শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতে ভাঙন, হারাচ্ছে পর্যটন সম্ভাবনা

নুরুল আহাদ অনিক নুরুল আহাদ অনিক , জেলা প্রতিনিধি বরগুনা
প্রকাশিত: ১২:০৮ পিএম, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বরগুনার তালতলী উপজেলার শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতে ভাঙনের ফলে পড়ে আছে গাছ/জাগো নিউজ

পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাময় নদী বেষ্টিত জেলা বরগুনা। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে তালতলী উপজেলার শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত অন্যতম। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা এ সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি রয়েছে বিস্তীর্ণ বনভূমি। সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন ছুটে আসেন অসংখ্য দর্শনার্থী। বর্তমানে ভাঙনের কবলে পড়ে সৈকত ছোট হয়ে কমতে শুরু করেছে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল।

এছাড়া বিভিন্ন অব্যবস্থাপনাসহ নিরাপত্তার ঘাটতিতে দিন দিন কমছে দর্শনার্থীদের সংখ্যা। তবে পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধাসহ সৈকত রক্ষায় দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।

দেশের সর্ব দক্ষিণের উপকূলীয় জেলা বরগুনার তালতলী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের নলবুনিয়া এলাকায় খড়স্রোতা পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর মোহনায় শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত অবস্থিত। শুভ সন্ধ্যার অন্যতম আকর্ষণ হলো পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ বেলাভূমি। শুরুতে ঝাউ ও আকাশমনির বিশাল বন সৈকতটি করেছে আরও আকর্ষণীয়। বিশেষ করে বিকেলের সূর্যাস্তের সময় এই সৈকত রূপকথার মতো লাগে। সৈকতটি এখনও তুলনামূলকভাবে জনবহুল না হওয়ায় প্রকৃতিপ্রেমীরা এখানে নির্জন পরিবেশে প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পান। তবে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, সৈকতের অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তার ঘাটতি এবং প্রাকৃতিক ভাঙনের কারণে পর্যটকদের আগ্রহ কিছুটা কমেছে। নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে এখানে আয়োজন করা হয়েছিল জ্যোৎস্না উৎসব।

‘রাস্তার অবস্থা ভালো না থাকায় এখানে আসতে অনেক কষ্ট হয়েছে। তবে এখানে এসে আমাদের সব কষ্ট সার্থক, এখানে সব কিছুই প্রাকৃতিক। এক পাশে বন, অন্য পাশে সমুদ্র। সমস্যা হচ্ছে এখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে কেউ নেই।’- পটুয়াখালী থেকে আসা পর্যটক ফাল্গুনী সরকার

শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত ঘুরে দেখা যায়, ভরা জোয়ারে ডুবে আছে চারপাশ। ভাঙনের ফলে পড়ে আছে শত শত গাছ। সৈকতে বসার কোনো জায়গা না থাকায় দর্শনার্থী যারা আসছেন কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ফিরে যাচ্ছেন। সৈকতে দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় নেই কোনো নিরাপত্তাকর্মী। তাই যেসব নারী দর্শনার্থী আসছেন তারাও বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়ছেন।

শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতে ভাঙন, হারাচ্ছে পর্যটন সম্ভাবনা

অনেকের অভিযোগ, এখানে বখাটেদের উৎপাত বেশি। এছাড়া সৈকতে সরকারি গণশৌচাগারটিও বেহাল। দুটি শৌচাগারের একটি খোলা থাকলেও তা ব্যবহার অযোগ্য। সরকারিভাবে দুই কক্ষের ‘সাম্পান’ নামে একটি ডাকবাংলো করা হলেও সেখানে নেই খাবারের ব্যবস্থা। শুভ সন্ধ্যা জুড়ে দর্শনার্থীদের খাবারের জন্য রয়েছে মাত্র চারটি চায়ের দোকান। তাই মন ভোলানো এই সমুদ্র সৈকতে এসে অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন মন খারাপ করে।

পটুয়াখালী থেকে শুভ সন্ধ্যায় ঘুরতে আসা ফাল্গুনী সরকার নামের এক পর্যটক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি শুভ সন্ধ্যা সৈকত সম্পর্কে আগে জানতামই না। বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে এখানে এসেছি। রাস্তার অবস্থা ভালো না থাকায় এখানে আসতে অনেক কষ্ট হয়েছে। তবে এখানে এসে আমাদের সব কষ্ট সার্থক, এখানে সব কিছুই প্রাকৃতিক। এক পাশে বন, অন্য পাশে সমুদ্র। সমস্যা হচ্ছে এখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে কেউ নেই। যেমন এখানে এসে আমার ইচ্ছে করছে রাত পর্যন্ত থাকতে। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় সন্ধ্যার আগেই এখান থেকে চলে যেতে হবে। তাছাড়া এখানে থাকা-খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। কর্তৃপক্ষ যদি এদিকে নজর দেয় তবে আশা করি এটি বাংলাদেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হতে পারে।’

‘কুয়াকাটা থেকে এটি অনেক সুন্দর। কিন্তু এখানে আসার রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। তাছাড়া এখানে থাকা বা খাবার হোটেল নেই, নেই বিশ্রামাগার। যদি এগুলো সব কিছু ঠিকভাবে করা যায় তবে এখানে অনেক পর্যটক আসবে।’- পর্যটক লিমু

