সংস্কারের অভাবে বেহাল টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য

নুরুল আহাদ অনিক নুরুল আহাদ অনিক , জেলা প্রতিনিধি বরগুনা
প্রকাশিত: ১১:৪৬ এএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
বরগুনার তালতলী উপজেলার টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য/জাগো নিউজ

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন বরগুনার তালতলী উপজেলার টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসের পথে। বনে প্রবেশে খালের ওপর নির্মাণাধীন টেংরাগিরি সেতুর উচ্চতা সংক্রান্ত জটিলতায় তিন বছর ধরে বন্ধ সেতুর নির্মাণকাজ। এতে দর্শনার্থী হারাচ্ছে সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলটি।

এছাড়া সীমানা প্রাচীর, চলাচলের রাস্তা ও সেতুগুলো নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তবে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য কেন্দ্রটির সব সমস্যা নিরসনে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে বরগুনার বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ইকোট্যুরিজম সুযোগ বৃদ্ধি শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় তালতলীতে একটি ইকোপার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। পরে দেশের দ্বিতীয় সুন্দরবন নামে খ্যাত টেংরাগিরি ম্যানগ্রোভ বনে ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রায় দুই কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নির্মাণ করা হয়। ভেতরে দর্শনার্থীদের চলাচলের সুবিধার্থে নির্মাণ করা হয় প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ইটের সড়ক। বিভিন্ন আকারের কাঠ ও সিমেন্টের পাটাতন দিয়ে ছোট ছোট খালের ওপর ১৬টি সেতু নির্মাণ করা হয়। এছাড়া দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের জন্য নির্মাণ করা হয় বিশ্রামাগার, স্থাপন করা হয় গভীর নলকূপ ও শৌচাগার।

সংস্কার-রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেহাল টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য

পর্যটন সম্ভাবনা আরও এগিয়ে নিতে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগ ২০২০-২১ অর্থবছরে ফকিরহাট খালের ওপর পুরোনো সেতু ভেঙে ৭২ মিটার দীর্ঘ গার্ডার সেতুর নির্মাণ শুরু করে। কিন্তু ২০২২ সালে উচ্চতা কম হওয়ায় পরিকল্পনা কমিশন ও স্থানীয় জেলেদের আপত্তির কারণে মাঝখানের ২৪ মিটার স্প্যান নির্মাণের কাজ প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ। দীর্ঘদিন ধরে এ সব কিছুর রক্ষণাবেক্ষণ, বনে প্রবেশের সেতুর নির্মাণ না হওয়া এবং বনাঞ্চলটি নির্মাণের পর থেকে সংস্কারের উদ্যোগ না নেওয়ায় বর্তমানে বনাঞ্চলটি বেহাল হয়ে আছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন দূর-দূরান্ত থেকে ঘুরতে আসা বিভিন্ন এলাকার দর্শনার্থীরা।

সরেজমিনে তালতলীর টেংরাগিরি ঘুরে দেখা যায়, বনাঞ্চলটিতে প্রবেশের আগে একটি ছোট খালের ওপর থাকা একমাত্র সংযোগ সেতুর মাঝের অংশের নির্মাণকাজ বন্ধ দীর্ঘদিন ধরে। বিকল্প কোনো রাস্তা না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে খেয়া নৌকায় পারাপার করতে হচ্ছে পর্যটকদের। প্রবেশের পর হেঁটে চলাচলের জন্য নির্মিত রাস্তাটির অধিকাংশ জায়গা থেকে ইট উঠে গেছে। ফলে রাস্তার বিভিন্ন অংশে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য খানাখন্দ। এছাড়া সরে গেছে বনের মধ্যে থাকা ছোট ছোট খালের ওপর নির্মিত সেতুর কাঠ ও সিমেন্টের পাটাতন, যা আছে তারও অবস্থাও নাজুক। যে কোনো সময়ই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।

সংস্কার-রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেহাল টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য

এছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে স্থাপন করা বিশ্রামাগারগুলোর মধ্যে কয়েকটি ধসে পড়েছে আর অন্যগুলোয় তৈরি হয়েছে ময়লার ভাগাড়। শৌচাগারগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। একই অবস্থায় অকেজো হয়ে আছে স্থাপন করা সুপেয় পানির গভীর নলকূপগুলো। এছাড়া বনের ভেতরে হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তায় নির্মিত বেষ্টনীও ভেঙে গেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। বনাঞ্চলটি ঘুরে হরিণ ও কুমিরের ভাঙা বেষ্টনীতে ঘুরে শুধু একটি হরিণের বাচ্চা দেখা গেছে। এছাড়া পুরো বনাঞ্চল ঘুরেও কোনো বনরক্ষী না পাওয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের।

