিছু ভুলে গিয়ে প্রকৃতির সাথে মিতালী গড়ে তুলতে। আনন্দ আর উল্লাসে কখনোবা প্রকৃতির এ অপরূপ রূপ দেখে স্রষ্টাকে নিবেদিত গানে কখনও দেশীয় লোক সংগীত গেয়ে পার করেছি সময়গুলো। তাছাড়া বর্তমান ভার্চুয়াল যুগে সবার চোখ যেমন প্রকৃতি দেখাতে ব্যস্ত, সাথে সাথে সেলফি ছবি তোলা আবার কেউ কেউ তো ফেসবুকে লাইভের বহর শুরু করেছিল। ছবি তোলা বা ভিডিও কিংবা লাইভে দেয়ার মাধ্যমে সবাই সচেষ্ট ছিল যাতে সফরটি স্মরণীয় হয়ে থাকে।

স্মৃতি ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় কারো কমতি ছিল না। টিমের মধ্যে যারা মাতিয়ে রেখেছেন এ আনন্দভ্রমণকে নানাভাবে, তাদের মাঝে ছিলেন লিসবনের সুপরিচিত মুখ বন্ধুবর মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া- যার নিজের ভাষায় ‘জীবনের প্রথম ফেসবুকে লাইভে গমন’ তার এই মাদেইরা যাত্রায়। ফেসবুক বন্ধুদের পেশাদার সাংবাদিকদের মতোই লাইভ ধারাবাহিকভাবে ‘মাদেইরা’র বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিলেন অবিরত। তার লাইভ ধারা বিবরণীতে যিনি সহযোগিতায় ছিলেন এবং বলা যায় আমাদের সবার নানা ভঙ্গিমার ছবি তুলতে যিনি বাধ্য করেছিলেন সেই বিপ্লবী মুখ মোশাররাফ হোসেন। তিনি না থাকলে এ ভ্রমণ হয়তো এত আনন্দময় হয়ে উঠতো না।

অনেক আগে এক গল্পে ‘অদ্ভুত চা-খোরের’ কথা পড়েছিলাম। এ যাত্রায় আমরা সৌভাগ্যবশত তেমনি এক খাঁটি মাছে-ভাতে বাঙালি পেয়ে গেলাম। মাছ আর ভাতের প্রতি যার নেশা আর টান সবাইকে আশ্চর্য করলো। আমি তার এই টানের মাঝে খুঁজে পেয়েছি যেন এক খাঁটি বাঙালিয়ানার। কাবাব শপে প্রথম দিনের লাঞ্চে বেচারা তার প্রায় সবটুকু খাবার সযত্নে অপরকে দিয়ে দিলেন। পরে রহস্য জানলাম। বেচারা ভাত ছাড়া আর যে কোনো খাবারেই ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে না। এ যাত্রায় তার ভাতের প্রতি টান নিয়ে একটি গল্প লেখার ইচ্ছে আছে বিধায় আর বিস্তারিত যাচ্ছি না।

Ronaldo
হাস্যোজ্জ্বল এই ট্যুরের মুল উদ্যোক্তা ব্যক্তিটি মোস্তাফিজ ভাই। আর হ্যাঁ, সেই আমাদের ভাতপ্রেমী খাঁটি বাঙালি। বিশ্বসেরা প্লেয়ার রোনালদো প্রতিষ্ঠিত মিউজিয়াম সিআর-সেভেন এর সাথে ছবি তোলায় সফল একমাত্র সৌভাগ্যবান আসাদুল্লাহ ভাইও ছিলেন সফরে। সবার শেষে যার নাম সে সকলের অতি আদরের রুবেল। এই নিয়ে গত কয়েক মাসে তার সাথে আমার তিন তিনটি ভ্রমণ হয়ে গেলো। যাই হোক, এবার শুরু হলো আমাদের ভ্রমণের পালা। আগে বুকিং দেয়া ট্যুরিস্ট বাসেই শুরু করলাম স্থানীয় ভ্রমণ।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৫০০ মাইল উপরের উদ্দেশ্যে বাস যাত্রা শুরু করলো। প্রথম প্রথম আমার কাছে আমাদের দেশের রাঙ্গামাটির মতো মনে হলেও, বাস যখন শুধু উপরের দিকে উঠছিলো তখন কিছুটা ভয় পাওয়া শুরু হলো। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা বাঁক পেরিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে এই যেন মেঘকে ভেদ করে বাস উপরের পানে ছুটে যাচ্ছে। দূরের বিশাল আটলান্টিকের পানির চিক চিক দেখা যাচ্ছে। চলার পথে আমরা নানা প্রাকৃতিক জায়গা দেখলাম, যার মধ্যে ‘মন্তেল’ নামক জায়গার কথা বলা যায়।

ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ ছাড়াও এ জায়গাটি যেকোনো পর্যটকের মন কেড়ে নেবে। নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন প্রকৃতির গভীরে। বলা যায়, মাদেইরার সবচেয়ে বড় চূড়ায় ১৮৮৯ সালে অস্ট্রিয়া থেকে বহিষ্কৃত রাজা যাকে এই মাদেইরাতে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল আমৃত্যু। সেই সাথে দেখা হলো তার প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক গির্জা। বিশালাকৃতির গির্জার ভেতর থেকে ছাদ পর্যন্ত উন্মুক্ত আছে পর্যটকদের জন্যে। আমরাও ভেতরে গেলাম। অনেকটাই মসজিদের মতো। সেখানেও এক জায়গায় দানবাক্স আছে, আবার নানা বাহারি রঙের মোমবাতিও জ্বালানো আছে। ছাদের উপর দেখলাম দুই পাশে মাইকের চোঙ্গা বাঁধা আছে যাতে গির্জার ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যায়। নির্বাসিত রাজা অতি ধর্মপ্রাণ ছিলেন এবং সেই সাথে প্রকৃতিপ্রেমীও বলা যায়।

চলবে...

এইচএন/এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।