ঈগল আর পাহাড়ের দ্বীপ লাংকাউই

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৭:২৯ পিএম, ১১ নভেম্বর ২০২৪

কাজী মনজুর করিম মিতুল

লাংকাইউতে স্কাই ব্রিজ আর স্কাই ক্যাবের তীব্র আকর্ষণে আমরা যখন পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে গ্র্যাবের গাড়িতে ছুটে চলছিলাম, তখন রাস্তার পাশে আমাদের যেন স্বাগত জানাচ্ছিল দলে দলে বানর। তাদের দেখেই আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম।

লাংকাউই মূলত ৯৯টি ছোট বড় দ্বীপ নিয়ে গঠিত। মূল ভূখণ্ডের মতো শহুরে নয় বলেই পৃথিবীর সব দেশ থেকে এখানে পর্যটকেরা ছুটে আসে। প্রকৃতি আর আধুনিকতা যেন অপূর্ব এক মিশ্রণ নিয়ে কাছে ডাকে সবাইকে। লাংকাউই বিমানবন্দরে নামার আগে থেকেই এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমরা বিমোহিত হয়ে পড়েছিলাম। আর স্কাই ব্রিজ যাওয়ার জন্য স্কাই ক্যাবে ওঠার পর যখন দূর দিগন্তে দৃষ্টি প্রসারিত করলাম, তখন পাহাড়, সমুদ্র, মেঘ আর দূরের ইন্দোনেশিয়া যেন স্বর্গীয় এক দৃশ্য চোখের সামনে মেলে ধরলো।

ঈগল আর পাহাড়ের দ্বীপ লাংকাউই

দিনটা মে মাসের প্রথম শুক্রবার। আমরা বেশ সকালেই পৌঁছালাম বলে ভিড় কম পেলাম। পর্যটনের মৌসুমও তখন ভাঁটার দিকে। তাই অনায়াসেই টিকিট পেলাম। টিকিট মানে একটা কাগজে বারকোড প্রিন্ট করা, সেটা হতের কবজিতে ব্যান্ড হিসেবে পরে থাকতে হয় সর্বক্ষণ। ঢোকার মুখে বারকোড স্ক্যান করে প্রবেশাধিকার মিললো।

স্কাই ক্যাব শুরুতেই আমাদের নিয়ে গেলো প্রথম স্টেশনে। তারে ঝুলে থাকা সে গাড়িতে একটু একটু করে শূন্যে ভেসে ওঠার সে অনুভূতি ভাষায় অপ্রকাশ্য। একটু একটু করে ক্যাব উঠছে পাহাড়চূড়ার দিকে, আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত হচ্ছে আদিগন্ত। সমুদ্র, আকাশ আর পাহাড় যেখানে নীল আর সবুজের এক অবিস্মরণীয় জলছবির মতো প্রতিভাত হয়।

ঈগল আর পাহাড়ের দ্বীপ লাংকাউই

প্রথম স্টেশনটিতে ঈগল নেস্ট নামে রয়েছে এক সুউচ্চ রেস্টুরেন্ট, যার অবকাঠামো ঈগলের ঠোঁটের আদলে তৈরি। খাবার দাবারের দামও রেস্টুরেন্টের উচ্চতার মতো আকাশছোঁয়া। বাইরে মূল্য তালিকা দেখে ভেতরে আর ঢুকলাম না। বাইরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আর প্রকৃতি দেখেই আমরা তৃপ্ত।

এরপর টপ স্টেশনে নিয়ে স্কাই ক্যাব আমাদের নামিয়ে দিলো। সেখান থেকে কিছু দূর হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে উঠে স্কাই ব্রিজ। সে এক আশ্চর্য সেতু! দুই পাহাড়ের মাঝে এক ঝুলন্ত সেতু, যার দৈর্ঘ্য ১২৫ মিটার (৪১০ ফুট), প্রস্থ ১.৮ মিটার (৬ ফুট) আর উচ্চতা ৬৬০ মিটার (২১৭০ ফুট)। নির্মাণ শুরু হয় ২০০৩ সালে, উদ্বোধন হয় ২০০৪ সালে।

ঈগল আর পাহাড়ের দ্বীপ লাংকাউই

আমাদের ভাগ্য ভালো, বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলেও আমরা ঝকঝকে আকাশ পেয়েছি। বাতাসও মৃদু, তাপমাত্রা ৩৬°-৩৮° সেলসিয়াস। ভারি বৃষ্টি হলে না কি স্কাই ব্রিজে পর্যটকদের আসতে দেওয়া হয় না। টপ স্টেশন থেকে পাহাড়ি বনের ভেতর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে স্কাই ব্রিজে আসতে হয়। স্কাই গ্লাইড নামে যে এক কেবিনের রেল লিফট আছে, সেটায় চড়তে জনপ্রতি ১০ রিংগিত লাগে। তাই নামার সময় হেঁটেই নামলাম। ফেরার পথে হেঁটে উঠতে কষ্ট হবে, তাই সেটায় চড়ার অভিজ্ঞতাও হলো। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হলো। প্রত্যেকবার ১০ জন করে নেয়, দাঁড়িয়ে যেতে হয়। ভালোই লেগেছে দেড় মিনিটের সেই উত্থান। তবে গালভরা নাম (স্কাই গ্লাইডিং) শুনে শুরুতে ভেবেছিলাম আকাশে উড়িয়ে নেবে, সেই হিসেবে কিছুটা হতাশ হলাম।

