পাহাড়পুর ভ্রমণে কী দেখবেন, কীভাবে যাবেন?
হুট করেই আশরাফ স্যারের ফোন। শান্ত সাহেব, কি অবস্থা, ফ্রি আছো? ফ্রি থাকলে মোটরসাইকেল নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের এদিকে চলে এসো। আজ মোটরসাইকেলে পাহাড়পুর ঘুরতে যাব। আমি শুধু হ্যাঁ, বলেই ফোন কেটে দিলাম। যথারীতি মোটরসাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
দুই মিনিটে পৌঁছে গেলাম সোনাতলা ফায়ার স্টেশনের সামনে। স্যার এর পাশেই টিউশনি করান। তিনি টিউশনি শেষ করে, বের হয়েই মোটরসাইকেলে চালকের আসনে বসলেন। ব্যাস, আমাদের যাত্রা শুরু হলো।
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা থেকে পাহাড়পুরের দুরত্ব বেশি নয়, মাত্র ৬৫ কিলোমিটারের পথ। মোটরসাইকেলে পৌনে দুই ঘণ্টান্টার মধ্যেই যাওয়া যায়। আমরা প্রায় ৩০ মিনিট পর পৌঁছালাম মোকামতলা বাস স্ট্যান্ডে।
সেখানে নেমে গরুর মাংসের কালা ভুনা আর আটার রুটি দিয়ে সকালের নাশতা সেরে ফেললাম। ও হ্যাঁ, আমরা রওনা হয়েছিলাম সকাল ৯টায়। এরপর চা পান করে, আবারও রওনা হলাম গন্তব্যে।
পথিমধ্যে স্যার বললেন, ‘শান্ত সাহেব পাহাড়পুর শুধু দেখলে হবে না, এর পেছনের গল্পও জানতে হবে। অনুভব করতে হবে।’ আমি বললাম, ‘জ্বি স্যার, বর্ণনা করুন তাহলে।’ স্যার বললেন, ‘এখন না, আগে পাহাড়পুর যাই।’
পাহাড়পুর বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। পাহাড়পুরের আরেক নাম সোমপুর বৌদ্ধবিহার বা মহাবিহার। এটি পৃথিবীজুড়ে পরিচিত তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও স্থাপত্যশৈলীর জন্য। বুকভরা উত্তেজনা নিয়ে শুরু হলো আমাদের এক নতুন অভিযাত্রা।
পাহাড়পুর পৌঁছানোর আগেই মন যেন ইতিহাসের গভীরে হারিয়ে গেল। স্যার জানালেন, এই জায়গাটি এক সময় পাল বংশের বিখ্যাত সম্রাট ধর্মপালের হাতে গড়ে উঠেছিল। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষ দিকে নির্মিত এই বিহারটি ছিল একটি বৃহৎ ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র।
চীন, তিব্বত, মায়ানমারসহ পৃথিবীর দূর-দূরান্ত থেকে ভিক্ষু ও ছাত্ররা আসতেন এখানে। খ্রিস্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিল অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি প্রদান করেন।
ভাবতেই আমার গা শিউরে ওঠলো, আমাদের দেশের এমন গৌরবময় একটি স্থান আছে। আশরাফ স্যার আরও জানালেন, পাহাড়পুর শুধু একটি জায়গা নয়, এটি সময়ের একটি স্তম্ভ। এখানে দাঁড়ালে বুঝবেন, আমরা কত গভীর ইতিহাসের উত্তরাধিকার।
অবশেষে আমরা দু’ঘণ্টা পর পৌঁছালাম গন্তব্যে। চারপাশ যেন প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় মোড়া। সেখানে দাঁড়িয়ে চোখে পড়ল বিশাল এক ঢিবি, যা দূর থেকে পাহাড়ের মতোই মনে হয়। তবে এটিই সেই পাহাড়পুর। স্থানীয়রা এটাকে পাহাড়পুর ডাকে, যদিও ইতিহাস বলে এর আসল নাম সোমপুর বিহার।
প্রথম দেখাতেই স্থাপনার বিশালত্ব আমাদের অভিভূত করল। এটি একটি বিশাল চতুষ্কোণ আকৃতির বিহার, যার চারপাশে ছিল ছোট ছোট কক্ষ। কথিত আছে, এসব কক্ষ ছিল ভিক্ষুদের আবাসস্থল। আমরা ধীরে ধীরে বিহারের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম।
