শীতে চর কুকরি মুকরি ভ্রমণে যা যা দেখবেন
প্রকৃতির মাঝে ক্যাম্পিং ও লঞ্চ ভ্রমণ যারা ভালোবাসেন তাদের জন্য সেরা গন্তব্য হতে পারে চর কুকরি মুকরি। দেশের জনপ্রিয় এক ক্যাম্পিং সাইট এটি। ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার চর কুকরি মুকরি ভ্রমণের সেরা সময় হয় শীতকাল।
এ সময় চর কুকরি মুকরির আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আবার ক্যাম্পিং করার জন্যও শীতকালই সেরা। কারণ বর্ষায় চরের বেশিরভাগই ডুবন্ত থাকে। এ কারণে শীত বাদে অন্যান্য সময় চর কুকরি মুকরি ভ্রমণে না যাওয়াই ভালো। চর কুকরি মুকরি ভ্রমণের আদর্শ সময় হলো জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস।
সেখানে গিয়ে যা যা দেখবেন
জানা যায়, চর কুকরি মুকরি ১৯১২ সালের দিকের জেগে ওঠে। কথিত আছে, একসময় চর কুকরি মুকরিতে শুধু কুকুর আর ইঁদুরের বাস ছিল। স্থানীয়দের কাছে যা মেকুর নামে পরিচিত। এ কারণেই চরের নামকরণ করা হয় কুকরি মুকরি।
১৯৮৯ সালের ১৪ মে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার একর জমিতে সংরক্ষিত শ্বাসমূলীয় ম্যানগ্রোভ জাতীয় বৃক্ষের বনায়ন শুরু হয়। চর কুকরি মুকরির বনভূমিতে স্থান পেয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, কেওড়া, নারিকেল, বাঁশ ও বেত।
বর্তমানে কুকুরি মুকুরি চরে বনভূমির পরিমাণ ৮ হাজার ৫৬৫ হেক্টর, যার মধ্যে ২১৭ হেক্টর জমি বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম। বসতি ও কৃষি আবাদর জন্য প্রায় ৪ হাজার ৮১০ হেক্টর জমি রয়েছে। মাছ ধরা ও কৃষিকাজ চর কুকরি মুকরিতে বসবাসকারী মানুষের প্রধান পেশা।
ম্যানগ্রোভ বন মারিয়েই পৌঁছাতে হয় চর কুকরি মুকরিতে। এ যাত্রায় পথ চলার সঙ্গী হিসেবে স্থানীয় ছোট শিশুদের নিতে পারেন। ১০-২০ টাকার বিনিময় নারকেল বাগান পর্যন্ত পথ চিনিয়ে দেবে তারা। ম্যানগ্রোভ বন পেরিয়েই ঘাট, ছোট্ট একটি খেয়া পার হলেই নারকেল বাগান ক্যাম্পিং সাইট।
কয়েক ফিটের খেয়া পার হতে জনপ্রতি ১০ টাকা করে দাবি করে যদিও। সেখান থেকে তারুয়া যেতে চাইলে ট্রলার পাবেন। রিজার্ভ ট্রলার নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন সময় করে ভার্জিন বিচ খ্যাত তারুয়া থেকে।
যারা চর কুকরি মুকরিতে পেছনে বিস্তার বন, আর সামনে অকূল দরিয়া। আর এর মাঝেই ছায়া ঘেরা, বৃক্ষরাজির নিচে যারা ক্যাম্পিং করতে চান তারা টাঙাতে পারেন টেন্ট।
বণ্যপাণীদের অভয়ারণ্য হলো এই চর। সেখানে যেসব প্রাণী দেখা যায় তার মধ্যে আছে চিত্রা হরিণ, বানর, উদবিড়াল, শিয়াল, বন্য মহিষ-গরু, বন-বিড়াল, বন মোরগ, প্রভৃতি।
আর পাখি ও সরিসৃপ হিসেবে এই বনের অধিবাসীদের মধ্যে আছে বিভিন্ন প্রজাতির বক, বন মোরগ, শঙ্খচিল, মথুরা, কাঠময়ূর, কোয়েল, গুইসাঁপ, বেজি, কচ্ছপ, কুকুরি বনের ও নানা ধরনের সাপ।
এই চরে শীতকালের চিত্র ভিন্ন ধরনের। সূদুর সাইরেরিয়া থেকে ছুটে আসা অতিথি পাখিদের আগমনে চরাঞ্চলগুলো যেন নতুন রূপ ধারণ করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শীত মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৬৫০ প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এর মধ্যে সিংহভাগই ভোলায় অবস্থান করে। তখন স্বপ্নের দ্বীপ কুকরিমুকরি এর চর অতিথি পাখিদের অভয়ারন্যে পরিণত হয়।
কীভাবে যাবেন চর কুকরি মুকরি?
