শীতে রাঙামাটি ও সাজেক ভ্যালি ভ্রমণে যা যা দেখবেন

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:১০ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২

ইমন ইসলাম

বই পড়ে যে শিক্ষা অর্জন করা হয় তা পরিপূর্ণ শিক্ষা নয়। শিক্ষার সঙ্গে বাস্তব জ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটাতে পারলেই তা হয়ে উঠে পরিপূর্ণ শিক্ষা। নানা রকম ব্যবহারিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে এ পূর্ণতা অর্জন করা যায়। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে শিক্ষা সফর অন্যতম।

শিক্ষা সফরে গিয়ে শিক্ষার্থীরা শুধু আনন্দ লাভই করে না, বরং ঐতিহাসিক বিভিন্ন বিষয় প্রত্যক্ষ করে এবং সে বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করে। তাই প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা অর্জনের জন্য শিক্ষা সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিবছরের মতো এবারও শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার একঘেয়েমিতা থেকে মুক্তি দিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ শিক্ষা সফরের আয়জন করে। শিক্ষা সফের স্থান নির্ধারন করা হয় দেশের বৃহত্তম কৃত্রিম কাপ্তাই লেক ও মেঘ পাহাড়ের রাজ্যে সাজেক ভ্যালি।

তখন রাত ৮টা। একে একে মুরাদ চত্বরের সামনে জড়ো হচ্ছি সবাই। গন্তব্য রাঙামাটি। রাত ৯টায় বাস ছেড়ে দিল। স্বপ্নভ্রমণের যাত্রা এখান থেকেই হলো শুরু।

বাস ছাড়তেই হু হু করে হিমশীতল বাতাস বইতে শুরু করলো শীতের মাত্রা বাড়তে থাকায় শীতের পোষাক জড়িয়ে আমরা নিজ নিজ আসনে ঘুমিয়েই রাত পার করলাম।

ঘুম থেকে উঠে শুনলাম রাঙামাটি শহর আর মাত্র আধা ঘণ্টার পথ। রাঙামাটি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোর সাড়ে ৬টা বেজে যায়। ওখানে হোটেলে উঠে, ব্যাগপত্র রেখে, ফ্রেস হয়ে সকালের নাশতা করে নিলাম সবাই।

পূর্ব দিকের পাহাড়ি কোনো একটা ঝোপ থেকে যেনো হঠাৎ উঁকি দিচ্ছে সূয্যি মামা। আর তার আলোর আভা গিয়ে পড়ছে লেকের পানিতে। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘে মেঘে আলো ফোটার এ দৃশ্যে প্রতি ভোরেই এক নতুন খেলায় মেতে ওঠে প্রকৃতি।

আর সে দৃশ্য পরিবর্তন হয় প্রতি সেকেন্ডেই। সবুজাভ পাহাড় থেকে সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে লেকের পানির রং পরিবর্তিত হয়, বদলে যায় প্রকৃতির দৃশ্য। যা যে কাউকে বিমোহিত করতে বাধ্য।

লঞ্চঘাট থেকে কয়েক মিনিট যেতেই মনে হলো যেন বিশাল সাগরে এসে পড়েছি। চারিদিকে অ থৈ পানি আর পানি। একটু দূরে ছোট ছোট দ্বীপ। কিছু দূর যেতেই খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ছোট ছোট বাসা।

লেক পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা সবাই এগিয়ে যাচ্ছিলাম আরো ভেতরের দিকে । জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য আর মাথার ওপর বিভিন্ন পাখির ওড়াউড়ি এক মনোরম পরিবেশের তৈরি করেছিল, যা সবার এক রোমাঞ্চকর অনুভূতির সৃষ্টি করেছিল।

সবুজ বৃক্ষ আচ্ছাদিত উঁচু-নিচু পাহাড়, নীল জলরাশির কাপ্তাই লেক, স্বচ্ছ নীলাভ জল আর বিস্তৃতি, গভীর মমতা আর ভালোবাসায় গড়া পাহাড়ি আদিবাসীদের বর্ণিল জীবনধারা, অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ এক যেন মিলিত আহ্বান।

দেখে মনে হবে সব সৌন্দর্য যেন এক জায়গায় এসে মিলিত হয়েছে। প্রকৃতির প্রায় সব রূপ-রং যেন এখানে এসে মিশেছে একই সমান্তরালে। বিকেল ও গোধূলি বেলার আধো-আধো আলোতে কাপ্তাই হ্রদের কী যে দৃশ্য তা ভুলে যাওয়ার নয়।

মাঝপথেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। ফিরে আসার সময় দৃশ্যও মনোরম। পাহাড়ের গায়ে ঢলে পড়ছে লাল সূর্য। নীড়ে ফিরছে পাখির দল। জেলেরা আলো জ্বালিয়ে মাছ ধরছে। দ্বীপগুলোতে আলো জ্বলছে। মাথার ওপর রাতজাগা পাখিদের ওড়াউড়ি।

শুভলং ঝরনা, বরকল উপজেলার মায়াবী পাহাড়ের বাঁক, সোনালি বৌদ্ধ স্বর্ণ মন্দির, ইঞ্জিনচালিত নৌকার ভটভট শব্দ, পর্যটকের হৈ হুল্লোড়, অধিবাসী ও জেলেদের কর্মব্যস্ততার দৃশ্য যা চিত্তকে বিনোদিত করবে।

