গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল

মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে এলাম যেভাবে

ইকরামুল হাসান শাকিল
ইকরামুল হাসান শাকিল ইকরামুল হাসান শাকিল , পর্বতারোহী ও লেখক
প্রকাশিত: ০৪:১০ পিএম, ১৪ জুলাই ২০২৩

ইতিহাস হলো লেখা। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর রহমতে সকলের সহযোগিতা, উৎসাহ ও দোয়ায় ‘দ্য গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’ অভিযান সফলভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা উত্তর বেসক্যাম্পে (প্যাঙপেমা, ৫,১৪২ মি.) শেষ করেছি। চলতি বছরের মেঘে ঢাকা জুলাইয়ের ৯ তারিখ ভোর সাড়ে চারটায় লোনাক থেকে রওয়ানা হয়ে সকাল ৭.৫০ মিনিটে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেসক্যাম্পে পৌঁছাই।

হিমালয় পর্বতের পশ্চিমে নেপাল-তিব্বতের হিলশা এলাকার সীমান্ত গেইট থেকে শুরু করে পূর্ব নেপালের কাঞ্চনজঙ্ঘা বেসক্যাম্প পর্যন্ত ১ হাজার ৭শ কিলোমিটার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছি। মূলত দীর্ঘ এই পথকে ‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’ বলা হয়ে থাকে। আর তাই তো এক বুক স্বপ্ন নিয়ে লাল-সবুজের হয়ে প্রথমবারের মতো এই অভিযান করেছি। গত বছর ১০ জুলাই ঢাকা থেকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছাই। ‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’-এর আনুষাঙ্গিক প্রস্তুতি নিতে নিতে কাঠমান্ডুতে ১৫ দিন কেটে যায়। এর মাঝে সব ধরনের জটিলতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা মিটিয়ে ফেলতে হয়েছে। ২৫ জুলাই কাঠমান্ডু শহর ছেড়ে বাসে চেপে পৌঁছাই নেপালগঞ্জে। নেপালগঞ্জ থেকে তারা এয়ারলাইন্সের ছোট একটি যাত্রীবাহী বিমানে করে ৪৯ মিনিটের আকাশপথে যাত্রা শেষে পৌঁছাই সিমিকোটে। সেখানে পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়নি। কেননা এখানকার প্রকৃতির মেজাজ সম্পর্কে আগে থেকেই ধারণা ছিল। মূলত সেই অভিজ্ঞতাই আমাকে সাহস জুগিয়েছে। জুলাইয়ের ২৮ তারিখ সকাল থেকে অভিযান শুরু করলাম। একটানা ৪ দিন ট্রেকিং করে পশ্চিম নেপালের নেপাল তিব্বত বর্ডারে ৩ হাজার ৬৪২ মিটার উচ্চতার হিলশা গ্রামে পৌঁছাই।

আরও পড়ুন: ‘গ্রেট হিমালয়ান ট্রেইল’ অভিযানে যাচ্ছেন শাকিল

আগস্টের প্রথম সকালেই হিলশা থেকে মূল অভিযান শুরু করে হোমলা, মোগু, ডোলপা, মানাঙ, গোরখা, রুবি ভ্যালি, ল্যাঙটাঙ, হিলাম্বু, গৌরিশঙ্কর, সলোখুম্বু, এভারেস্ট বেসক্যাম্প, মাকালু ন্যাশনাল পার্ক হয়ে নেপালের উঁচু-নিচু দুর্গম বিপজ্জনক পথ পায়ে হেঁটে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেসক্যাম্পে পৌঁছাই ২০২৩ সালের ৯ জুলাই সকাল ৭.৫০ মিনিটে। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সময় লেগেছে ৯৬ দিন এবং আমাকে হাঁটতে হয়েছে মোট ১০২ দিন।

এই অভিযানের মাঝপথে মুস্তাং জেলার অন্নপূর্ণা সার্কিট করে বাংলাদেশ নেপালের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ নেপাল ফ্রেন্ডশিপ অভিযানে দুইবার এভারেস্ট আরোহনকারী এম এ মুহিতের নেতৃত্বে দোগারি ও ডোলমা খাং নামক দুটা ৬ হাজার মিটারের পর্বত অভিযানে অংশগ্রহণ করি এবং ডোলমা খাং (৬,৩৩২ মি.) পর্বত সফলভাবে আরোহন করে পুনরায় গ্রেট হিমালয়া ট্রেইলের অভিযান শুরু করি।