সেখানে আছে একটি সুউচ্চ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরটির স্থাপত্যশৈলী দেখে বোঝা যায়, এটি কেবল ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি ছিল প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক ও শিল্পকর্মের অন্যতম নিদর্শন।
স্যার জানালেন, ১৮৭৯ সালে পাহাড়পুর বিহারের প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করেছিলেন স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম। তবে জমিদারদের বিরোধিতার কারণে কাজ খুব বেশি এগোয়নি।
পরবর্তী সময়ে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে ও বিভিন্ন গবেষকের প্রচেষ্টায় বিহারের বেশিরভাগ অংশই খনন করা হয়। তারা এখানে অনেক পোড়ামাটির ফলকচিত্র, প্রাচীন দেয়াল, মূর্তি ও নকশা উদ্ধার করেন। এসব নিদর্শন পাল যুগের সমৃদ্ধি ও বৌদ্ধ ধর্মের সাক্ষ্য বহন করে।
আমরা হাঁটছিলাম বিহারের উন্মুক্ত চত্বরের ভেতর দিয়ে। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দেখা মিলল ভোজনশালা ও রন্ধনশালার। কী চমৎকার ছিল তাদের পরিকল্পনা! এমনকি পানির নিষ্কাশন ব্যবস্থাও অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ছিল। ভেতরের এক জায়গায় খুঁজে পেলাম কিছু স্তূপ। স্যার বললেন, ‘তৎকালীন সময়ে এখানে নানা রকম ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালিত হতো।’
এরপর আমরা পাহাড়পুরের চারদিক ঘুরতে লাগলাম। স্যার বিভিন্ন পোড়ামাটির ফলক দেখাচ্ছে আর কাহিনী বর্ণনা করছেন। স্যার জানালেন, তিনি পাহাড়পুরে বেশ কয়েকবার এসেছেন। যদিও আমি আসলাম প্রথমবার। কোন পাশে কী আছে, তা স্যারের একদম মুখস্থ। এরপর আমরা গেলাম পাহাড়পুর সংলগ্ন জাদুঘরে। সেখান থেকে বের হয়ে স্যার চা পানের প্রস্তাব রাখলেন।
বিহারের বাইরে ছোট একটি চায়ের দোকানে আমরা বসলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে স্যার আমাকে পাহাড়পুর নিয়ে আরও অনেক গল্প শুনালেন। এরপর হুট করে বলে উঠলেন, ‘শান্ত সাহেব, দিনের অনেক বাকি আছে। চলো শালবন যাই, খুব বেশি দূরে না। সেখানে গেলে আলতাদিঘিও দেখতে পারবে। তারপর আবার রওনা হলাম শালবনের পথে।’
যা জানা প্রয়োজন
পাহাড়পুর সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সোমবার আধাবেলা ও রোববার পূর্ণদিন বন্ধ থাকে। বিহারে প্রবেশ করতে ২০ টাকা প্রবেশমূল্য দিতে হয়।
ঢাকা থেকে যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে নওগাঁ যাওয়া যায়। বাসে যেতে চাইলে গাবতলী বা মহাখালী থেকে শ্যামলী, হানিফ, এসআর, কেয়া, টিআর ও মৌ এন্টারপ্রাইজে যেতে পারেন। এসি, নন-এসিভেদে এসব বাসের ভাড়া জনপ্রতি ৭০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা।
এরপর নওগাঁ থেকে স্থানীয় যানবাহনে ৫০ থেকে ৬০ টাকা ভাড়ায় সরাসরি পাহাড়পুর যাওয়া যায়। এছাড়া জয়পুরহাট জেলা থেকেও বাস অথবা অটোরিকশা যোগে এখানে আসা যায়। জয়পুরহাট শহর থেকে পাহাড়পুরের দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার।
জেএমএস/এএসএম