ভ্রমণের কাপ্তাই পর্ব শেষ হলে আমাদের বহনকারী বাসটি এসে পৌঁছালো খাগড়াছড়ি শহরে। এবার অপেক্ষা চান্দের গাড়ির জন্য। রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার শুরু মূলত এই চান্দের গাড়ির সঙ্গেই। একেক গাড়িতে মোট ১২ জন করে উঠে পড়লাম।

গান আর আড্ডায় শুরু হলো আমাদের সাজেক ভ্যালির যাত্রা। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথ চলতে চলতে আর গান গাইতে গাইতে কখন যে মেঘ আর পাহাড়ের রাজ্যে হারিয়ে গেছি খেয়ালই ছিল না কারো।

সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে গেছে আঁকা-বাঁকা পিচঢালা সড়ক। যাওয়ার পথে কখনো গাড়িগুলো আকাশের দিকে, কখনো পাহাড়ের গহীনের দিকে চলতে থাকে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ি শিশুরা যেন হাত নেড়ে আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছিল।

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক যাত্রার পর পৌঁছে গেলাম সাজেক ভ্যালি। সাজেক ভ্যালি মূলত দুটি পাড়া নিয়ে গঠিত। গাড়ি থেকে নেমে প্রবেশ করলাম রুইলুই পাড়ায় অবস্থিত হিল রিসোর্টে। রিসোর্টের বারান্দায় বসেই আমরা মেঘ-পাহাড়ের মিতালী উপভোগ করছিলাম।

ওখান থেকে মনে হচ্ছিল হাত বাড়ালেই ধরতে পারবো মুঠোভরা মেঘ। সাদা মেঘের ভেলা, অক্সিজেনপূর্ণ বিশুদ্ধ বাতাস আর রবি কিরণ নীল আকাশ এই সাজেক ভ্যালির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ। সবুজ পাহাড় আর কোলঘেঁষা মেঘ দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়।

উপর থেকে দেখলে মনে হয় মেঘেদের ভেলা যেন সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে বসে আছ। হেলিপ্যাডে পৌঁছে সন্ধ্যার সূর্যাস্ত উপভোগ করার পাশাপাশি সবাই ছবি উঠলাম। এখানে আছে অস্থায়ী মুখরোচক খাবারের দোকান। ফিশ ফ্রাই, ডিম চপ, আলু চপ, জিলাপি,মম, পেঁয়াজু, ঝালমুড়ি, চানাচুর পাওয়া যায় এখানে।

সকালে ঘুম ভাঙলো আযানের মিষ্টি ধ্বনিতে। গতকাল সারা দিনের ক্লান্তিতে লেপ মুড়ি দিয়ে জম্পেশ একটা ঘুম হলো। খুব ভোরে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম সূর্যোদয় দেখার জন্য।

পাহাড়ে সূর্যোদয় সব সময়ই সুন্দর। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে চলে গেলাম হেলিপ্যাডে। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখতে পারা জীবনের সেরা অভিজ্ঞতাগুলোর একটি।

সকালের নাস্তা সেরে সবাই রওনা হলাম কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্য। কংলাক পাড়ায় গাড়ি যায় না। তাই আমরা পায়ে হেঁটেই উপরে উঠলাম। এরপর পুরো পাহাড় ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম।

যাত্রার মাঝপথে সবাই একটু থেমে আদিবাসীদের ছোট ছোট দোকান থেকে শরবত আর কলা , আনারস খেয়ে আবারও চলা শুরু করলাম। পাহাড়ি ফল খেতে খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ।

ঐতিহ্যবাহী লুসাই গ্রাম রুইলুই পাড়ায় হ্যালিপ্যাডের কাছেই অবস্থিত। ৩০ টাকার প্রবেশ ফি দিয়ে উপভোগ করা যায় লুসাই বাড়ি ও গ্রাম। লুসাই পাহাড়ের একেবারেই পাদদেশে এ গ্রামের অবস্থান।

প্রবেশমুখেই স্বাগত জানাবে লুসাই গ্রাম। এখানে লুসাই জনগোষ্ঠীর ধারণ করা কিছু পোশাক ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র আছে। এখানে আসা পর্যটকদের মূল আকর্ষণ হলো বাঁশের ভেতর রান্না করা খাবার। এ খাবারের আছে অন্য রকম স্বাদ।

তাই তো এ খাবারের স্বাদ নিতে ভুল করলাম না। এছাড়া বাঁশ দিয়ে সাধারণ ব্যাম্বো চিকেন, ব্যাম্বো বিরিয়ানি, ব্যাম্বো পিস ও ব্যাম্বো চা ও কফি তৈরি হয়। আর এ খাবার রান্না করা হয় বাঁশ যখন কোড়ল অবস্থায় থাকে। সাজেকের ব্যাম্বো চা সত্যিই অসাধারণ।

সবাই খুব মজা করে এ চা খায়, আমরাও খেয়েছি। এ চা বানানোও সহজ। প্রথমে বাঁশের ভেতর দুধ, চিনি দেওয়া হয়। এরপর চায়ের লিকার দিয়ে লুইসাইদের তৈরি এক ধরনের কাঠি দিয়ে নাড়তে হয়। এভাবেই তৈরি হয় ব্যাম্বো চা।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

জেএমএস/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।