কক্সবাজারে সমুদ্রস্নানে বাধভাঙা উচ্ছ্বাস
রুমেল আহসান
কর্মব্যস্ততা আর যাপিত জীবনের ধকলে হাঁপিয়ে ওঠা কিংবা একঘেয়েমিতে আটকে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এসব থেকে মুক্তি পেতে কার না মন চায়? দীর্ঘদিন ধরে আমরা পরিকল্পনা করছি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে যাবো। অবশেষে ১৮ আগস্ট যাওয়ার তারিখ নির্ধারিত হয়। ওইদিন রাত সাড়ে দশটায় সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও রেলস্টেশন থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেসে আমরা যাত্রা শুরু করি। যাত্রাপথে সবাই গল্প ও হাসি-আড্ডার মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করি।
বলাবাহুল্য, আমাদের এই ভ্রমণে সবাই সংবাদকর্মী। ফেঞ্চুগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি রিয়াজ উদ্দীন ইসকা, সহ-সভাপতি মামুনুর রশীদ, সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম বাবুল, সিনিয়র সাংবাদিক শাহ মুজিবুর রহমান জকন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেলওয়ার হোসেন পাপ্পু, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক রুমেল আহসান, সদস্য জাহিদুর রহমান রিপন ও ছামি হায়দার। আমাদের এই ভ্রমণে সঙ্গী ছিলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী ও ভ্রমণপিপাসু আহমদ আলী, জহিরুল ইসলাম শিহাব ও সাকিব হোসেন।
১৯ আগস্ট সকাল সাড়ে ৬টায় আমরা চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে পৌঁছাই। স্টেশনের রেস্ট হাউজের (আবাসিক হোটেলে) তিনটি রুমে উঠে পড়ি। ফ্রেশ হয়ে সবাই সকালের নাস্তা করি। নাস্তা শেষে কেউ ঘুমাচ্ছেন না। সবাই আড্ডায় ব্যস্ত। আমাদের অগ্রজ ইসকা ভাইয়ের কাছ থেকে বিভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গল্প শুনছি। অবশেষে সকাল সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে পর্যটন এক্সপ্রেসে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। বিকেল ৩টায় আমরা কক্সবাজার স্টেশনে পৌঁছাই। স্টেশন থেকে অটোতে করে একটি খাবার হোটেলে যাই। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে সমুদ্রসৈকতের পাশে থ্রি স্টার হোটেল কক্সে উঠে পড়ি।
হোটেলে সবাই রেস্ট নিতে ব্যস্ত থাকেন। এর মধ্যে আমরা তরুণ পাঁচজন সন্ধ্যায় সুগন্ধা বিচে উত্তাল সমুদ্রের ঊর্মিমালা দেখতে যাই। সৈকতের মায়াবী বিকেলে বিশাল জলরাশির সঙ্গে মিশেছে নীল আকাশ। ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতের বুকে। এ দৃশ্য দেখে যে কারো হৃদয় নিমিষেই জুড়িয়ে যাবে। রাতে আমরা হোটেলে ফিরি। নৈশভোজের জন্য ভালো মানের খাবার হোটেল খুঁজতে বের হলাম। সৈকতের পাশে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ রান্না করা খেলাম। রাতে আমরা ১১ জন সৈকতে গেলাম। সেখানে ঢেউয়ের গর্জন ও আছড়ে পড়া উপভোগ করলাম। একে একে ভাটিয়ালি ও বাউল গান গাইতে লাগলাম। মন চেয়েছিল সারারাত সৈকতে থেকে যাই। গতকাল রাতে ও আজকের দিনে ট্রেনে যাত্রা করায় সবাই ক্লান্ত ছিলেন। তাই হোটেলে গিয়ে শুয়ে পড়ি।
পরদিন ২০ আগস্ট ঘুম থেকে উঠে সকাল ১০টায় একসাথে হোটেলের নিচে বুফে নাস্তা করি। দুপুর ১২টায় সৈকতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি পর্যটকের ঢল। আমরা নেমে পড়ি সমুদ্রস্নানে। সবাই বাধভাঙা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠি। ধেয়ে আসছে সমুদ্রের ঢেউ। সৈকত থেকে খানিকটা দূরে কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে সবাই। সমুদ্রের মতোই সবার চোখে-মুখে আনন্দের ঢেউ। পুরো তিন ঘণ্টা সমুদ্রস্নান উপভোগ করলাম। এর মধ্যে চলছে ফটোসেশন। প্রত্যেকে যার যার মতো ছবি তুলছেন। আবার গ্রুপ ছবিও হলো। নবীন-প্রবীণের এই ভ্রমণ ফ্রেমবন্দি থাকা জরুরি। কারণ একসাথে সবাই দূরে কোথাও যাওয়া হয় না।
আরও পড়ুন
