চা বাগানসহ শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে আরও যা দেখবেন
রুবেল আহমেদ আলিফ
শ্রীমঙ্গল শহরটি ছোট, তবে বেশ গোছানো। এই শহরের সব স্থাপনার মাঝেই নান্দনিকতার ছাপ। শহরের বেশির ভাগটা জুড়েই আছে চা বাগান। এখানে আপনি যে দিকেই তাকাবেন দুচোখ জুড়ে দেখবেন চায়ের বাগান।
যা দেখলে চোখ জুড়ে খেলে যাবে এক অপরূপ সুন্দর ও সবুজের সমারোহ। তাই এবার মিনহাজ উদ্দিন রুবেল ভাই ও আমি বাইক নিয়ে ঘুরে আসি শ্রীমঙ্গলের আকর্ষণীয় চা বাগানে।
আরও পড়ুন: ঢাকার কাছেই ঘুরে আসুন বাঁশ-কাঠের তৈরি ‘রূপগাঁও রিসোর্টে’
চা বাগান মানেই ‘অ্যাডভেঞ্চার’। সবুজের চাদরে মোড়ানো চা বাগান আমাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। বাংলাদেশে মোট ৭টি ভ্যালি আছে, এর মধ্যে সিলেট বিভাগে আছে ৬টি। এই ভ্যালিতে মোট চা বাগানের সংখ্যা ১৩৮টি। শুধু শ্রীমঙ্গলেই আছে ৩৮টি চা বাগান। এ জন্য শ্রীমঙ্গলকে চায়ের রাজধানীও বলা হয়।
এতো চা বাগান, আপনি কোন বাগান দেখতে যাবেন সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হবে। কারণ শ্রীমঙ্গলের পূর্বদিকে ভেতর দিয়ে চলবেন তখন আপনার মনে হবে বিশ্বের সব সৌন্দর্য্য যেন আপনার সামনে। একটি রিকশা, মিশুক কিংবা প্রাইভেট কার নিয়ে প্রবেশ করুন চা বাগানের ভেভিতর।
চা বাগানে ঢোকার পর মনে হবে ভিন্ন পরিবেশ। মনে হবে কোনো শিল্পী যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে স্তরে স্তরে সবুজকে সাজিয়ে রেখেছেন। চারপাশে কেবল সবুজের মেলা।
চা বাগান দেখা শেষ হয়ে গেলে আপনি চলে যেতে পারেন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। শ্রীমঙ্গল থেকে ভানুগাছ-কমলগঞ্জ রাস্তায় ৭ কিলোমিটার এগুলেই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।
আরও পড়ুন: এক রাতের মধ্যেই খনন করা হয় যে ঐতিহাসিক দিঘি
জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণীর মহামিলনের নান্দনিক সৌন্দর্য্যরে স্থান লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য্যমণ্ডিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ট্রপিক্যাল ফরেস্ট’খ্যাত। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই উদ্যানে পশু-পাখি দর্শনের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। যেখানে উঁচু-নিচু পাহাড়ের গায়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার প্রজাতির লাখ লাখ বৃক্ষ।
ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশ করা মাত্রই আপনি দেখবেন চারদিকে হালকা অন্ধকার রাস্তায় দু’পাশের বৃক্ষগুলো দিবাকরের আলোক রশ্মিকে আটকে রেখেছে। মাঝে মাঝে বৃক্ষসারির মগডালে চোখ রাখুন দেখবেন বানর আর হনুমান লাফালাফি করছে।
একটু ভেতরে প্রবেশ করলে আপনার চোখে পড়বে খাটাস, বনমোরগ, উল্লুক, মেছোবাঘ, বন বিড়ালসহ বিভিন্ন জীবজন্তু আর পার্কের বিশাল বিশাল বৃরাজি, জীবজন্তুর হুঙ্কার, ঝিঝি পোকার শব্দ, বানরের লাফালাফি, ঝাঁকঝাঁক উল্লুকের ডাকাডাকি।
আরও পড়ুন: পাহাড়ের ওপর বিমানবন্দর, নিচে লেক
