ঢাকার অদূরে একদিনেই ঘুরে আসুন পানাম নগরে
মামুনূর রহমান হৃদয়
ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়া পানাম নগরীর বাড়িগুলো যুগের পর যুগ দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। প্রতিটি ইটের দেয়ালে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গন্ধ।
আবহমান বাংলার শিল্প ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহকের ভূমিকায় এখানকার পুরোনো, জীর্ণশীর্ণ ভবনগুলো।
আরও পড়ুন: পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক সেতু, পার হওয়ার সাহস নেই কারও
বলছি ঢাকার অদূরে সোনারগাঁয়ের পানাম নগরের কথা। পানাম নগর বাংলার প্রাচীনতম শহর। এক সময় ধনী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের বসবাস ছিল এখানে।
ছিল জমজমাট মসলিনের ব্যবসা। প্রাচীন এই নগরীর অন্য সবকিছু অবশিষ্ট নেই। এখন আছে শুধু ঘুরে দেখার মতো ঐতিহাসিক পুরোনো বাড়িগুলো।
পানাম নগর পৃথিবীর ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের একটি। প্রাচীন সোনারগাঁওয়ে বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগর এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণীয়।
আরও পড়ুন: মক্কা থেকে মদিনায় বুলেট ট্রেন চালাবেন সৌদি নারীরা
সোনারগাঁওয়ের ২০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পানাম নগরী গড়ে উঠে। আজ থেকে প্রায় ৪৫০ বছর আগে ১৫ শতকে ঈশা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সোনারগাঁও এলাকায়।
আর তা দেখার জন্যই নগরের কোলাহল ছেড়ে ছুটে চলা! ঢাকা থেকে খুব কাছে বলে সিদ্ধান্ত হলো পানাম নগর ঘুরে আসার।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সরকারি তিতুমীর কলেজের সংগঠন ‘তিতুমীর কলেজ সাংবাদিক সমিতি’ এর উদ্দ্যেগে আয়োজন করা হয় স্বস্তির ফুরসত সফর।
আরও পড়ুন: বিশ্বের রহস্যময় এক স্থান ‘লাভ টানেল’
বসন্তের রৌদ্রজ্জ্বল সকালে একদল উচ্ছল, তারুণ্যদ্দীপ্ত, প্রাণবন্ত আর সৃজনশীল গণমাধ্যমকর্মীদের ছুটে চলা। এ সফরে যারা আমাদের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি আমাদের সবার প্রিয় সাব্বির আহমেদ ও রাব্বি হোসেন ভাই।
তিলোত্তমা রাজধানীর তিতুমীর কলেজ ছেড়ে বাস ছুটে চললো ঈসা খাঁ কর্তৃক স্থাপিত ‘বাংলার প্রথম রাজধানী’ সোনারগাঁও’র দিকে। সবার চোখেমুখে আনন্দের অভিব্যক্তি।
সারাপথ যেতে যেতে চললো হৈ-হুল্লোড়, আর নাচ-গান। ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় দুপুর হওয়ার আগেই পৌঁছে যাই আমরা। এবার পুরোটা ঘুরে দেখার পালা।
আরও পড়ুন: ছুটির দিনে ঢাকার ভেতরেই ঘুরে আসুন নিরিবিলি দুই স্থানে
কারও চোখে মুখে ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও নেই। পুরোটা ঘুরে দেখতে দেখতে মনে হতে লাগলো যেন ঐতিহাসিক অতীতে ফিরে গেছি!
