সেকেন্দ্রাবাদে সম্রাট আকবরের সমাধিসৌধে গিয়ে যা দেখবেন
ফাত্তাহ তানভীর রানা
নয়াদিল্লিতে মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিসৌধ দেখার পরে অভিভূত হয়ে যাই। সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম উদ্যান-সমাধিসৌধ। যার সমাধি দেখেই আমরা অবাক! জানি না তার সাম্রাজ্য, তার শাসন কেমন ছিল!
সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিসৌধ পর্যটক কর্তৃক সর্বোচ্চ দর্শিত, অবস্থান রাজধানী নয়াদিল্লি হওয়ার কারণে। অন্যান্য মোঘল সম্রাটদের সমাধিসৌধ দেখার প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। প্রসঙ্গত: নয়াদিল্লির কাছাকাছি আগ্রায় সম্রাট আকবর ও সম্রাট শাহজাহানের সমাধিসৌধ অবস্থিত।
পরিকল্পনামাফিক আমি ফতেহপুর সিক্রি ভ্রমণের পরে টুরিস্ট বাসে সরাসরি আগ্রায় চলে এলাম। সেখান থেকে অটোরিকশাতে সেকেন্দ্রাবাদে নামলাম। উইকিতে ভ্রমণ করে সিকান্দ্রাবাদ সম্পর্কে আগেই ধারণা নিয়েছিলাম।
আমার হাতে সময় কম ছিল, সম্রাট আকবরের রাজধানী ফতেহপুর সিক্রিতে বেশ সময় দিয়েছিলাম। অনেকবার ঘুরে ঘুরে ফতেহপুর সিক্রি দেখেছি। তবুও কি দেখার শেষ হয়? ঢাকার প্রথম সুবাদার ইসলাম খানের সমাধি ফতেহপুর সিক্রিতে অবস্থিত।
জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর, যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে মহান শাসকদের অন্যতম হিসেবে মহামতি আকবর নামেও পরিচিত। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট, যিনি ১৫৫৬-১৬০৫ সাল পর্যন্ত মোট ৪৯ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেন। পিতা সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে আকবর ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন।
বৈরাম খানের তত্ত্বাবধানে তিনি ভারতবর্ষ ও আফগানিস্তানে তার সাম্রাজ্য বিস্তার চালিয়ে যান। সম্রাট আকবরের অধীনে মোঘল ভারত একটা স্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থা পায়। তখন ভারতের সম্পদ তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। ১৬০৫ সালের অক্টোবর মাসে সম্রাট আকবর উদরাময় রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
আকবরের মৃত্যুর পর তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করেন ও সাম্রাজ্য বিস্তার অব্যাহত রাখেন। শাসনকালের শেষ দিকে সম্রাট আকবর আগ্রার লালকেল্লা, ফতেহপুর সিক্রি, লাহোরের লালকেল্লা, এলাহাবাদের লালকেল্লা, সিকান্দ্রাবাদের সমাধি ভবন নির্মাণ করেন।
সম্রাট আকবর সম্পর্কে বলতে গেলে আরও সময় প্রয়োজন। যাই হোক, দ্রূত টিকিট কেটে সমাধিসৌধের মূল ফটকে চলে এলাম। মূল ফটক (দক্ষিণ দ্বার) দেখে নয়ন ভরে গেল। ৪০০ বছরের বেশি সময় আগে নির্মিত হলেও এখনো যেন পুরোনো হয়নি। প্রধান গেট মোঘল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত হয়েছে।
দ্বিতল ফটকে আছে তাজমহলের মতো দেখতে শ্বেত পাথরের তৈরি চারটি বড় বড় মিনার। মিনারের উপরটি অনেকটা ছাতার মতো। বাকিটা লাল পাথরের তৈরি সুন্দরভাবে কারুকাজ করা। সূক্ষ্ম কারুকাজ করার জন্য কালো জেড পাথর আর শ্বেত পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল।