একটু সময়ের জন্য হলেও আপনার ব্যস্ত জীবনের কান্তি দূর করে মনে এনে দেবে প্রশান্তির ছোঁয়া। সীমিত শহরের ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে এখনো মানুষ পেতে চায় শ্যামল অভয়ারণ্যের ছোঁয়া কিংবা একটু নিস্তব্ধতার একাকিত্ব।
ভ্রমণপিপাসুদের কথা ভেবেই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর শ্যামলীতে নির্মাণ করা হয়েছে একটি পিকনিক স্পট। সবুজের অপরূপ সাজে সজ্জিত শ্যামলী। প্রকৃতিপ্রেমিক, ভ্রমণ বিলাসী ও সৌন্দর্য পিপাসুদের জন্য একটি দর্শনীয় স্থান এটি। এর বাস্তবতা মেলে রাস্তায় দু’পাশে সারিবদ্ধ গাড়ির বহর দেখে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা গাড়িতে বিভিন্ন ধরণের ও রঙের ব্যানার ঝুলানো থাকে, কেউ বা ব্যানারে লিখেন ‘শ্যামলীতে আনন্দ ভ্রমণ’ বা ‘শিক্ষাসফর’। আবার কেউ বা লিখেন ‘বনভোজনে আমরা ক’জন’।
দিন দিন মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে, কাজের চাপে যান্ত্রিক মানুষগুলো একঘেঁয়েমির মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। তাই একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি পেতেই তারা ছুটে আসেন শান্ত, অনাবিল সবুজ প্রকৃতির কাছে।
আরও পড়ুন: কম খরচে বালি ভ্রমণ করবেন যেভাবে
আর মানুষের এসব চাহিদা মেটাতেই বুঝি চির সবুজের সাজে সেজেছে শ্যামলী। পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে শ্যামলীর সুনাম ছড়িয়ে আছে সারাদেশে। এখানে রয়েছে নানা প্রকার বৃক্ষারাজি। দেশের আর কোথাও একইসঙ্গে এত বৈচিত্র্যময় বৃক্ষ দেখা যায় না। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ভানুগাছ সড়ক ধরে ৭ কিলোমিটার দূরে শ্যামলীর অবস্থান।
শ্রীমঙ্গল থেকে শ্যামলীর উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়র পর পরই প্রথমে চোখে পড়বে রাস্তার দু’পাশে দৃষ্টিজুড়ে চায়ের বাগান। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাস্তা পেরিয়ে চোখে পড়বে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষগুলো। হ্যাঁ, এগুলোই রাবার গাছ। এরপর পরই সহজেই চোখে পড়বে কাশফুলের সাদা পাহাড়।
নীল আকাশের নিচে সবুজের গালিচা, তারই একপাশে শরতের বাতাসে দোল খেয়ে যাচ্ছে কোমল কাশফুলগুলো। আর হ্যাঁ বেড়ানোর ফাঁকে এককাপ চা হলে মন্দ হয় না। রীতিমতো অবিশ্বাস্য। বিস্ময়করতো বটেই। এক কাপে ৭ রঙের চা! এটি উদ্ভাবন করেছেন রমেশ রাম গৌড়।
আরও পড়ুন: নোয়াখালীর ‘মিনি কক্সবাজারে’ গিয়ে যা যা দেখবেন
আলোড়ন সৃষ্টিকারী রমেশের চায়ের দোকানে খুব সহজেই পৌঁছাতে পারেন। শ্রীমঙ্গল শহরের কালিঘাট রোড ধরে এগিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের রাস্তায় যেতে বামদিকে চেখে পড়বে বিজিবি’র ১৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর এলাকায় মিনি পার্কের আদলে গড়ে ওঠা ‘নীলকন্ঠ চা কেবিন’।
