চূড়ান্ত হয়নি মহাপরিকল্পনা, ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না পর্যটন খাত

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ০৬:২৮ পিএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২
নয়নাভিরাম গন্তব্য থাকলেও নেই বিদেশি পর্যটক, ফাইল ছবি

স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে কমবেশি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দেশের প্রায় সব খাত। গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে অর্থনীতিতে। তবে এর ব্যতিক্রম পর্যটন খাত। নানান অব্যবস্থাপনা আর সমন্বয়হীনতায় কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না পর্যটন। বিদেশি পর্যটকরা যেমন আকৃষ্ট হচ্ছে না, তেমনি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন দেশের পর্যটকরাও।

পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রচারের অভাব, সমন্বয়হীনতা, পরিকল্পনার ঘাটতি এবং পরিবেশ তৈরি করতে না পারায় বছরের পর বছর এভাবেই চলছে দেশের পর্যটন খাত। তারা আরও বলছেন, দেশের পর্যটন খাতের প্রধান সমস্যা হলো প্রচার-প্রচারণার অভাব। দেশের বাইরে পর্যটনকেন্দ্রগুলো নিয়ে কোনো প্রচার হয় না। ফলে বিদেশি পর্যটকরা আকর্ষিত হন না। অথচ দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ করতে কক্সবাজারে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, সেন্টমার্টিন, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য কুয়াকাটা, নিঝুম দ্বীপ, সিলেটের চা-বাগান, সুন্দরবন, পুরাকীর্তিসহ নানান আকর্ষণ আছে দেশে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দাবি, সুপরিকল্পিত পর্যটন বিকাশে এই খাতের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। করোনার কারণে এই মহাপরিকল্পনার কাজ কিছুটা পিছিয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি এই পরিকল্পনার কাজ শেষ হবে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলে দেশের পর্যটনে আমূল পরিবর্তন হবে।

আরও পড়ুন: পর্যটন দিবস উপলক্ষে সাইকেল শোভাযাত্রা

আজ (২৭ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব পর্যটন দিবস। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, সভা-সেমিনারসহ নানান কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করেছে পর্যটন মন্ত্রণালয়। এসব সভা-সেমিনারে দেশের পর্যটন খাতের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন বক্তারা। তবে এসবের মাঝে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের তেমন কোনো কর্মসূচি ছিল না।

বিদেশি পর্যটক আসছে না

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে দেশে পর্যটক এসেছিল তিন লাখ ২৩ হাজার। কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে এখন পর্যন্ত আর কোনো পর্যটক আসেননি। বিদেশি নাগরিক বা পর্যটকদের জন্য নানান বিধিনিষেধ ছিল। সব শেষ গতকাল (২৬ সেপ্টেম্বর) থেকে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক আসার বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিদেশিদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংকট উত্তরণে কার্যকর পথনকশা না থাকা, প্রচার-প্রচারণার অভাব, দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, অদক্ষতা, বিনিয়োগের অভাবে নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের পর্যটন। অথচ বৈচিত্র্যপূর্ণ পর্যটনসম্পদ থাকার পরও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে পেছনের সারিতেই আছে বাংলাদেশ। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ভ্রমণ ও পর্যটন উন্নয়ন সূচকে ১১৭টি দেশের মধ্যে একেবারেই পেছনের সারিতে বাংলাদেশের অবস্থান, ১১০তম। ২০১৯ সালে ছিল ১১৩তম। এছাড়া বিদেশি পর্যটকদের যেসব চাহিদা তা পূরণ করতে না পারায় তারা আসছেন না।

এ নিয়ে এশিয়ান ট্যুরিজম ফেয়ারের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন হেলাল বলেন, দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলতে পারলে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করা যাবে। তখনই দেশের পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি দুইভাবে অবকাঠামো দরকার। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বিনিয়োগ করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্যুরিজম বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৯ সালে আসা বিদেশি পর্যটকের হিসাব ছাড়া আর কোনো তথ্য নেই। তাদের মতে, ওই বছর তিন লাখের ওপর বিদেশি পর্যটক এসেছিল। তবে সেই বছরের পর থেকে আর কোনো হিসাব নেই তাদের কাছে।

অপরূপ সেন্ট মার্টিন, সংগৃহীত ছবি

জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এসব জটিলতা কাটিয়ে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণে কাজ করে যাচ্ছি। এরই মধ্যে আমরা অবকাঠামো সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। এখন টেকসই পর্যটন উন্নয়ন নিশ্চিতে পদক্ষেপ নিচ্ছি।

তিনি বলেন, বিদেশি পর্যটকদের যেসব চাহিদা তা আমরা পূরণ করতে পারি না। এখন তাদের আকর্ষণে নানা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী আগামীতে কাজ করা হবে।

আটকে আছে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন

দেশের পর্যটন খাতের উন্নয়নে ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে সালে বিদেশি পরামর্শক সংস্থা আইপিই গ্লোবালের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। চুক্তি অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি ২০২০ সালে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন শুরু হয় এবং ৩০ জুন ২০২০ সালে তা শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে যথাসময়ে শেষ না হওয়ায় এটির সময় ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ভ্যাট ও এআইটিসহ-এর চুক্তিমূল্য প্রায় ২৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

ট্যুরিজম বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি এই মহাপরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে বিশ্লেষণ করা হবে দেশের পর্যটন শিল্পের বর্তমান অবস্থা, এর শক্তি কতটুকু, দুর্বলতা কোথায়, সম্ভাবনা কেমন, কোন ধরনের সংকট রয়েছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্ধারণ করা হবে বাংলাদেশের পর্যটনের ভিশন, মিশন, স্ট্র্যাটেজিক অবজেক্টিভস, প্রায়োরিটিস এবং লিংকেজ।

তৃতীয় পর্যায়ে জোন বা এরিয়া নির্দিষ্ট করে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হবে। প্রোডাক্ট উন্নয়নের পরিকল্পনা, অর্থায়ন ও বিনিয়োগের কৌশল অন্তর্ভুক্ত করে কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত এবং বিপণন ও প্রমোশনাল কৌশল নির্ধারণ করা হবে। এছাড়া মেলা, ফেস্টিভ্যাল, কার্নিভাল, কালচারাল অনুষ্ঠান, ব্র্যান্ডিং, স্যোসাল মিডিয়ায় প্রচারণা, ভিডিও নির্মাণ, ডিজিটাল স্ক্রিনে প্রদর্শনী ও ওশান ট্যুরিজমকে বেসরকারি উদ্যোগে চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে। মহাপরিকল্পনা তৈরি করার পর স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে ন্যাশনাল ট্যুরিজম কাউন্সিল এটা চূড়ান্ত করবে।

এ নিয়ে প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী জাগো নিউজকে বলেন, দেশের পর্যটন শিল্পকে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে এই মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শেষ হবে। ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের পর্যটন নতুন যুগে প্রবেশ করবে।

তিনি বলেন, আমাদের পর্যটনে অপার সম্ভাবনা ও সুযোগ রয়েছে। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও প্রকৃতিসহ পর্যটনের সব উপাদান ও সুযোগ-সুবিধা সঠিকভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। ব্র্যান্ডিং করতে হবে। দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে প্রচার করতে হবে। তাহলেই বিদেশি পর্যটকরা আমাদের পর্যটন গন্তব্যগুলো নিয়ে আকর্ষণ বোধ করবেন।

এমএমএ/এমএইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।