বরগুনা থেকে ঘুরতে আসা জাহিদ নামের এক পর্যটক জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানে সবই ভাঙাচোরা। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সব কিছুই পরিত্যক্ত। হাঁটতে গেলে আছার খাওয়া লাগে। খাওয়ার পানির ব্যবস্থা নেই। মনে হচ্ছে এখানে দেখার কেউ নেই বা সরকারের উদ্যোগ নেই। এরকম থাকলে মানুষ এখানে আর আসবে না। তাছাড়া এখানে যে বন্যপ্রাণী দেখার কথা ছিল তা দেখা যায় না, শুধু টেংরাগিরি নামেই আছে, আর কিছুই নেই।’

সংস্কার-রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেহাল টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য

টেংরাগিরিতে ঘুরতে আসা আলিম নামের এক পর্যটক জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাস্তাগুলো সবই ভাঙা। হরিণের খাঁচাসহ বিভিন্ন প্রাণীর খাঁচার বেষ্টনী ভাঙা দেখেছি। আরও খারাপ লেগেছে এখানে যে ব্রিজটা ছিল, তা আর নেই। দীর্ঘদিন ধরে এই ব্রিজ নির্মাণাধীন বলে শুনছি। ইকোপার্কে প্রবেশের জন্য একটি খেয়ার মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে আমাদের প্রবেশ করতে হয়। যে কারণে পরিবার ও বাচ্চাসহ কেউ এখানে আসতে সাহস পান না। আমরা চাই, যথাযথ কর্তৃপক্ষ এসব সমস্যা সমাধান করুক। তাতে আমাদের মতো পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দ্যে এখানে আসতে পারবে।’

রিয়াজ আহমেদ মুসা নামের এক পর্যটক জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানকার ব্রিজটি এখনো অসম্পূর্ণ। একটি খেয়ার মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার করতে হয়। এভাবে ঝুঁকি নিয়ে কিন্তু আমাদের মতো পর্যটকরা পারাপার করতে চাইবে না। আমি সেই বরগুনা থেকে এসেছি। দূর-দূরান্ত থেকে এসে যদি পর্যটকদের পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হয় তবে এটি হতাশাজনক। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বন্যপ্রাণী রাখা প্রতিটি খাঁচার সামনে গিয়ে সাইনবোর্ড ছাড়া আমি কিছুই দেখতে পাইনি। সবশেষে কুমিরের প্রজনন কেন্দ্রে এসে ভেবেছি এখানে কুমির দেখতে পাব, তাও পাইনি। আজ সারাদিনটাই আমার মাটি হয়ে গেলো। পর্যটনকেন্দ্র, ইকোপার্ক, বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র, এত কিছু শুনে এসে আসলে আমি হতাশ। এ সমস্যাগুলো সমাধান করলে আমাদের মতো ভ্রমণপিপাসু যারা আছে, তারা এসে হতাশায় ভুগবে না।’

সংস্কার-রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেহাল টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য

টেংরাগিরি ইকোপার্কের বেহাল দশার কথা স্বীকার করে বন বিভাগের তালতলী উপজেলার রেঞ্জ অফিসার মো. মতিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘টেংরাগিরির মূল সমস্যার কারণ হচ্ছে এই সেতু। এটা ঠিক হলে পর্যটক আসতে সমস্যা হবে না। সবশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমালে ইকোপার্কের বেশকিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে রাস্তার ক্ষতি হয়েছে। তবে সেগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের বরাদ্দ পেলেই আমরা কাজ শুরু করব। এছাড়া হরিণ বেষ্টনীর বিভিন্ন জায়গার প্রায় ৬০ ফুট দেওয়াল ভেঙে গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সব ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। আশা করি বরাদ্দ পেলেই পুনরায় রাস্তাঘাটসহ সব কিছুর প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন হলে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে।’

নির্মাণ না হওয়া সংযোগ সেতুর বিষয়ে বরগুনা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মেহেদী হাসান খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইকোপার্কের সঙ্গে সংযোগ হওয়া সেতু নির্মাণ না হওয়ায় দর্শনার্থীসহ সবাই এলে একটা ভোগান্তির মধ্যে আছে। সেতুটির উচ্চতা বাড়ানোর জন্য নতুন করে নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। নকশাটি পাস হলেই দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে।’

সংস্কার-রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেহাল টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য

এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘টেংরাগিরি ইকোপার্কটি একদিকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কাজ করে, পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের জন্য বরগুনায় এটি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী একটি এরিয়া। এখানে প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক ঘুরতে আসে। বন বিভাগের সঙ্গে কথা বলে ইকোপার্কের যে সমস্যা রয়েছে তা চিহ্নিত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার মাধ্যমে আমরা দ্রুত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব।’

এনএএ/এমএমএআর/জেআইএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।