বরগুনা সদর থেকে ঘুরতে আসা লিমু জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের অনেক জায়গায় ঘুরেছি। তবে এখানে প্রথম এসেছি৷ এই সমুদ্র সৈকতের সঙ্গে কুয়াকাটার কোনো পার্থক্য নেই। বরং কুয়াকাটা থেকে এটি অনেক সুন্দর। কিন্তু এখানে আসার রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। তাছাড়া এখানে থাকা বা খাবার হোটেল নেই, নেই বিশ্রামাগার। যদি এগুলো ঠিকভাবে করা যায় তবে এখানে অনেক পর্যটক আসবে।’

শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতে ভাঙন, হারাচ্ছে পর্যটন সম্ভাবনা

শুভ সন্ধ্যা সৈকতে ঘুরতে আসা ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘হতাশার জায়গা থেকে বলতে হচ্ছে এখানে এক বছর আগে এসেছিলাম তখন সৈকতটা বড় ছিল, সেটা ভেঙে অনেকটাই সাগরে চলে গেছে। আপনারা দেখেন যে শত শত গাছ পড়ে আছে। এরপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘার মধ্যে আছে গাছ চোরাকারবারি। দেখলাম এই বনের অনেক গাছ কাটা, হয়তো চোরাকারবারিরা এগুলো নিয়ে যাচ্ছে। যদি কর্তৃপক্ষ এদিকে একটু নজর দেয় এবং নিরাপত্তা জোরদার করে, তখন সারাদেশ থেকে মানুষ এই সৈকত দেখতে আসবে। এখানে কৃত্রিমতা নেই কোনো।’

‘সমুদ্র সৈকতটি ভেঙে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো পর্যটক আসেন না। তাছাড়া এখানে এসে রুটি-কলা ছাড়া কোনো খাবারও থাকে না। এখানে এসে পর্যটকরা যেমন মুগ্ধ হন, আবার কিছু না পেয়ে কষ্ট নিয়ে ফিরে যান।’- স্থানীয় বাসিন্দা আবুল হাসান

শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দা আবুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সমুদ্র সৈকতটি ভেঙে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো পর্যটক আসেন না। তাছাড়া এখানে এসে রুটি-কলা ছাড়া কোনো খাবারও থাকে না। এখানে এসে পর্যটকরা যেমন মুগ্ধ হন, আবার কিছু না পেয়ে কষ্ট নিয়ে ফিরে যান।’

আরও পড়ুন

‘এক পাশে নদীভাঙন, অন্য পাশে সাগরে সৈকত বিলীন হওয়ায় অনেকের ইচ্ছা থাকলেও ভাঙনের ভয়ে তারা ব্যবসা করতে আসছেন না। সরকার যদি ভাঙন রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তবে স্থানীয় উদ্যোগ বাড়বে এবং এলাকাবাসী এর থেকে স্বাবলম্বী হবে।’ বলেন আবুল হাসান।

শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতে ভাঙন, হারাচ্ছে পর্যটন সম্ভাবনা

এ বিষয়ে স্থানীয় স্কুল শিক্ষক মো. শাহিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাঙনের ফলে দিন দিন সমুদ্রের শিশুটি ছোট হয়ে আসায় ফলে পর্যটক কমে যাচ্ছে। এখানে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হচ্ছে না। থাকার ব্যবস্থার মধ্যে সরকারিভাবে করা একটি ছোট গেস্টহাউজ রয়েছে, যেখানে শুধু দুটো রুম আছে। এছাড়া খাবারের কোনো হোটেল নেই, যার কারণে পর্যটকরা এখানে আসা কমিয়ে দিচ্ছেন। একবার এলেও আর আসেন না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি এটা আমলে নিয়ে একটু প্রচার-প্রচারণাসহ থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে তবে এখানে পর্যটক বাড়ার পাশাপাশি সার্বিকভাবে এটার উন্নয়ন হতো।’

‘যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে পর্যটনে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ এলাকায় পর্যটক আসছে না। আমরা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করছি। তালতলীর সঙ্গে কুয়াকাটাকে নিয়ে একটি পর্যটন হাব তৈরি করার সম্ভাবনা আছে। ভাঙন প্রতিরোধসহ এ সমুদ্র সৈকতের উন্নয়নে আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো।’- বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সফিউল আলম

যা বললেন ইউএনও-ডিসি

এ বিষয়ে তালতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালমা বলেন, ‘তালতলী উপজেলায় বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এর মধ্যে শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত অন্যতম। পর্যটকদের সুবিধার্থে এখানে রাতে লাইটের ব্যবস্থাসহ নিরাপত্তার বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলবো।’

আরও পড়ুন

বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সফিউল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পর্যটনের সঙ্গে যোগাযোগ ও অবকাঠামো একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে পর্যটনে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ এলাকায় পর্যটক আসছে না। আমরা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করছি। তালতলীর সঙ্গে কুয়াকাটাকে নিয়ে একটি পর্যটন হাব তৈরি করার সম্ভাবনা আছে। ভাঙন প্রতিরোধসহ এ সমুদ্র সৈকতের উন্নয়নে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো।’

এনএএ/এমএমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।