এই প্রধান প্রবেশ পথ তৈরি করা হয়েছে অনেকটা ফতেহপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজার অনুকরণে। ফটক সামনে বা পেছনে এক রকম করে নির্মাণ করা হয়েছে। যেদিক থেকেই দেখা হোক না কেন, মনে হবে সামনে থেকে দেখছি। প্রধান ফটক বা মূল ফটকের পরে ছোট একটা ফটক আছে।
ছোট ফটক দিয়ে ঢুকতেই সুবিশাল কম্পাউন্ড চোখে পড়লো। সামনে পানির ফোয়ারা, তারপর সম্রাটের সমাধি। পানির ফোঁয়ারা পুরোনো মনে হলো, দীর্ঘদিন সংস্কারও করা হয়নি। সমাধিস্থলের চারদিকে চারটি গেট আছে। গেটগুলো সব একই আদলে তৈরি।
তবে ঢোকা যায় শুধু দক্ষিণের গেট দিয়েই। প্রধান প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকে বেশ খানিকটা হেঁটে সমাধিস্থলে যেতে হয়। এই রাস্তার দুধারে আছে বিশাল সবুজ মাঠ। এই মাঠে অনেক পোষা হরিণ ও ময়ূর রয়েছে শুনেছি। তবে তা আমার চোখে পড়েনি।
সমাধিসৌধটি বেশ বড় ও চারতলাবিশিষ্ট। প্রধানত লাল বেলে পাথরের তৈরি এই সৌধটি ধাপে ধাপে, পিরামিডের মতো, চার তলা পর্যন্ত উঠে গেছে। সামনের দরজার আশপাশের জায়গাগুলো শ্বেত পাথরের কারুকার্য করা। সম্রাট হুমায়ূনের সমাধিসৌধ আকারে অনেক বড় ও বিস্তর এলাকাজুড়ে।
সে তুলনায় সম্রাট আকবরের সমাধি আকারেও ছোট, জৌলুশও কম। তাজমহলে সম্রাট শাহজাহানের সমাধিসৌধ বিশ্বজনীন। তাজমহল বিশ্বের কে চেনেন না? সম্রাট আকবরের সমাধিতে পর্যটকদের ওপরের তলাগুলোতে ওঠার সুযোগ নেই। সমাধি দেখেই ফিরে আসতে হয়।
সম্রাট আকবরের সমাধিসৌধে ঢুকেই দেখা যাবে সুন্দর করে আঁকা বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা, ফুল ও অন্যান্য প্যাটার্ন। কোনোটা ঘন নীলের ওপর সোনালি রং আবার, কোনোটি হালকা রঙের ওপর ঘন লাল দিয়ে ফোটানো সুন্দর নকশা। দেওয়ালে ফাটল ধরার জন্যে নকশা খানিকটা নষ্ট হয়ে গেছে। ফাটলগুলো সিমেন্ট-বালি দিয়ে পূরণ করা হলেও নকশাগুলোর সংস্কার করা হয়নি। সমাধিসৌধে দীর্ঘদিন যত্নের অভাব স্পষ্ট!
আরও পড়ুন
মোঘল সম্রাট আকবরের সমাধিসৌধ মুঘল স্থাপত্যের একটি অন্যতম নিদর্শন। সমাধিসৌধ নির্মাণ করতে ব্যয় হয় তখনকার সময়ে আনুমানিক ১৫ লাখ টাকা। ১১৯ একর জমির ওপর স্থাপিত সমাধিসৌধটির নির্মাণ কাজ ১৬০৫ সালে শুরু হয় ও ১৬১৩ সালে নির্মাণ সম্পন্ন হয়। সমাধিসৌধ নির্মাণ শুরুটা সম্রাট আকবর করলেও, সমাপ্ত করেন তর পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর।
সেকেন্দ্রাবাদ সমাধিফলকে প্রচুর বানরের উপদ্রব আছে। আমি ভিজিটিং আওয়ারের শেষ সময়ে যাওয়ার কারণে দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল না বললেই চলে। অল্প কিছু দর্শনার্থী আসছেন, কিছু সময় দেখার পরে চলে যাচ্ছেন। আমি পুরো কমপাউন্ড হেঁটে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রধান ফটকের ডানদিকের ফটকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর খেয়াল করলাম আমি একা!
একটি বানর দেখছি, মনে করলাম তার সঙ্গে গল্প করা যেতে পারে। হঠাৎ দেখলাম পাশের ঝোপ থেকে বেশ কয়েকটি বানর আসছে! আমি দ্রুত স্থান ত্যাগ না করে পারিনি। এবার সম্রাট আকবরের সমাধিস্তম্ভের মূল ভবনে এসেও লক্ষ্য করলাম, পাশে দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বানররা মিটিং করছে।
তখন প্রায় সন্ধ্যা দর্শনার্থীদের আনাগোনা কমছে আর বানররা স্থান দখলের পরিকল্পনা করছে। আমার সময় শেষ হয়ে যাবার আগে বানরদের দৃশ্য ভিডিও করার চিন্তা করলাম। তবে যদি ভিডিওসহ মোবাইল নিয়ে যায়! তখন কি হবে?