নেপালের সবথেকে রিমোট (প্রত্যন্ত অঞ্চল), সীমাবদ্ধ, দুর্গম ও বিপজ্জনক এই দীর্ঘ উচ্চ হিমালয়ের পথ পাড়ি দিতে অতিক্রম করতে হয়েছে ২৯টি কঠিন পর্বতের পাস। যার মধ্যে ১৪টি পাঁচ হাজার মিটারের অধিক উচ্চতার দুর্গম ও বিপজ্জনক কঠিন পাস। এই ট্রেইলে পাড়ি দিতে গিয়ে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে পথ হারাতে হয়েছে অসংখ্যবার।অনাহারে দিন-রাত কাটাতে হয়েছে। কখনো কখনো পাথুরে পথ নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিপদের সম্মুখীনও হতে হয়েছে। পাহাড় ধসের মতো মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। বরফ ফাটল ও হিমালয়ের বিপজ্জনক গ্লেসিয়ার পাড়ি দিতে হয়েছে। অসংখ্য বরফগলা খরস্রোতা ঠান্ডা পানির নদীতে নেমে পাড় হতে হয়েছে। অর্থের অভাবে স্থানীয় মানুষদের কাছে হাত পাততে হয়েছে। তবুও হাল ছাড়িনি, স্বপ্নভঙের ভয়ে ভেঙে পড়িনি। স্বপ্নজয়ের পথে ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে সেখান থেকে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছি।

আরও পড়ুন: ‘ডোলমা খাং’র শিখরে চার বাংলাদেশি

এই অভিযানে হিমালয় পর্বতের কোলঘেঁষে কতশত গ্রাম, নদী, জঙ্গল, পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য রোমাঞ্চকর বৈচিত্র্যময় সুন্দর ও ভয়ানক অভিজ্ঞতাও পেতে হয়েছে। ভয়ানক সুন্দর এই পৃথিবীর বুকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেও যেন দ্বিধা হয়নি। হিলশা থেকে শুরু করে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেসক্যাম্প পর্যন্ত হিমালয়ের দুর্গম ও বিপজ্জনক ১৭০০ কিলোমিটারের অধিক পথ পাড়ি দিয়ে আমি এখন কাঠমান্ডুতে অবস্থান করছি।

‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’ অভিযানের শুরু থেকেই অসংখ্য মানুষ আমাকে বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেছেন। অর্থিক ভাবে, পরামর্শ দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে নানাভাবে আপনারা পাশে থেকেছেন। আপনাদের প্রতি চির কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনারা পাশে ছিলেন বলেই আমি এই কঠিন পথটা পাড়ি দিতে পেরেছি এবং সাহস পেয়েছি। আমার এই পুরো অভিযানে স্থানভেদে তিনজন শেরপা গাইড সাথে ছিলেন; অর্জুন রায়, তাশি গ্যালজেন শেরপা ও পাসাঙ শেরপা।

অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল এবং কষ্টসাধ্য পর্বতাভিযান এই ‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’। যা সারাবিশ্বে এখন পর্যন্ত পঞ্চাশ জনেরও কম পর্বতারোহী এই অভিযান পুরোটা সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। আর এই অভিযান সফলভাবে শেষ করে হিমালয়ের ইতিহাসের পাতায় বাংলাদেশের নাম লিখিয়ে তুলে ধরেছি লাল-সবুজের গর্বের পতাকা। কিন্তু অর্থাভাবে এই ঐতিহাসিক সফলতা নিয়ে দেশে ফিরতে পারছি না। অভিযানে দারাজ, হা-মীম গ্রুপ, মিস্টার নুডলস, বিএমটিসি এবং মোহাম্মদ হলিডেজ পাশে দাঁড়ালেও এখনো সম্পূর্ণ অর্থ জোগান হয়নি। অভিযানে খরচের জন্য নেপালের বেশ কয়েক জনের কাছ থেকে লোন এবং গাইড ও পোর্টারের বিল বাবদ প্রায় আড়াই লাখ টাকা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন: গারওয়াল হিমালয়ে লাল-সবুজের পতাকা

আমি নিজেকে ভয়ঙ্কর মৃত্যুময় অভিজ্ঞতার সাথে আলিঙ্গন করিয়েছি। দেশের নামকে সম্মানিত করে পর্বতারোহনের ইতিহাসে নতুন এক পালক যুক্ত করেছি। এখন দেশবাসীর কাছে সহযোগিতা চাই। আপনারা পাশে দাঁড়ালেই খুব শিগগির সফলতার আনন্দ নিয়ে দেশে ফিরতে পারবো।

একনজরে পর্বত অভিযান
অভিযান: দ্য গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল (নেপাল)
দূরত্ব: ১৭০০ (+) কিলোমিটার
অভিযান শুরু: ০১ আগস্ট ২০২২
অভিযান শেষ: ০৯ জুলাই ২০২৩
হাঁটতে হয়েছে: ৯৬ দিন + শুরুর জায়গায় যাওয়া ও শেষ করে ফেরা ৬ দিন (মোট ১০২ দিন)
বিশ্রামসহ: ১০২ দিন + ৭ দিন (মোট ১০৯ দিন)
মোট পাস: ২৯টি (পাঁচ হাজার মিটারের অধিক ১৪টি)
সর্বোচ্চ উচ্চতা: ১৮,৮৮২ ফুট (৫,৭৫৫ মি.)
সর্বোনিম্ন উচ্চতা: ১,৩২৯ ফুট (৪০৫ মি.)

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।