মিডিয়ার বদৌলতে তার আবিস্কৃত দু’ থেকে আটরঙা চা’র খ্যাতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে ভিনদেশেও। দেশের উচ্চপদস্থ সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন দূতাবাসের রাস্ট্রদূত, রাজনীতিবিদ, চলচ্চিত্র ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত পর্যটকরা তার চা’র স্বাদ নিয়েছেন। রমেশের সঙ্গে তারা ছবি তুলেছেন। পরিদর্শন খাতায় লিখে গেছেন বিস্ময়কর রমেশের চায়ের ভূয়সী প্রশংসা।
শ্রীমঙ্গলে এসে শুধু সবুজের ছোঁয়া নিবেন তা তো হয়না একটু পানির ছলছল শব্দও তো শোনা উচিত। তাই চলে যান শহরের কাছাকাছি জাগছড়া চা বাগানের ১৪ নং সেকশনে যজ্ঞকুণ্ডের ধারায়। সেখানে আছে অপরূপ সৌন্দর্য সমৃদ্ধ শ্রীমঙ্গলের একমাত্র ঝরনা।
আরও পড়ুন: গরমে ভ্রমণে গেলে সুস্থ থাকতে যে নিয়ম মানবেন
যারা এ ঝরনাকে প্রথম দেখবেন তারা অবশ্যই বিস্মিত হবেন। এটিও অপরূপ একটি সৃষ্টি। ঝরনাটি দেখতে আপনি শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মৌলভীবাজার রোড হয়ে কাকিয়াবাজার নেমে ডানদিকে জাগছড়া চা বাগানে যাবেন।
অথবা শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ভাড়াউড়া ও সোনাছড়া চা বাগান হয়ে মেটো রাস্তায় জাগছড়া চা বাগানে গিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করে আপনি চলে যাবেন জাগছড়ার ১৪নং সেকশনে।
সেখানে চোখে পড়বে একটি ব্রিজ। ব্রিজের ডান পাশ দিয়ে ছড়ার পাড় ধরে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই শুনতে পাবেন শোঁ শোঁ শব্দ। নেমে পড়বেন পাহাড় ছড়ায় দেখবেন, কোনো জাদুকর মাটিতে অপরূপ কারুকাজ করে পানি প্রবাহের পথ করে দিয়েছেন। আমরা চারদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।
এবার বাড়ি ফেরার পালা। তবে কিছু সময়ের জন্য মনে হচ্ছিল আরও কিছু সময় যদি সেখানে আড্ডা দেওয়া যায়। কি সুন্দর সব কিছু! তবে জীবনের তাগিদে ফিরে আসতে তো হবে। এরপর বাইক করে ফিরলাম প্রিয় শহরের উদ্দেশ্যে।
আরও পড়ুন: পানির নিচে ৯০০ ফুটের দানব গর্তের সন্ধান মেক্সিকোতে
পরিশেষে বলতে চাই, প্রকৃতির পরম মমতায় গড়া এ অঞ্চলের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সবুজের মাঝে হারিয়ে যেতে এর চেয়ে ভালো পছন্দ হতে পারে না। এখানে সংস্কৃতির বিচিত্রতা দেখা ছাড়াও এ অঞ্চলের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান ভ্রমণপিপাসুদের তৃষ্ণা মেটাবে।
কীভাবে যাবেন?
প্রতিদিন ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলের পথে চারটি আন্তঃনগর ট্রেন যাত্রা করে কমলাপুর রেলষ্টেশন থেকে। এছাড়া সায়েদাবাদ থেকেও আসতে পারবেন চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গলে।
কোথায় থাকবেন?
কোলাহলমুক্ত পরিবেশে থাকতে চাইলে উঠতে পারেন চা বাগানের ভিতর বিটিআরআই রেস্ট হাউজ অথবা টি রিসোর্টে। এছাড়া শ্রীমঙ্গল শহরে ২০টিরও বেশি আবাসিক হোটেল আছে।
ভালো দেখে যে কোনো একটিতে উঠতে পারেন। ভাড়া মোটামুটি কম। শ্রীমঙ্গল শহরে উখযোগ্য হোটেলগুলো হলো- টি টাউন রেস্ট হাউজ, নিরালা রেস্ট হাউজ, এলাহী প্লাজা, হোটেল মুক্তা প্রভৃতিতে উঠতে পারেন।
লেখক: সিনিয়র ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজার, সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।
জেএমএস/জেআইএম