ওইদিন বিকেলে আমরা বের হয়ে পড়ি মেরিন ড্রাইভে। কক্সবাজারে গিয়ে যদি বিশ্বের দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ রোড না ঘুরে আসেন, তাহলে জীবনের ষোলোআনাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এটি ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা, যা কক্সবাজারের কলাতলী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। সুগন্ধা পয়েন্টে মেরিন ড্রাইভ রোড যাওয়ার খোলা জীপ ভাড়া করলাম। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ ধাঁধানো দৃশ্য দেখলাম। বিশাল বিস্তৃত সৈকত, ইনানী পাথুরে সৈকত ও জেলেদের সাগরে মাছ ধরা উপভোগ করা যায়। মেরিন ড্রাইভ রোডের একপাশে সমুদ্রসৈকত এবং অন্যদিকে ছোট-বড় পাহাড় আছে সবুজে ঢাকা। পাহাড়ের দেহ বরাবর জলের স্রোতগুলো কিছু জায়গায় দেখে খুব আনন্দিত হওয়া ছাড়া উপায় নাই।
মেরিন ড্রাইভ রোডের বিভিন্ন স্থানে আছে দারুণ রেস্টুরেন্ট। আমাদের জীপ চালকের কথামতো একটি রেস্টুরেন্টে যাই। সেখানে বিভিন্ন ভর্তা ও সাগরের মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার খাই। সুস্বাদু এ খাবারে সবাই রেস্টুরেন্টের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সন্ধ্যায় পাটুয়ারটেক যাই। সেখানে সৈকতে নোঙর করে রাখা হয়েছে দারুণ সব রঙিন সাম্পান। ভাটার সময় পাথরগুলো জেগে ওঠে। পাথরের বুকে আছড়ে পড়ছে উত্তাল ঢেউ। সে এক অন্যরকম সৌন্দর্য। যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আবার মেরিন ড্রাইভে রাত ৯টায় হোটেলে ফিরে আসি। সবাই ফ্রেশ হয়ে রাত ১১টায় রাতের খেতে বের হই। সাগরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ দিয়ে খাবার খেয়ে ফিরে এসে ভোররাত পর্যন্ত গল্প-আড্ডায় অতিবাহিত করি।
ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ২২ তারিখ আমরা কক্সবাজার থেকে সিলেট ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিই। চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী উদয়ন এক্সপ্রেসের টিকিট অনলাইন বুকিং করা হয়। ২১ তারিখ দুপুরে কক্সবাজার থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে চট্টগ্রাম রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। বাসে থাকাকালীন অনলাইন গণমাধ্যমে জানতে পারি, চট্টগ্রামের সঙ্গে সারাদেশের সড়ক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ। উপায়ন্তর না পেয়ে ওইদিন রাতে চট্টগ্রাম নগরীর হোটেল গোল্ডেন ইনে রাত্রিযাপন করি।
রাতের খাবার খেয়ে সবাই বিকল্প হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে বিমান যোগে সিলেটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। অনলাইনে বিমানের টিকিট পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। কারণ সড়ক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় সবাই বিমানযোগে ঢাকা বা অন্য জেলায় যেতে চাচ্ছেন। আমরা ১১ জন যার যার মতো করে রাতের মধ্যে বিমানের টিকিট কেটে নিই। ২২ তারিখ সকাল ৮টায় হোটেল থেকে বের হয়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাই। সকাল সাড়ে ৯টার ফ্লাইটে যাত্রা করে সকাল ১০টায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঢাকায় পৌঁছাই। সেখান থেকে দুপুর ১টার ফ্লাইটে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে আমাদের প্রাণের ফেঞ্চুগঞ্জ ফিরে আসি।
একসঙ্গে বিমানের টিকিট না পাওয়ায় পৃথকভাবে আমরা ঢাকা পৌঁছাই। ঢাকা থেকে সিলেট একসঙ্গে আসি। বলাবাহুল্য, সড়ক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার খবরে আমাদের অনেক অগ্রজ, আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষী খোঁজখবর নিয়েছেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। বন্যায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার খবর পেয়ে আমাদের সবার পরিবারের লোকজন খুব চিন্তিত ছিলেন।
লেখক: সিলেটের সাংবাদিক।
এসইউ/এমএস