ঢাকা থেকে চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাট পর্যন্ত লঞ্চ রুটে যাওয়া ও আসার ভাড়া কিন্তু ভিন্ন। যাওয়ার সময় ডেক ভাড়া ৪০০ হলেও ফেরার সময় ৩০০ টাকা। সিঙ্গেল কেবিন ১২০০ ও ডাবল কেবিন ২৪০০ টাকা।
বেতুয়া ঘাটে নেমে চর কুকরি মুকরিতে যাওয়ার দুই উপায়। প্রথমটি হলো, অটো নিয়ে চলে যেতে হবে চরফ্যাশন বাস টার্মিনালে। ভাড়া জনপ্রতি ৩০-৪০ টাকা। সময় লাগবে ২০-২৫ মিনিট। চরফ্যাশন থেকে আপনি চর কচ্ছপিয়া যাওয়ার জন্য পাবেন দক্ষিণ আইচার বাস। ভাড়া জন প্রতি ৪০ টাকা। সময় লাগবে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা।
বাস থেকে নেমে আবার অটো বা রিকশায় জনপ্রতি ১৫ টাকা ভাড়ায় কচ্ছপিয়া ঘাটে পৌঁছে যাবেন। তবে আমরা সরাসরি বোরাক নামক রিকশা রিজার্ভ করেই ছুটেছি কচ্ছপিয়া ঘাট। ৪ জন বেশ সহজেই আরাম করে বসা যায় রিকশায়। গাড়ি ভাড়া ৪০০ টাকা।
চর কচ্ছপিয়া থেকে চর কুকরি মুকরি যাওয়ার উপায় মূলত দুটি। জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা ভাড়ায় ট্রলারে যেতে পারেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা ও দুপুর ১২টায় লোকাল ট্রলার চর কুকরি-মুকরির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
ট্রলার ছাড়ায় যেতে পারেন স্পিড বোটে ভাড়া জন প্রতি ১৫০ টাকা। যদি দল যদি ভারি হয় আর দামাদামিতে পররদর্শী হলে আরও কমেও যেতে পারবেন। আমাদের ৩ জনের ভাড়া পড়েছিল ৪০০ টাকা।
দুই পাশের ম্যানগ্রোভ বন কাটিয়ে যখন আপনি ছুটে চলবেন, তখন উপভোগ করবেন স্বর্গসুখ! ট্রলারে ১ ঘণ্টার বেশি সময় লাগলেও স্পিড বোটে এই জার্নি মাত্র ১৫ মিনিটের।
লঞ্চ ঘাট থেকে ক্যাম্পিং সাইট নারকেল বাগান যেতে পারবেন দুই উপায়। মোটরসাইকেল অথবা অটোতে। মোটরসাইকেলে জনপ্রতি ভাড়া ৫০ টাকা আর অটোতে ২০-২৫ টাকা। যান চলার পথ শেষ হলেই শুরু পায়ে হাঁটার পথ।
কোথায় থাকবেন?
চর কুকরি মুকরিতে ক্যাম্পিং না করেও রাত কাটাতে পারবেন। চরফ্যাশনের এমপি জনাব জ্যাকব সরকারি অর্থায়নে রেষ্ট হাউজ করেছেন। যায় প্রতিটি রুমের ভাড়া ২০০০ টাকা ও ৫০০০ টাকা।
এছাড়া খুব স্বল্প মূল্যে রাত কাটাতে পারেন হোম স্টে গুলোতে। তবে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে টেন্টে ক্যাম্পিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো তাই সে বিষয়ে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
চর কুকরি মুকরি ভ্রমণে সতর্কতা-
>> চর এলাকা হওয়ায় সেখানে গাড়ির কোনো ব্যবস্থা নেই। যাদের হাঁটার অভ্যাস নেই তারা এই চরে যাবেন না।
>> হরিণ শিকার থেকে বিরত থাকুন এটি দণ্ডনীয় অপরাধ।
>> স্থানীয়দের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুন।
>> সেখানে বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই পাওয়ার ব্যাংক সঙ্গে রাখুন।
>> নদীতে সাঁতার কাটার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করুন।
>> গ্রামীণ ও টেলিটকের নেটওয়ার্ক ভালো, এই সিমগুলো ব্যবহার করতে পারেন।
জেএমএস/জেআইএম