সেকেন্দ্রাবাদ সমাধিফলকের জায়গাটি ছিল ঘন জঙ্গলে ভরা। সম্রাট জাহাঙ্গীর এখানে শিকারে আসতেন, বিশ্রাম নিতেন। সম্রাটের বিশ্রাম করার ঘর কাঁচমহল আজও দৃশ্যমান। কাঁচমহল এক সময় হারেম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সময় স্বল্পতার কারণে কাঁচঘরে আমার যাওয়া হয়নি।
বেসমেন্টে সম্রাট আকবরের কবর কম আলোর একটা ঘরের ভেতর অবস্থিত। সেখানে যাওয়ার সুড়ঙ্গও অন্ধকার। কবরটি সাদা পাথর দিয়ে আবৃত। এ সমাধিসৌধে ৪০টি সমাধির জায়গা নির্ধারণ করা থাকলেও সমাধি আছে চারজনের। সম্রাট আকবর, সম্রাট আকবরের বোন, সম্রাট শাহজাহানের ছেলে ও মেয়ের।
কথিত আছে, এখানে সম্রাট আকবরের সমাধি থাকলেও তার দেহাবশেষ নেই। ১৬৮৮ সালে জাট বিদ্রোহে অংশ নেয়া সেনারা সম্রাট আকবরের সমাধিস্তম্ভ থেকে হাড়গোড় বের করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে ওবং সমাধিস্তম্ভ লুটপাট করে। সম্রাট আওরঙ্গজেব সমন জারি করেন।
শাস্তিস্বরূপ, এককালের কাশ্মীরের শাসক রাজা রাম সিংহকে মথুরার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়। সমাধিতে সম্রাট আকবরের দেহাবশেষ থাকুক অথবা না থাকুক দর্শনার্থীরা বিশ্বাস করে, সমাধিতে সম্রাট শায়িত রয়েছেন।
আকবর দ্যা গ্রেটের কবরস্থানে সম্রাট শাহজাহানের কবরস্থানের (তাজমহল) মতো ছবি তোলা নিষিদ্ধ। আমি দূর থেকে সেই সময় ছবি তুলেছিলাম। তবে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগার পাশে অবস্থিত সম্রাট হুমায়নের সমাধিসৌধে ছবি তুলতে বাধা নেই। সেকেন্দ্রাবাদ আগ্রায় অবস্থিত হলেও অধিকাংশ মানুষ তাজমহল দেখে সম্রাট আকবরের সমাধিস্তম্ভ না দেখার মতো ভুল করেন।
নয়াদিল্লি থেকে সেকেন্দ্রাবাদ যেতে হলে আগ্রা যেতেই হবে। তাই, আগ্রার বাস থেকেই সিকান্দ্রায় যাওয়া যায়। আগ্রা শহর থেকে আধাঘণ্টায় যাওয়া যায় সেকেন্দ্রাবাদের সমাধি ভবনে। নয়াদিল্লির নিজামুদ্দিন বাস্ট্যান্ড থেকে এসি ও নন-এসি বাসে আগ্রা যাওয়া যায়।
ভারতীয় টুরিস্ট বা বাংলাদেশের ভ্রমণকারীদের জন্য টিকেট মূল্য ৩০ রূপি। সমাধিস্তম্ভে যাবার সময় গাইড তথ্য দিতে চাইতে পারে। কেউ চাইলে গাইড নিতে পারে, গাইড না নিলেও সমস্যা নেই। সমাধিসৌধ থেকে বের হতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ততক্ষণে ক্ষুধায় পেট অস্থির!
পাশের হোটেলে বসে পেট পূজা করতেই মনে হল, সামনেই তো মরিয়ম-উজ-জামানের (যোধা বাঈ) সমাধি। কিন্তু এতক্ষণে সামাধিসৌধ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সম্রাট আকবরের সমাধিস্তম্ভ দেখলাম, সম্রাজ্ঞীর সমাধিফলক অদেখাই রয়ে গেল।
লেখক: ব্যাংকার ও গল্পকার।
জেএমএস/এমএস