পর্যটনের উন্নয়নে কাজ করতে হবে সবাইকে

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ০২:৩৩ পিএম, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

দেশে এখন পর্যটনের প্রধান মৌসুম। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তবে অবকাঠামো দুর্বলতা, সঠিক পরিকল্পনা না থাকা, দক্ষ জনবলের অভাবের কারণে তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয় পর্যটকদের। নিরাপত্তা, শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকাসহ নানান কারণে অনেকে পরিবার নিয়ে ভ্রমণেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।

এসব সমস্যা আমলে নিয়ে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প ও সেবার সার্বিক উন্নয়ন, পরিচালনা এবং বিকাশে কাজ করছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। এজন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়নসহ নানান উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। এসব বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মুসা আহমেদ

জাগো নিউজ: দেশের পর্যটন বিকাশে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের ভূমিকা কী?

আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের: দেশের পর্যটন বিকাশে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের নানান কার্যক্রম রয়েছে। এর মধ্যে ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান কাজ হচ্ছে পর্যটন বিকশিত করা, ব্র্যান্ডিং করা, পর্যটন নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করা, পর্যটনের জন্য যেসব মানবসম্পদ দরকার সেসব দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা। এছাড়া রেগুলেশন তৈরি করা। যেমন পর্যটক, পর্যটনকর্মী, পর্যটনে যারা সেবা দেয় তারা কীভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে তা সম্পর্কে নীতিমালা তৈরি করা।

জাগো নিউজ: পাঁচ বছর আগে পর্যটন মহাপরিকল্পনা করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত তা চূড়ান্ত করা হচ্ছে না কেন?

আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের: ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন শুরু করি। এজন্য বিদেশি পরামর্শক সংস্থা আইপিই গ্লোবালের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। তবে করোনার কারণে তারা কাজ করতে পারেনি। সেজন্য আমরা কাজটা বন্ধ করে দেই। করোনা যখন শেষ হয়, তখন কাজটা ফের শুরু করি। ২০২৩ সালের জুনে এই মহাপরিকল্পনার খসড়া কমপ্লিট করা হয়। তারপর এটি যাচাই-বাছাই করার জন্য জাতীয় পর্যটন পরিষদে পাঠাই। যাতে জাতীয় পর্যটন পরিষদ সভা আহ্বান করে।

তখন যিনি সরকারপ্রধান ছিলেন তার কাছে খসড়াটি পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু সভা করা হয়নি। পরিবর্তিত অবস্থায় এখন আমরা পুনরায় পর্যালোচনা করছি। পর্যটন মহাপরিকল্পনার মধ্যে কিছু বিষয় পরিবর্তন করা জরুরি বলে মনে করছি। সে কাজগুলো আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ করবো। তারপর পুনরায় তা অনুমোদনের জন্য জাতীয় পর্যটন পরিষদে পাঠাবো। এ পরিষদের প্রধান হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

টাঙ্গুয়ার হাওর, নিঝুম দ্বীপ, সুন্দরবনের শরণখোলা ও পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারকে আমরা আন্তর্জাতিক মানের গড়ে তুলবো। পর্যটন মহাপরিকল্পনা অনুমোদন না হলেও এটি করতে আমাদের কোনো বাধা নেই। আমরা কাজ শুরু করেছি।

জাগো নিউজ: পর্যটন মহাপরিকল্পনায় কী রয়েছে?

আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের: দেশের পর্যটন বিকাশে অবকাঠামো উন্নয়ন কেমন হবে, মানোন্নয়ন কেমন হবে, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট কীভাবে হবে, পর্যটনের সঙ্গে যারা কাজ করছে তাদের কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে, পর্যটনে যারা স্টেকহোল্ডার তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে- তার বিস্তর এই মহাপরিকল্পনায় রয়েছে।

এর ভিত্তিতে আমাদের অবকাঠামো আন্তর্জাতিক মানের উন্নয়নে কাজ করবো। এরই মধ্যে আমরা পাঁচটি জায়গায় ফিজিবিলিটি স্টাডি করার জন্য নির্ধারণ করেছি। চারটি জায়গা চূড়ান্ত হয়েছে, যেখানে আমরা উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করবো। এর মধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওর, নিঝুম দ্বীপ, সুন্দরবনের শরণখোলা ও পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারকে আন্তর্জাতিক মানের গড়ে তুলবো। পর্যটন মহাপরিকল্পনা অনুমোদন না হলেও এটি করতে আমাদের কোনো বাধা নেই। আমরা কাজ শুরু করেছি।

জাগো নিউজ: বিদ্যমান পর্যটন ব্যবস্থায় সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছেন?

আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের: বিদ্যমান পর্যটন ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যা আছে। প্রথমত, পর্যটন এলাকাগুলোতে আমরা কোনো ধারণক্ষমতা নির্ধারণ করতে পারিনি। কত পর্যটক যাবে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। যেখানে এক হাজার পর্যটক যাওয়ার মতো ব্যবস্থা আছে, সেখানে ২০ হাজার যাচ্ছে। এটা তো সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস।

দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, আমাদের পর্যটন এলাকাগুলোতে পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা কম। যেমন খাবার, থাকার ব্যবস্থা অনেক ব্যয়বহুল, যা পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এটা অন্যতম বড় সমস্যা।

রাস্তাঘাট কিন্তু খুব মানসম্মত নয়। পর্যটক ভ্রমণে যেতে যেতে কোমরে ব্যথা অনুভব করেন, যে তিনি একটা কঠিন জায়গা দিয়ে যাচ্ছেন। পৃথিবীর অনেক দেশে এরকম না। উন্নত দেশে হাজার মাইল ভ্রমণ করলেও টের পাওয়া যায় না।

তৃতীয়ত, রাস্তাঘাট কিন্তু খুব মানসম্মত নয়। পর্যটক ভ্রমণে যেতে যেতে কোমরে ব্যথা অনুভব করেন, যে তিনি একটা কঠিন জায়গা দিয়ে যাচ্ছেন। পৃথিবীর অনেক দেশে এরকম না। উন্নত দেশে হাজার মাইল ভ্রমণ করলেও টের পাওয়া যায় না। এছাড়া আমাদের আবাসন ব্যবস্থা, পরিবহন ব্যবস্থা, খাবার, পর্যটন এলাকার মানুষের আচরণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, পর্যটন এলাকার মানুষ পর্যটকদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করছেন, তাদের সহযোগিতা করছে কি না এমন অনেক বিষয় কিন্তু পর্যটন সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। আমি মনে করি পর্যটন বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে শুধু ট্যুরিজম বোর্ড, পর্যটন করপোরেশন কাজ করলেই হবে না, সবাইকে এই খাতের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।

জাগো নিউজ: বিদেশে বাংলাদেশের পর্যটন নিয়ে প্রচার কম কেন?

আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের: বিদেশে প্রচারণা হয় না এটা সত্য। তবে প্রচারণার জন্য যে পরিমাণ টাকা দরকার, আমরা সেই পরিমাণ টাকা পাই না। পৃথিবীর অনেক দেশ নিজেদের পর্যটনের ব্র্যান্ডিং করার জন্য কোটি টাকা খরচ করে। আমাদের কিন্তু সেরকম বরাদ্দ নেই। সেজন্য আমরা বাইরে প্রচার করতে পারছি না। তারপরও আমাদের দূতাবাসের মাধ্যমে বিদেশে আমরা প্রচারণা চালাচ্ছি। তাদের কাছে ভিডিও, ছবি পাঠাচ্ছি। তারা এগুলো নিয়ে কাজ করে। এর বাইরে আমরা ফিজিক্যালি প্রচার করি। বিদেশে ট্যুর অপারেটরের কাছে যাই। বাংলাদেশের পর্যটনের প্রচার করি।

জাগো নিউজ: প্রতি বছর বিদেশ থেকে কী পরিমাণ পর্যটক বাংলাদেশে আসেন?

আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের: ২০২২ সালে আমাদের দেশে পাঁচ লাখ ২৯ হাজার বিদেশি পর্যটক আসে। ২০২৩ সালে আসে ৬ লাখ ৫৫ হাজার। এর মানে গ্রোথ এক বছরে একলাখের বেশি। আমরা আশা করছি বিদেশি পর্যটক ধীরে ধীরে বাড়বে। ২০৪০ সাল নাগাদ এখানে ৫৫ লাখ ৭০ হাজার বিদেশি ট্যুরিস্ট আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

পর্যটন এলাকাগুলোতে আমরা কোনো ধারণক্ষমতা নির্ধারণ করতে পারিনি। কত পর্যটক যাবে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। যেখানে এক হাজার পর্যটক যাওয়ার মতো ব্যবস্থা আছে, সেখানে ২০ হাজার যাচ্ছে। এটা তো সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরে অনেক বিদেশি ক্রেতা (বায়ার) আসেন। তাদের অধিকাংশই আসেন পর্যটন ভিসায়। তাদেরও কি পর্যটক হিসেবে ধরছেন?

আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের: বিজনেস যারা করতে আসেন তারা কিন্তু ট্যুরিস্ট ভিসায় এসেও করতে পারেন। যেমন, বাংলাদেশের একজন মানুষ যদি চিকিৎসার জন্য ভারত যান, তিনি কিন্তু অনেক জায়গায় ঘোরেন এবং নিজের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করেন। সে সংজ্ঞায় তারাও ট্যুরিস্ট।

জাগো নিউজ: দেশের ‘ইকো ট্যুরিজম’ নিয়ে ট্যুরিজম বোর্ডের মূল্যায়ন কী?

আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের: ইকো ট্যুরিজম বলতে যা বোঝায় আমাদের দেশে সেই ট্যুরিজম নেই। এই ট্যুরিজমে যেসব জিনিস মেনটেইন করতে হয়, যেমন প্রাণী, উদ্ভিদ, পানি, পরিবেশ রক্ষা করা এগুলো কিন্তু সেভাবে অনুসরণ করা হয় না। আমাদের হাউজবোটের হিউম্যান ওয়েস্ট পানিতে ফেলে দেয়। কক্সবাজারের যে হোটেলগুলো আছে, তাদের ময়লা খাল, নদী হয়ে কিন্তু সাগরে যাচ্ছে। এগুলোকে ইকো ট্যুরিজম বলে না।

খালি ছনের ঘর বানালে কিন্তু ইকো ট্যুরিজম হয় না। এজন্য অনেকগুলো বিষয় মনোযোগ দিতে হয়। এবং সেটা আমরা বলি এটা আমাদেরই দোষ। আমাদের ত্রুটি। আমরা সেভাবে তাদের প্রশিক্ষিত করতে পারিনি। সেগুলো আমরাও মনে করছি ধীরে ধীরে হবে।

আমাদের হাউজবোটের হিউম্যান ওয়েস্ট পানিতে ফেলে দেয়। কক্সবাজারের যে হোটেলগুলো আছে, তাদের ময়লা খাল, নদী হয়ে কিন্তু সাগরে যাচ্ছে। এগুলোকে ইকো ট্যুরিজম বলে না।

এছাড়া ইকো ট্যুরিজমের জন্য ইকো ট্যুরিস্ট গাইড লাগে। সেভাবে আমরা সেই গাইড তৈরি করতে পারিনি। আমরা চেষ্টা করছি। এটা আমাদের সীমাবদ্ধতা। আমাদের যে ধরনের কাজ করা দরকার সেটি এখনো সেভাবে করতে পারছি না।

জাগো নিউজ: কক্সবাজার নিয়ে ট্যুরিজম বোর্ডের পরিকল্পনা কী?

আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের: কক্সবাজার নিয়ে আমাদের মহাপরিকল্পনার একটি বড় অংশ নিয়ে কাজ করছি। কক্সবাজারকে ১১টি ক্লাস্টারে ভাগ করেছি। এই ক্লাস্টারের মধ্যে কিছু জায়গা বিদেশিদের জন্য নির্দিষ্ট রাখবো। আবার কিছু জায়গা এমন থাকবে একেবারে সংরক্ষিত। যেখানে কেউ যাবে না। আমাদের প্রাকৃতিক যে বিষয়াদি আছে যেমন লাল কাঁকড়া, কচ্ছপ ইত্যাদি সেগুলো সংরক্ষিত রাখবো।

এখন যেমন অল্প জায়গায় ট্যুরিস্ট ঘোরাঘুরি করে, সে জায়গায় আমরা সব বিচটা ব্যবহার করতে চাই। কিছু জায়গায় সারাদেশের বিখ্যাত খাবারগুলো একসঙ্গে রাখতে চাই। যাতে ট্যুরিস্ট এক জায়গায় সারাদেশের খাবারের স্বাদ নিতে পারে। এভাবে আমরা ১১টি ক্লাস্টার টেনে ভাগ করেছি। তবে আমরা এখনো কক্সবাজারের ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু করিনি। আগামী অর্থবছরে শুরু করবো। সে অনুযায়ী প্রজেক্ট তৈরি করবো।

এমএমএ/এএসএ/জেআইএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।