ভেতরটা মালয়েশিয়ার প্রচীনতম শহর মালাক্কার থেকে কোন অংশে কম নয়। সেই শহরটাকেও হার মানিয়েছে আমাদের এই পানাম শহর। এই শহরের প্রতিটি ইট-পাথরের আছে একেকটি ইতিহাস।
স্থাপনাগুলোর স্থাপত্যে ইউরোপীয় শিল্পরীতির সঙ্গে মোঘল শিল্পরীতির মিশ্রণ দেখা যায়। আছে নিখুঁত কারুকাজ। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আর স্থিরচিত্র মুঠোফোনে ধারণ করছে।
চোখে আরও পড়লো একটি সরু রাস্তার ধারে সারি সারি পুরোনো দালান। কোনোটি দোতলা কোনোটি আবার একতলা। বাড়িগুলোর স্থাপত্য নিদর্শন দেখেই বোঝা যায় এখানে ধনী-বণিক শ্রেণীর লোকেরা বসবাস করতেন।
আরও পড়ুন: বিশ্বের যে ৪ শহরে বসবাস করতে চাইলেই পাবেন জমি ও টাকা
বাড়িগুলোতে মোঘল ও গ্রীক স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ দেখা যায়। প্রতিটি বাড়ির কারুকাজ স্বতন্ত্র। কারুকাজ, রঙের ব্যবহার ও নির্মাণকৌশলের দিক থেকে নতুন নতুন উদ্ভাবনী কৌশলের প্রমাণ পাওয়া যায় এখানে।
নগরীর ভিতরে আবাসিক ভবন ছাড়াও আছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ, গোসলখানা, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, দরবার কক্ষ, গুপ্ত পথ, বিচারালয়, পুরোনো জাদুঘর।
কিছু দূর হাঁটলেই দেখা যায় আম, লিচু, নারকেলসহ শত শত গাছ। পথিককে ছায়া দিতে এই গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে যুগের পর যুগ। আছে ছোট-বড় কয়েকটি পুকুর। তবে যত্নের অভাবে আর আশেপাশের ময়লা ফেলার কারণে তা ভাগাড়ে রূপ নিয়েছে।
বেশ কয়েকটি স্থাপনার গায়ে লক্ষ্য করা যায় সিসি ক্যামেরা। আর কিছুদূর পর পর দাড়িয়ে আছে আনসার ও টুরিস্ট পুলিশ। তাদের একটাই নজর, যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।
আরও পড়ুন: পৃথিবীর নজরকাড়া যে স্থাপত্য দেখলে চোখ হবে ছানাবড়া
যত সময় গড়িয়ে যাচ্ছে ততই দর্শনার্থী বাড়ছে। আর বাড়তে লাগলো পানাম নগরের রূপ। কনে দেখা আলোয় পানাম নগরের প্রতিটি ইট রক্তলাল হয়ে আছে।
সোনারগাঁওয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য পানামের আশপাশে অনেক সেতু তৈরি করা হয়েছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পানাম পুল ও দুলালপুর পুল।
পানাম পুল এখন আর সেখানে নেই। কালের বিবর্তনে আজ হারিয়ে গেছে। এই পুলগুলো ও এর সঙ্গেযোগাযোগ রক্ষাকারী সড়ক তৈরি করেছিলেন মোঘলরা।
আরও পড়ুন: বিশ্বের যে ৪ শহরে বসবাস করতে চাইলেই পাবেন জমি ও টাকা
এর মাঝেই বিকেলের পড়ন্ত সোনালি রোদের স্পর্শ গায়ে এসে লাগতে শুরু করেছে। গোধূলিবেলার আলোয় পানাম নগরও উজ্জ্বল রং ধারণ করতে শুরু করেছে।
এবার ফেরার পালা। ভাবতেই মনটা বিষাদে ছেয়ে যায় অবস্থা! আবার ফিরে যেতে হবে ব্যস্ত নগরীতে। আবারও রুটিন মাফিক ক্লাস, অফিস আর অ্যাসাইমেন্ট এর বাঁধা ধরা নিয়মের বেড়াজালে।
হ্যাঁ যেতে তো হবেই। এর ব্যতয় করা কি আর চলে? ফেরার পথে সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে সবাই মিলে সম্মিলিত ছবি তোলা আর এক নজর প্রাচীন লাল ইটের দালানগুলোকে ফিরে ফিরে দেখা।
লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী
জেএমএস/জেআইএম