ঈগল আর পাহাড়ের দ্বীপ লাংকাউই

এবার স্কাই ক্যাবে করে ফেরার পালা। স্কাই ক্যাব থেকে নামার সময়টাও রোমাঞ্চকর। আর নামার পর ওরা বের হবার পথ করেছে স্যুভেনির শপের ভেতর দিয়ে। ব্যবসা এরা খুব ভালো বোঝে। এমনকি গোড়াতে আমাদের যে ছবি তুলে রেখেছিল (আমি ভেবেছিলাম নিরাপত্তা জন্য তুলেছিল), তা এবার সুন্দর করে এডিট করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে আমাদের উপহার দিতে চাইলো। বিনিময়ে ৬০ রিংগিত দিতে হবে। প্রত্যাখ্যান করলে ক্ষতি নেই, ওরা নষ্ট করে ফেলবে। আমরা তাই সে অফার প্রত্যাখ্যান করলাম। টাকা আমাকে কষ্ট করে রোজগার করতে হয়, কাজেই দামি স্যুভেনিরটা নিলাম না।

ঈগল আর পাহাড়ের দ্বীপ লাংকাউই

এরপর 3D Art Gallery, Sky Rex ও Sky Dome পরিদর্শন। গত বছর ঢাকায় সামরিক জাদুঘরের 3D Art Gallery চমকপ্রদ লেগেছিল। এদেরটায় তার থেকে একটু বেশি চমক আছে। আর Sky Rex একটা ভার্চুয়াল রাইড। 3D চশমা পরে একটা ট্রেনের মতো যানে চড়ে বসতে হয়। সেটা আপনাকে নিয়ে যাবে জুরাসিক জগতে। আমাদের অভিজ্ঞতাটা দারুণ হতে পারতো। কিন্তু দায়িত্বরত তরুণ আমাদের চশমা দিতে ভুলে গেলো। যখন চাইলাম, সে তখন ফিরে যাচ্ছিল রাইড শুরু করে দিয়ে। আমার ডাকে সে ফিরলো না। ওই চশমা ছাড়া দৃশ্যগুলো ঘোলাটে দেখায়! মেজাজ আমার খিচড়ে রইল এর পরের এক ঘণ্টা।

ঈগল আর পাহাড়ের দ্বীপ লাংকাউই

Sky Dome মূলত বাচ্চাদের জন্য। আমাদের দেশের নভোথিয়েটারের মতো একটা গম্বুজাকৃতির ছাদে প্রজেক্টর দিয়ে এখানে একটা কার্টুন ফিল্ম দেখানো হলো। অ্যাকশনধর্মী সায়েন্স ফিকশান, যা দেশপ্রেমের মন্ত্র শেখায়। ভালোই লেগেছে। তবে আমার পুত্র এখন আর কার্টুন দেখার বয়সে নেই, তাই আমাদের ক্ষেত্রে পয়সা উশুল বলা যাবে না।

এক কথায়, আমাদের লাংকাউই সফরের মূল পর্ব ছিল এটা। ওখান থেকে চলে গেলাম চেনাং বিচ। চেনাং বিচটাও আমার দারুণ লেগেছে। এর সকালের রূপ যেমন শান্ত ও স্নিগ্ধ, সন্ধ্যার রূপে আছে উৎসবের আমেজ। ফিলিস্তিনে ইজরায়েলের হামলার প্রতিবাদে সেদিন আগুন খেলার আয়োজন করা হচ্ছিল। অল্প বয়সী ছেলেরা দারুণ খেলা দেখালো।

ঈগল আর পাহাড়ের দ্বীপ লাংকাউই

প্যারাসেইলিং বা ওয়াটার বাইক চালানো এখানে আরো উপভোগ্য। খাবার দাবারের আয়োজনে পাপড় থেকে পিজ্জা সব আছে। ডিউটি ফ্রি পারফিউম, চকলেট আর পোশাকের যেন মেলা বসেছে বিশাল আকারে।

Underwater World এই বিচের অন্যতম আকর্ষণ। সেখানে পেঙ্গুইন আর সাগর তলের চমকপ্রদ সব প্রাণীর দেখা মেলে। আরও অনেক কিছু দেখার ও করার ছিল এই স্বপ্নদ্বীপে। সময় ও টাকা ফুরিয়ে আসছিল বলে সবখানে যেতে পারিনি। তাই হয়তো লাংকাউইকে বিদায় জানাবার দিন ‘আবার দেখা হবে’ বলে ফিরে এসেছি।

ঈগল আর পাহাড়ের দ্বীপ লাংকাউই

লাংকাউই থেকে পিনাংয়ের ফ্লাইট সন্ধ্যায়। আমরা দুপুরে মোটেল থেকে চেক-আউট করে রাস্তার ওপারেই একটা ইন্দোনেশিয়ান রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে নিলোম। এদের সি-ফুড ফ্রাইড রাইস অসাধারণ। লাংকাউই বিমানবন্দরটা আন্তর্জাতিক হওয়ায় বেশ বড় আর সুন্দর। আমরা মোটেল ছেড়ে দিয়ে বিকেলটা দিব্যি ভেতরে কাটিয়ে দিলাম। অবশ্য এয়ার এশিয়া আমাদের নিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই উড়াল দিলো। পিনাং-এ অবতরণ করলো খুবই স্বল্প সময়ে। বোয়িং এর চেয়ে এয়ার বাস আমাদের বেশি মনে ধরলো এর হিমশীতল এসি-র কারণে। এর cabin crew-রা খাবার দেয় না তো কী হয়েছে? আচরণ মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স থেকে ভালো।

চলবে...

এমআরএম/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।